Image description

বাংলাদেশ চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে— এমন একটি ধারণা নতুন করে সামনে আসছে। এ অবস্থার মধ্যে চলতি সপ্তাহে বেইজিং সফরে যাচ্ছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার সফরে দ্বিপক্ষীয় চাওয়া-পাওয়ার চাইতে বেশি গুরুত্ব পাবে রাজনৈতিক সম্পর্ক ও ভূ-রাজনীতি। বিশেষ করে, অন্য দেশগুলোকে বিভিন্ন ধরনের বার্তা দেওয়ার কৌশল হতে পারে এই সফরের মূল লক্ষ্য।

ঢাকা-বেইজিংয়ের কূটনৈতিক সূত্রগুলো বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শেষের দিকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র আমন্ত্রণে বেইজিং সফর করেছিলেন অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। তার সফরটি বেশ সফল হিসেবে দেখছে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ওই সফরে বাংলাদেশের পাওয়ার পাল্লা ভারি। কেননা সফর থেকে ঋণ পরিশোধের সময় বাড়ানো, সুদহার কমানোর আশ্বাস, কুনমিংয়ের তিনটি হাসপাতালে বাংলাদেশি রোগীদের চিকিৎসার জন্য নির্ধারণ, ঢাকায় চীনের দ্বারা একটি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণসহ সাংহাই-কুনমিং-চট্টগ্রামের মধ্যে ফ্লাইট চালুর সিদ্ধান্ত এসেছে।

কৌশলগত অংশীদার নয়, বন্ধু হিসেবে চীনের সঙ্গে কাজ করবে সরকার
বাংলাদেশ ও চীনের পতাকা / সংগৃহীত

শুধু তাই নয়, উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের আতিথেয়তায় নজির স্থাপন করে চীন। ঢাকা থেকে নিরাপত্তা দিয়ে তাদের বেইজিংয়ে নিয়ে যাওয়া এবং ফের ঢাকায় পৌঁছে দেওয়া হয়।

 

তৌহিদ হোসেনের সফল সফরের দুই মাসের মাথায় ড. ইউনূস বেইজিং সফরে যাচ্ছেন। কূটনৈতিক সূত্রগুলো ধারণা করছে, প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফরে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মুখ্য নয়। এই সফরটি আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সফরের মূল লক্ষ্য আশপাশের প্রতিবেশীসহ কিছু বন্ধু রাষ্ট্রকে জানানো যে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সম্পর্ক উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। অর্থাৎ বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়া, আমাদের অন্য বন্ধুও আছে। এককথায় এই অঞ্চলের বড় খেলোয়াড় চীন আমাদের বন্ধু।

স্থানীয় কূটনীতিকরা বলছেন, ভারসাম্য পররাষ্ট্রনীতির বিষয়ে সজাগ রয়েছে বাংলাদেশ। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে চায় ঢাকা। দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশ এমন কিছু করতে চায় না, যেটা অন্য বড় শক্তিগুলোর অসন্তোষের কারণ হবে। প্রধান উপদেষ্টার সফর ঘিরে অন্য আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তিগুলো কী প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারে, সেটি বিবেচনায় রাখা হয়েছে। তবে অন্য দেশগুলোকে কিছু বার্তা দেওয়ার জন্য হলেও চীনের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক থাকা দরকার।

চীনের উদ্দেশে ঢাকা ছেড়েছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র আমন্ত্রণে চলতি বছরের জানুয়ারিতে চীন সফর করেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন / ঢাকা পোস্ট

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা আগামী ২৬ থেকে ২৯ মার্চ চীন সফর করবেন। তিনি আগামী বুধবার (২৬ মার্চ) চীনের পাঠানো একটি উড়োজাহাজে ঢাকা থেকে রওনা হবেন। ২৭ মার্চ চীনের হাইনান প্রদেশে অনুষ্ঠেয় বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ার (বিএফএ) সম্মেলনে যোগ দেবেন। সম্মেলনের উদ্বোধনী প্লেনারি সেশনে বক্তব্য দেবেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে চীনের স্টেট কাউন্সিলর এক্সিকিউটিভ ভাইস প্রিমিয়ার দিং ঝুঝিয়াংয়ের বৈঠক হতে পারে।

