Image description
জুলাই-আগস্ট আন্দোলন দমনে ছাত্রলীগ ক্যাডারদের অস্ত্র সরবরাহ

জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যূত্থানে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকার বিরোধী আন্দোলন দমন এবং ছাত্র-জনতার উপর গুলি চালাতে যুবলীগ-নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের হাতে তুলে দেয়া হয় পুলিশের অস্ত্র-গুলি। তখন রাজধানীতে পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে যুবলীগ-ছাত্রলীগ ক্যাডাররা হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ছাত্র-জসতার উপর। এরা অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি বৈধ অস্ত্র দিয়েও গুলি চালিয়ে সাধারন মানুষ মারে পাখির মতো।

পতিত আওয়ামী সরকারের সময় যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ক্যাডারদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনের সাথে জড়িত ৭০ জন পুলিশ কর্মকর্তাদের শনাক্ত করেছে একটি গোয়েন্দা সংস্থা। এদের মধ্যে ২০ জন পুলিশ কর্মকর্তা পলাতক থাকলেও ৫০ জন পুলিশ কর্মকর্তা এখনও পুলিশ বাহিনীতে বহাল তবিয়তে রয়েছেন। এসব পুলিশ কর্মকর্তারা পুলিশ সদর দফতর, বিভিন্ন মেট্টোপলিটন পুলিশ, পুলিশ একাডেমি সারদা, সিআইডি ও এটিইউসহ পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত রয়েছেন। এদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহন করা না হলে পুলিশ বাহিনী কখনোই জনতার পুলিশ হিসেবে তৈরি করা সম্ভব নয় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

এদিকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরঞ্জামাদি কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন ব্যবহার করেছে তা বের করতে একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে পুলিশ সদর দপ্তর। কিন্তু ওই কমিটির কাজের তেমন অগ্রগতি নেই বলে পুলিশ সদর দফতর সূত্রে জানা গেছে।
সরকারের উচ্চ পর্যায়ে পাঠানো গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দমনপীড়ন চালায়। গুলিতে শিক্ষার্থী ও নিরীহ লোকজনসহ হাজারের বেশি প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা আর কখনো ঘটেনি। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সন্ত্রাসী, দখলদার, চাঁদাবাজ আর লুটপাটকারী সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা এ ধরনের রাষ্ট্র বিরোধী কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন তাদের বিষয়টি ওপেন সিক্রেট। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের সময়ের ভিডিও ফুটেজ ও স্থিরচিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই এদের শনাক্ত করা সম্ভব হবে। এরা এখনও পুলিশ বাহিনীতে থেকে পুলিশকে নিস্ক্রিয় করতে কাজ করছে। একই সাথে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা এবং আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি অবনতির সাথে সম্পৃক্ত পতিত সরকারের পলাতক ক্যাডারদের নানা তথ্য দিচ্ছে বলে তদন্তে উঠে এসেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) আলতাফ হোসেন চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, বর্তমান আন্তবর্তীকালিন সরকার দেশের সার্বিক আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি উন্নয়নে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে কাজ করছে। দেশের আইন-শৃংখলা অবনতির জন্য আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডাররা সক্রিয় রয়েছে। কিছু পুলিশ সদস্য এখনও পলাতক রয়েছে। যে সব পুলিশ কর্মকর্তারা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় নানা অন্যায় কাজের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় বৈধ অস্ত্র যুবলীগ ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ ক্যাডারদের সরবরাহ করেছেন তাদের দ্রুত তদন্ত করে আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, কোটা-আন্দোলন যখন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নিয়েছিল ওই সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগ নেতারা পুলিশের পোশাক পরে পুলিশের অস্ত্র ব্যবহার করেছে ছাত্র-জনতার ওপর। তারা পুলিশের বুলেট প্রুফ জাকেট, হেলমেট ও পিস্তল পর্যন্ত ব্যবহার করেছে। সিসি ক্যামেরার ফুটেজে এসব দৃশ্য দেখা গেছে। রিমান্ডে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারাও তথ্য দিয়েছে যে, আন্দোলনের সময় সারা দেশেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বেশি বেপরোয়া ছিল। তারা পুলিশের বিভিন্ন স্টেশন থেকে বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও পিস্তল নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থী ও জনতার উপর গুলি করেছে। ছাত্রলীগের পাশাপাশি যুবলীগের ক্যাডাররা হামলায় অংশ নিয়েছিল। এসব পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওয়ান আনা না হলে পুলিশ বাহিনীকে পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলা সম্ভব নয় বলে ওই কর্মকর্তা মনে করেন।

পুলিশ সদর দফতরের একটি সূত্রে জানা গেছে, যেসব ছাত্রলীগ নেতা পুলিশের পোষাক ও অস্ত্র ব্যবহার করেছে তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে তালিকায় থাকা একাধিক নেতা দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন। আর যারা দেশে গোপনে আছেন তাদের ধরতে গত সপ্তাহে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে সবকটি ইউনিট প্রধানদের কাছে বিশেষ নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। তবে ছাত্রলীগ নেতারা কোথায় আছেন তা নিদিষ্ট করে বলতে পারছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা। তারা শুধু বলছেন, ‘তাদের খোঁজা হচ্ছে’। ইতিমধ্যে তালিকা ধরে অভিযানও চালানো হচ্ছে।

গোয়েন্দা রিপোর্টে বলা হয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমনে ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীর উত্তরা, যাত্রাবাড়ী, চাঁনখারপুল, মিরপুর, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় ক্যাম্পাস, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, রামপুরা, চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহী, বরিশাল, রংপুরসহ আরও কয়েকটি জেলায় বেশি সংঘর্ষ হয়। এসব স্থানে পুলিশের পাশাপাশি আওয়ামী লীগের অঙ্গসংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা পুলিশের অস্ত্র, বুলেট প্রুফ জ্যাকেট ও হেলমেট পরে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। এতে একের পর এক হতাহতের ঘটনা ঘটে। তাছাড়া ওইসব স্থানের সিসি ক্যামেরার ফুটেজও সংগ্রহ করা হয়। রিমান্ডে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারাও ছাত্রলীগের বিষয়েও তথ্য দিয়েছেন। প্রতিটি বিষয় গভীরে গিয়ে তদন্ত করা প্রয়োজন।

একটি দায়িত্বশীল সূত্রে জানা গেছে, ভিডিও ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ঢাকার বাইরে মুন্সীগঞ্জে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে হেলমেট পরে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি করেন শহর ছাত্রলীগ সভাপতি নসিবুল ইসলাম নোবেল ও সাধারণ সম্পাদক সাজ্জাত হোসেন সাগর। তাদের অ্যাকশনের দৃশ্য সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তারা ১৯ জুলাই ও ৪ আগস্ট সাধারণ শিক্ষার্থী ও লোকজনের উপর গুলি চালায়। তাদের নিজস্ব অস্ত্রের পাশাপাশি পুলিশের পিস্তল ও হেলমেট ব্যবহার করেছে। শেখ হাসিনার পতনের পর দুজনই পালিয়ে যান। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নেওয়া শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। এই সময় শহীদুল্লাহ হলের সামনে পিস্তল হাতে ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সাবেক সহসভাপতি হাসান মোল্লাকে আন্দোলনকারীদের ওপর সরাসরি গুলি করে। তবে তাকে এখনো আটক করা সম্ভব হয়নি। পুলিশের সামনেই তিনি গুলি চালান। পিস্তলটি পুলিশের কি না তা উদঘাটনের চেষ্টা করছে গঠিত অনুসন্ধান টিম। তাছাড়া হাসান মোল্লা দুটি বন্দুক ব্যবহার করেন সবসময়। তবে কোনোটিরই লাইসেন্স নেই। মূলত তার ঠিকাদারি ব্যবসা চালাতে এসব অস্ত্র ব্যবহার করেন। কোনো প্রতিষ্ঠান তাকে টেন্ডার দিতে না চাইলে সংশ্লিষ্টদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলতেন। তার গ্রামের বাড়ি গোপালগঞ্জ। ঢাবি ক্যাম্পাস ছাড়াও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের অস্ত্র হাতে গুলি করতে দেখা যায় নিউ মার্কেট, সায়েন্স ল্যাবরেটরি ও জিগাতলা এলাকায়। তাদের বেশিরভাগই হেলমেট পরে অস্ত্রবাজি করেছে। তাদেরও শনাক্ত করার কাজ চলছে। গত বছর ২ আগস্ট জুমার নামাজের পর উত্তরা মাইলস্টোন কলেজের সামনে পুলিশের সঙ্গে অন্দোলনকারীদের সংঘর্ষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। সেখানেও পুলিশের সঙ্গে সাধারণ পোশাকে ছাত্রদের ওপর গুলি চালায় হেলমেট পরিহিত অস্ত্রধারীরা। ছাত্রলীগ নেতারা থানা-পুলিশের হেলমেট ব্যবহার করে। পুলিশের কাছে তথ্য এসেছে, থানা পুলিশের কাছ থেকে কেউ অন্ত্রও নিয়েছে। তাছাড়া ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে আরও কিছু নেতার নাম পেয়েছে পুলিশ। তাদের সঙ্গে পুলিশ কর্মকর্তাদের গভীর সখ্যতাও ছিল। এসব পুলিশ কর্মকর্তারা বাহিনীতে থেকে এখনও তথ্য সরবরাহ করছে পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা এবং ছাত্র-জনতার হত্যার সাথে সম্পৃক্তদের। দ্রুত তদন্ত করে এদের আইনের আওতায় আনা সম্ভব না হলে আন্তবর্তীকালিন সরকারের সময় আইন-শৃংখলা উন্নয়ন সম্ভব নয়।