
স্থানীয় সরকারের ব্যবস্থা চলছে জোড়াতালি দিয়ে। সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় প্রশাসক থাকলেও ওয়ার্ড পর্যায়ে শক্তিশালী প্রশাসনিক তৎপরতা না থাকায় সেবা কার্যক্রমে ঢিলেঢালাভাব বিরাজ করছে। মূলত কাউন্সিলররাই ওয়ার্ডে জনপ্রতিনিধি হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। কিন্তু গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়রদের পাশাপাশি কাউন্সিলরদের অপসারণ করায় অনেকটা স্থবির হয়ে পরে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচন করতে অনেক দলের আপত্তি থাকায় আপাতত স্থানীয় সরকার নির্বাচনের আশা নেই। এই অবস্থায় ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রশাসক নিয়োগের আলোচনাও আছে। কিন্তু গত দু’দিন থেকে ঢাকায় ওয়ার্ড প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে- এমন আলোচনা হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। প্রশাসক নিয়োগে গোপনে সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে এমন তথ্যও দিয়েছেন কেউ কেউ। যদিও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজিব ভূঁইয়া এমন কিছু জানেন না বলে এক ফেসবুক পোস্টে জানিয়েছেন।
এদিকে, ইউনিয়ন পরিষদের কিছু ইউনিয়নে চেয়ারম্যান থাকলেও যেখানে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পালিয়েছেন সেখানে কোনো রকম সামাল দিচ্ছেন উপজেলা নির্বাহী অফিসাররা। ফলে সেখানেও স্বাভাবিক কার্যক্রমেও বিঘ্ন ঘটছে। প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলছেন, স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায় তারা সাময়িক সামাল দিচ্ছেন পরিস্থিতি। কিন্তু যথাযথ সেবা নির্বাচিত প্রতিনিধি ছাড়া সম্ভব নয় বলে তারা মনে করেন।
গত ৫ই আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের সিটি করপোরেশন, পৌরসভার মেয়রদের পাশাপাশি কাউন্সিলরদের অপসারণ করায় অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা। বিশেষ করে বিভিন্ন পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলরকেন্দ্রিক সেবা কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হচ্ছে। মেয়র কাউন্সিলরদের অনুপস্থিতির কারণে প্রতিনিয়ত প্রয়োজনীয় সেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন সাধারণ মানুষ।
এদিকে, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নাগরিক সেবা কার্যক্রমে এখনো বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে নগরবাসীকে। স্থানীয় কাউন্সিলর না থাকায় কার্যক্রমে ধীরগতি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন এলাকাবাসী। তারা বলছেন, নামমাত্র একজন ওয়ার্ড সচিবকে কাউন্সিলর অফিসে বসানো হয়েছে। অফিসে বসলেও কাউন্সিলরের কোনো কাজই তিনি করতে পারেন না। একটি ফাইল তার কাছে জমা দিলে সেটা আঞ্চলিক কার্যালয় ঘুরে এসে তারপর এখানে আসে। সবাই তো জানে না যে, সরাসরি আঞ্চলিক অফিসে গেলেই এখন জন্মনিবন্ধন, মৃত্যু সনদসহ অনেক কাজ সহজে করা যায়। মৃত্যু সনদ দেয়ার সময় ওয়ার্ড সচিবরা অনেক সময় ভেরিফিকেশনের নামে কিছু টাকা চান বলেও স্থানীয়রা অভিযোগ করেন। গতকাল সরজমিন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৬২ ও ৬৩ নম্বর ওয়ার্ড ঘুুরে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নাগরিক সেবা কার্যক্রম পুরোপুরি সচল করতে হলে ওয়ার্ড পর্যায়ে আরও জনবল নিয়োগ ও সমন্বয়ের প্রয়োজন। নাগরিকদের কাগজপত্রের প্রক্রিয়া সহজ করতে ডিজিটাল সেবা বাড়ানো প্রয়োজন। একজন উপ-সচিব অনেকগুলো ওয়ার্ডের দায়িত্বপালন করছেন। যার ফলে দেখা দিচ্ছে জটিলতা। ৪০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা হাসিব হোসেন এসেছেন জন্মসনদে তার বাবার নাম সংশোধন করতে। বলেন, আমার জন্মসনদে আমার পিতার নামে সেপস না থাকায় স্থানীয় ওয়ার্ড কার্যালয় থেকে আমাকে আঞ্চলিক কার্যালয়ে পাঠিয়েছে। এখানে এসে কাগজপত্র জমা দিয়েছি। কাজগুলো সরাসরি কাউন্সিলর কার্যালয়ে করা গেলে আমাদের ভোগান্তি অনেক কমে যেতো। ৬৩ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আফতাব উদ্দিন বলেন, আগে কাউন্সিলরের সঙ্গে দেখা করে সমস্যার কথা বলা যেতো। বললে দ্রুত সমাধান হতো। এখন কাউন্সিলর নেই, একজন ওয়ার্ড সচিব আর পিয়ন শুধু বসে থাকেন।