 

২৮ মার্চ বেইজিংয়ের ‘গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস। একই দিনে হুয়াওয়ে কোম্পানির উচ্চ-প্রযুক্তিসম্পন্ন এন্টারপ্রাইজ পরিদর্শন করবেন তিনি। ২৯ মার্চ চীনের বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় পিকিং ইউনিভার্সিটি ড. ইউনূসকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করবেন এবং সেখানে বক্তব্য রাখবেন। পরে বেইজিং থেকে চীনের একটি বিমানে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে প্রধান উপদেষ্টার।

প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফরে ৬ থেকে ৮টি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। পাশাপাশি এ সফরে চারটি ঘোষণা আসবে। যার মধ্যে বেশ কয়েকটি প্রকল্পের অর্থায়নের জন্য বাংলাদেশকে এক থেকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার ঘোষণা দেবে চীন; যেখানে মোংলা বন্দরের আধুনিকায়নে অর্থায়ন যুক্ত থাকবে।

প্রধান উপদেষ্টার সফরে ৬ থেকে ৮টি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার কথা রয়েছে। পাশাপাশি এ সফরে চারটি ঘোষণা আসবে। যেখানে মোংলা বন্দরের আধুনিকায়নে অর্থায়ন যুক্ত থাকবে / ইনফোগ্রাফ / ঢাকা পোস্ট

প্রধান উপদেষ্টার সফরে রাজনৈতিক বার্তা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে দায়িত্বশীল এক কূটনীতিক বলেন, সফরে রাজনৈতিক বার্তাটা কী, এটাই গুরুত্বপূর্ণ। এই সফরের মূল বার্তা হলো রাজনৈতিক। মূল কথা হলো, এই সরকারের সমর্থনে তারা (চীন) আছে, এই মেসেজটা দেওয়া। সবচেয়ে বড় কথা হলো প্রেসিডেন্ট শি’র সঙ্গে বৈঠক, আর সেটি হবে পূর্ণাঙ্গ দ্বিপক্ষীয় বৈঠক। এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বেইজিংয়ে সরকারপ্রধানের বৈঠকে কী হতে পারে— জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন গত ২৩ মার্চ সাংবাদিকদের বলেন, এবারের সফরে কোনো চুক্তি সই হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন বিষয়ে কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই হবে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রাজনৈতিক, কৌশলগত, বাণিজ্যিক, উন্নয়ন সহযোগিতা ও সামরিক দিক বিবেচনায় নিয়ে আগামী ২৮ মার্চ চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে বৈঠকে বসবেন ড. ইউনূস। ওই বৈঠকে নজর থাকবে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া ছাড়াও বিভিন্ন দেশের।

গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে অস্বস্তি দেখা দেয়। অন্তর্বর্তী সরকার সাত মাস পার করলেও দুই প্রতিবেশীর মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন থামছে না। তবে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আর অস্বস্তি চায় না ড. ইউনূসের সরকার। ভারতের সঙ্গে আর যেন সম্পর্ক খারাপ না হয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ পর্যায় থেকে সেই নির্দেশনা রয়েছে। কূটনৈতিক পর্যায়ে এমন সিদ্ধান্ত থাকলেও দুই দেশের সম্পর্কে ‘ঠান্ডা লড়াই’ থামছে না। বিশেষ করে, দুই প্রতিবেশী দেশের রাজনীতিবিদদের কথাবার্তায় লাগাম টানা যাচ্ছে না। এমন পরিস্থিতিতে কিছু বিষয়ে ভারতের বিকল্প খোঁজার পাশাপাশি দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করতে হয়ত কৌশলগত পন্থা অবলম্বনের চেষ্টা করছে ঢাকা। যার ফলে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা দেখিয়ে ভারতকে কোনো বার্তা দিতে চাইছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বাংলাদেশ-ভারত : এক সময়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন বৈরী
বাংলাদেশ ও ভারতের পতাকা / সংগৃহীত

এদিকে, আগামী মাসে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককে বঙ্গোপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থা বিমসটেকের শীর্ষ সম্মেলনের ফাঁকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠক চেয়ে কূটনৈতিক পত্র দিয়েছে বাংলাদেশ। যদিও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত দিল্লির কাছ থেকে কোনো জবাব পায়নি ঢাকা। তবে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর নয়াদিল্লিতে সংসদীয় প্যানেলের একটি বৈঠকে বলেছেন, ড. ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈঠক আয়োজনে বাংলাদেশের অনুরোধ বিবেচনা করা হচ্ছে।

বাংলাদেশের সাবেক এক রাষ্ট্রদূত বলেন, ড. ইউনূসের সরকার ভারসাম্য রক্ষা করে এই সফরকে কীভাবে ব্যবহার করবেন সেটিই গুরুত্বপূর্ণ। এ সফরে কয়েকটি বন্ধু দেশের নজর থাকবে, যার মধ্যে ভারত-যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে। এ ছাড়া, জাপানও বেশ গুরুত্বসহকারে এ সফরে নজর রাখবে। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, চীন ভালো করে জানে অধ্যাপক ইউনূসের সরকার অস্থায়ী সরকার। যার কারণে চীন বড় কোনো সিদ্ধান্তে যাবে না। তবে দেশটির লক্ষ্য রাজনৈতিক একটি বার্তা অন্যদের দেওয়া।

ব্যাংককে ইউনূস-মোদির সম্ভাব্য বৈঠক নিয়ে এ রাষ্ট্রদূত বলেন, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর থেকে বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্কে যে টানাপোড়েন চলছে, সেটি অনেকটাই কমে আসবে যদি ব্যাংককে ইউনূস-মোদি বৈঠকে বসেন। আমি মনে করি, দুই প্রতিবেশীর একে-অপরকে প্রয়োজন নেই— এ কথা বলার সুযোগ কারও নাই। যার যার স্বার্থ বিবেচনায় দুই শীর্ষ নেতার বৈঠক হলে দুই দেশেরই কল্যাণ হবে। আমার ধারণা বৈঠকটি হবে।

আজ ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন চীনের রাষ্ট্রদূত
বাম থেকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস, চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন / কোলাজ / সংগৃহীত

কূটনৈতিক অঙ্গন-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ড. ইউনূসের চীন সফর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যতটা উদ্বেগ থাকবে, ভারতের উদ্বেগ থাকবে তার চেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ায় ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সবক্ষেত্রে চীনের প্রভাব বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে চীনের প্রভাব ঠেকানো। সেজন্য চীনের প্রভাব ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সহায়ক শক্তি হিসেবে দেখছে। ড. ইউনূসের সরকার ভারসাম্য রক্ষা করে এই সফরকে কীভাবে ব্যবহার করে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন।

অপরদিকে, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে শীর্ষ বৈঠকের প্রস্তুতি এগিয়ে নিতে দুই দেশের কূটনীতিকেরা নিয়মিত পরামর্শমূলক বৈঠকে বসছেন। রোববার ঢাকায় পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে বৈঠক করেন চীনা রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন। বৈঠকের পর রাষ্ট্রদূত সাংবাদিকদের বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বেইজিং সফরের সময় গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘোষণা আসতে পারে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৫০তম বার্ষিকীতে এই সফর একটি মাইলফলক হবে।

চীনে দায়িত্ব পালন করা বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফয়েজ আহমেদ বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পক্ষে চীনের সঙ্গে বড় ধরনের কোনো প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব হবে না। বাংলাদেশে যেন চীনের প্রকল্প চলমান থাকে, সেটি তাদের চাওয়া থাকবে। নতুন করে হয়ত কিছু প্রকল্পের ঘোষণা আসতে পারে, কিছু সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে।

তিনি আরও বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত নিবিড়ভাবে ড. ইউনূসের চীন সফর পর্যবেক্ষণ করবে। সেজন্য ভারসাম্য কূটনীতিতে হয়ত সরকার গুরত্ব দিতে চাইবে বলে আমার মনে হয়।