Image description

বর্তমান সময়ে কিশোর অপরাধ একটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে কিশোর গ্যাংয়ের কার্যক্রম বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা সমাজের শান্তি এবং আইনশৃঙ্খলার জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে।

বিশেষত, মুন্সীগঞ্জে কিশোর অপরাধের হার বাড়তে থাকার পর, প্রশাসন এবং সমাজসেবা অধিদফতর একযোগে এ সমস্যা মোকাবিলায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। একদিকে যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কঠোর পদক্ষেপ নিচ্ছে, তেমনি অপরাধপ্রবণতা কমাতে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে কিশোরদের অংশগ্রহণ বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

 
সমাজসেবা অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলায় ৩৪৫ জন অভিযুক্ত শিশু-কিশোর আইনের সংস্পর্শে এসেছে। এর মধ্যে ৪৪ জনকে সংশোধনের জন্য তাদের পরিবারের কাছে পাঠানো হয়েছে। এছাড়া, পুলিশের পক্ষ থেকে কিশোর অপরাধ রোধে নানা কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে বলে পুলিশ সুপার জানিয়েছেন। তবে, স্থানীয় জনগণের মতে, প্রশাসনের পাশাপাশি সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে।

মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুরের বাসিন্দা আমানুল্লাহ ফরাজি গত ১০ মার্চ কিশোর গ্যাংয়ের খপ্পরে পড়ে সর্বস্ব খুঁইয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যারা আমার কাছ থেকে টাকা ছিনতাই করেছে, তারা কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য ছিল। ওরা সিএনজিতে করে আমাকে সুপার মার্কেট থেকে মালামাল কিনতে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে নামিয়ে দিয়ে ১০ হাজার টাকা ছিনতাই করেছে।’

একইভাবে গত ১৮ মার্চ চাকরিজীবী মোহাম্মদ তারেকও কিশোর গ্যাংয়ের শিকার হন। তার মাঠপাড়া ভাড়া বাসার ভেতর ঢুকে কিশোররা স্বর্ণালংকার ও টাকা নিয়ে যায়। তাজুল ইসলাম বলেন, শহরে কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্য বেড়ে চলেছে। প্রায় সময় বিভিন্ন বাসা বাড়িতে ছিনতাই ডাকাতি হচ্ছে। এমন অনেক ঘটনা পুলিশের খাতায়ও নেই।

২০২১ সালের ২৪ মার্চ মুন্সীগঞ্জ শহরের উত্তর ইসলামপুরে কিশোর গ্যাংয়ের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে ট্রিপল মার্ডার ঘটে। এ ঘটনাটি দেশের মিডিয়ায় আলোচিত হয়, কিন্তু আজও তার বিচার শেষ হয়নি। আর গত বছর শ্রীনগরের কামারগাঁওয়ে কিশোররা দলবেঁধে এসে নিরব নামের এক কিশোরকে প্রকাশ্যে হত্যা করে। এসব ঘটনায় কিশোর অপরাধের ভয়াবহতা এবং তার সামাজিক প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
 

আইনজীবী ও শিক্ষকসহ সংশ্লিষ্টরা বলছেন- কিশোর অপরাধ কমিয়ে আনার জন্য একটি সুস্থ সমাজ গড়ে তোলার দায়িত্ব শুধু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নয়, পরিবার, বিদ্যালয় এবং সমাজের দায়িত্বশীল ভূমিকা জরুরি। কিশোরদের সঠিক পথনির্দেশনা দেয়া হলে তাদের পড়াশোনার পাশাপাশি ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করানো জরুরি।

সাবেক পৌর মেয়র অ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান বলেন, শিশু-কিশোরদের সুরক্ষায় পরিবার, সমাজ ও শিক্ষালয়কে আরও যত্নবান হতে হবে। তিনি মনে করেন, কিশোরদের সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হলে তাদের ইতিবাচক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করতে হবে, যাতে তারা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে প্রবৃত্তি না হয়।

শিক্ষক মিন্টু মিয়া বলেন, ‘কিশোররা কাদামাটির মতো, তাদের যথাযথভাবে গড়ে তোলা আমাদের দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালন করতে না পারলে তাদের মধ্যে নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হতে পারে, যা অপরাধের দিকে ঠেলে দিতে পারে।’

অন্যদিকে, সাংস্কৃতিক কর্মী সুমন হোসেন বলেন, শিশুদের ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড তথা সৃজনশীল বিনোদন দিতে হবে। না হলে দৃষ্টিমন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা তাদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের দিকে পরিচালিত করতে পারে। তিনি আরও বলেন, মাদকের সহজলভ্যতা এবং অপরাধপ্রবণ পরিবেশও কিশোরদের অপরাধমূলক পথে ধাবিত করে।

মুন্সীগঞ্জ পুলিশ সুপার মুহাম্মদ শামসুল আলম সরকার বলেন, ‘কিশোর অপরাধের প্রতিরোধে আমরা একাধিক কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। আমাদের পুলিশ কর্মকর্তা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জনসচেতনতামূলক প্রোগ্রাম চালাচ্ছেন। সেখানে কিশোরদের সচেতন করা হচ্ছে। যাতে তারা জানে যে, যদি কোনো অপরাধ বা ইভটিজিংয়ের শিকার হয়, তাহলে দ্রুত পুলিশকে জানাতে হবে।’ 

তিনি আরও বলেন, আমরা ৯৯৯-এ কল পেলে দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছাই এবং গোয়েন্দা পুলিশসহ সাদা পোশাকের পুলিশ কর্মকর্তারা সর্বদা নজরদারিতে রাখছেন।
 

জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের উপ-পরিচালক আলাল উদ্দিন বলেন, ‘কিশোর গ্যাং প্রতিরোধে সমাজের সব স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের সমাজে কিছু সামাজিক এবং আর্থিক কারণ রয়েছে, যার কারণে কিশোর গ্যাং তৈরি হয়। পারিবারিকভাবে যদি আমরা মনিটরিং না করি তাহলে এই সমস্যা বাড়তে পারে।’

তিনি আরও বলেন, অপরাধ তারা একা করতে পারে না এজন্য সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে। সমাজ এবং পরিবার যদি একসঙ্গে সচেতন থাকে, তবে কিশোর গ্যাং তৈরির প্রবণতা কমানো সম্ভব।

সামাজিক এবং প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি, সমাজসেবা অধিদফতর কিশোরদের ভবিষ্যৎ গঠনে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। জেলা সমাজসেবা অধিদফতরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ৪৭৯ শিশু-কিশোরের মধ্যে ১৩৫ জনকে আদালতের আদেশে সংশোধনের জন্য পরিবারের কাছে পাঠানো হয়েছে। বাকি ৩৪৪ জনকে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে।

প্রবেশন কর্মকর্তা মিহির কুমার পাইক বলেন, এগুলো হলো সেই শিশু-কিশোর, যারা অপরাধে জড়িত হয়ে আইনের আওতায় এসেছে, কিন্তু তাদের পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।