কার্যক্রমে ধীরগতি: ঢাকা দক্ষিণ সিটির বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে দীর্ঘদিন ধরে নেই কোনো কাউন্সিলর। নাগরিক কার্যক্রমের বেশির ভাগই হচ্ছে না তদারকি। স্থানীয়রা বলছেন, সড়ক মেরামত, জলাবদ্ধতা নিরসন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নাগরিক নিরাপত্তাসহ বিভিন্ন বিষয়ে ঠিকমতো সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। যাত্রাবাড়ীর বাসিন্দা আনিছুল ইসলাম বলেন, আমাদের এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা খুবই দুর্বল হয়ে পড়েছে। আগে কোনো সমস্যা হলে কাউন্সিলরের অফিসে গিয়ে জানানো যেত। এখন তো কেউ নেই, বলারও জায়গা নেই। কাকে বলবো গিয়ে এখন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্দিষ্ট ওয়ার্ডের জনপ্রতিনিধি না থাকায় উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজও ধীরগতিতে চলছে।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়-৫ এর নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ সাখাওয়াত হোসেন সরকার মানবজমিনকে বলেন, কাউন্সিলর না থাকায় আমি ১৫টি ওয়ার্ডের দায়িত্ব পালন করছি। নাগরিক সনদ, প্রত্যয়নপত্র, জন্মসনদ ও মৃত্যু সনদ প্রদানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসে জমা দেন। ওয়ার্ড সচিব ও পিয়ন রয়েছে তারা নাগরিকদের কাছ থেকে কাগজপত্রগুলো গ্রহণ করেন। ওয়ার্ড সচিব স্বাক্ষর করার পর পিয়ন ফাইলগুলো আমাদের আঞ্চলিক অফিসে নিয়ে আসে। আমি সঙ্গে সঙ্গে স্বাক্ষর করে দেই।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন আঞ্চলিক কার্যালয়-৯ এর নির্বাহী কর্মকর্তা মামুন খন্দকার মানবজমিনকে বলেন, স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর কার্যালয়ের সচিব সেবা নিতে আসা নাগরিকদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করে আমাদের আঞ্চলিক কার্যালয়ে নিয়ে আসে। আমি স্বাক্ষর করার পর সেগুলো পুনরায় ওয়ার্ড কাউন্সিলর অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়। নাগরিকরা সেখান থেকেই তাদের সনদপত্রসমূহ গ্রহণ করেন এতে নাগরিকরা কোনো হয়রানির শিকার হচ্ছে না বলেও তিনি দাবি করেন।
এদিকে, সারা দেশে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পৌর কাউন্সিলর পদ ফিরে পেতে হাইকোর্টে রিট করেছেন। ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের সব সিটি ও পৌরসভায় মেয়রদের পাশাপাশি অপসারণ করা হয় কাউন্সিলরদেরও। এরপর থেকে ব্যাহত হচ্ছে নাগরিক সেবা। জন্মনিবন্ধন, ওয়ারিশ সার্টিফিকেট, মৃত্যু সনদ পেতে পড়তে হচ্ছে ভোগান্তিতে। এক ভুক্তভোগী বলেন, পৌরসভায় কাউন্সিলর নাই, লোকজন নাই। এ জন্য আমরা প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছি না। কাউন্সিলররা স্বতন্ত্র প্রতীকে নির্বাচিত হলেও, ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচিত অনেক চেয়ারম্যান এখনো স্বপদেই বহাল আছেন। পদ ফিরে পেতে তাই হাইকোর্টে রিট করেছেন পৌর কাউন্সিলররা। সারা দেশে কাউন্সিলর সংখ্যা ৪ হাজার। ২৬শে সেপ্টেম্বর একযোগে সব সিটি ও ৩২৩টি পৌরসভার কাউন্সিলরকে বরখাস্ত করা হয়।
পুনরাদেশ না দেয়া পর্যন্ত সিটি করপোরেশনের সার্বিক কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য ‘স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ এর ধারা ২৫ (ক) (২) মোতাবেক সরকার কর্তৃক গত ২৬শে সেপ্টেম্বর স্থানীয় সরকার বিভাগ থেকে দায়িত্ব পালনের জন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভাগুলোতে পৃথক কমিটি গঠনের আদেশ জারি করা হয়। এতে প্রশাসককে প্রধান ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে সদস্য সচিব করা হয়েছে। রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের দুই কমিটির সদস্য রাখা হয়েছে ২৫ জন করে। কমিটিতে ঢাকার বিভাগীয় কমিশনার, ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ, রাজউক, জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষসহ বিভিন্ন সেবা সংস্থার প্রতিনিধিদের রাখা হয়েছে। এসব প্রতিনিধিই কাউন্সিলর হিসেবে সেবা প্রদান করবেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। একইভাবে অন্য সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় সংখ্যাভেদে কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছে। বিভাগীয় শহর এলাকার সিটি করপোরেশন (চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, সিলেট, বরিশাল, রংপুর ও ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশ) এর জন্য ২১ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। বিভাগীয় শহরের বাইরের সিটি করপোরেশন (গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশ)- এর জন্য ১৭ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। আর পৌরসভায় জেলা সদরে ৯ সদস্যবিশিষ্ট এবং উপজেলা সদর পৌরসভায় ৭ সদস্য কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নগর উন্নয়ন অনুবিভাগ) এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের প্রশাসকের দায়িত্বে নিয়োজিত এএইচএম কামরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, এখন মানুষ সেবা পাচ্ছেন। আগের চেয়ে অনেক অভিযোগ কমেছে। আমরা সাময়িক সময়ের জন্য পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছি। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে স্থানীয় মানুষের সরাসরি যোগযোগ এবং জানাশোনা থাকে, তারা যে সেবাটা দিতে পারেন কর্মকর্তাদের পক্ষে সেটা দ্রুত দেয়া একটু কঠিন বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রশাসক নিয়োগ দেয়ার বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেনি।