
স্বল্প আয়ের মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে ভোজ্যতেল, ডাল, চিনি, ছোলা ও খেজুর বিক্রি করছে সরকারি সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। বর্তমানে সংস্থাটি স্থানের সংখ্যা ও পণ্যের পরিমাণ দুটিই উল্লেখযোগ্য হারে বাড়িয়েছে। তবে দ্বিগুণ পণ্য বিতরণ করেও টিসিবির লাইনে পণ্য কিনতে আসা মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না সংস্থাটি। প্রতিদিনই ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ সময় অপেক্ষার পর খালি হাতে ফিরে যাচ্ছে অনেক মানুষ।
টিসিবির কর্মকর্তারা জানান, আগে টিসিবি বিভাগীয় শহরে ৬০টি, ঢাকা সিটিতে ৫০টি, চট্টগ্রাম সিটিতে ২০টি মিলিয়ে ১৩০টি ট্রাকে পণ্য বিক্রি করত। বর্তমানে দেশের ৬৪ জেলাতেই টিসিবির ট্রাকে করে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। আগে প্রতি ট্রাকে পণ্য সরবরাহ করা হতো ২০০ জনের জন্য। চলতি মার্চ থেকে প্রতি ট্রাকে পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে ৪০০ ক্রেতার জন্য।
সব মিলিয়ে সারা দেশে এখন টিসিবি ৪১০টি ট্রাকে পণ্য বিক্রি করছে। এ ছাড়া এর বাইরে নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ হিসেবে ৬৩ লাখ পরিবারকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে পণ্য দিচ্ছে টিসিবি। এর পরও সুলভ মূল্যে পণ্য কিনতে আসা নিম্ন আয়ের মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না টিসিবি। দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষার পর খালি হাতেই ফিরছে অনেকে।
জানা গেছে, দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে টিসিবির পণ্য ক্রয়ের জন্য দরিদ্র, এমনকি নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষও ট্রাকের লাইনে দাঁড়াতে বাধ্য হচ্ছে। বাজার থেকে সয়াবিন তেল, ডাল, চিনি, ছোলা ও খেজুর না কিনে টিসিবির ট্রাকের লাইনে দাঁড়াচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষ। উদ্দেশ্য সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য কিনে কিছু টাকা সাশ্রয় করা। কিন্তু এই লাইন ক্রমে লম্বা হচ্ছে। নির্ধারিত স্থানে টিসিবির ট্রাক আসার তিন-চার ঘণ্টা আগে থেকেই মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে। উদ্দেশ্য সাশ্রয়ী দামে এসব পণ্য কিনে নিয়ে বাড়ি ফেরা। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এই উদ্দেশ্য সফল হচ্ছে না। লাইনে দাঁড়িয়েও পণ্য না পেয়ে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হচ্ছে অনেককে।
বর্তমানে টিসিবির ট্রাক থেকে একজন ভোক্তা সর্বোচ্চ দুই লিটার তেল (সয়াবিন বা কুঁড়ার তেল), দুই কেজি মসুর ডাল, এক কেজি চিনি, এক কেজি ছোলা ও ৫০০ গ্রাম খেজুর কিনতে পারেন। প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১০০ টাকা, প্রতি কেজি মসুর ডাল ৬০ টাকা, চিনি ৭০ টাকা, ছোলা ৬০ টাকা ও ৫০০ গ্রাম খেজুর ৭৮ টাকায় বিক্রি করা হয়। বিদ্যমান বাজারমূল্যের চেয়ে প্রায় ৪০০ টাকা কমে এসব পণ্য কিনতে পারে ক্রেতারা। তাই টিসিবির ট্রাক থেকে পণ্য কিনতে প্রতিদিন দীর্ঘ লাইন পড়ে।
গত রবিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে রাজধানীর রামপুরা বিটিভি সেন্টারের সামনে শতাধিক মানুষকে টিসিবির ট্রাক থেকে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য কেনার আশায় জড়ো হতে দেখা যায়। কিন্তু তখনো পর্যন্ত টিসিবির ট্রাকটি পণ্য নিয়ে আসেনি। অনেকে সকাল ৯টা থেকে সেখানে ট্রাকের জন্য অপেক্ষা করছিল। দুপুর ১২টা ১০ মিনিটের দিকে যখন টিসিবির ট্রাক আসে তখন মুহূর্তের মধ্যে ধাক্কাধাক্কির মাধ্যমে নারী-পুরুষ দুটি আলাদা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে যায়। এ সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষজনকে দৌড়ে এসে লাইনে দাঁড়াতে দেখা গেছে।
ট্রাকের মাধ্যমে সেখানে পণ্য বিক্রির দায়িত্বে ছিল টিসিবির ডিলার মেসার্স ফয়সাল জেনারেল স্টোর নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির বিক্রয়কর্মী রুহুল আমিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আগে ট্রাকে ২০০ জন মানুষের জন্য পণ্য দেওয়া হলেও এখন ৪০০ জনের জন্য দেওয়া হয়। এখন তেল ৮০০ লিটার, চিনি ৪০০ কেজি, ডাল ৮০০ কেজি, ছোলা ৪০০ কেজি ও খেজুর ২০০ কেজি দেওয়া হচ্ছে। পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ট্রাকের লাইনে মানুষের উপস্থিতিও আগের তুলনায় বেড়েছে। একই পরিবারের তিন-চার জন করে লাইনে দাঁড়ায়, তারা এখান থেকে পণ্য কিনে দোকানে কিছুটা লাভে বিক্রি করে দেয়। এসব চক্রের কারণে স্বল্প আয়ের অনেকে পণ্য না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
রামপুরা এলাকার গৃহিণী সালেহা খাতুন কালের কণ্ঠকে জানান, গত সপ্তাহে একদিন দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়েও তিনি পণ্য না পেয়ে ফিরে যান, যার কারণে লাইনে দাঁড়ানোর জন্য রবিবার সকাল ৯টার দিকে সেখানে আসেন। এখান থেকে পণ্য কিনলে কিছু টাকা বেঁচে যায়, যার কারণে কষ্ট হলেও সকাল সকাল চলে এসেছেন।
টিসিবির ট্রাকে পণ্যের ওজন কম দেওয়ার অভিযোগ করেছেন রামপুরার আব্দুর রাজ্জাক। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘কিছুটা কম দামে পণ্য কেনার আশায় মানুষজন ট্রাকের সামনে ভিড় করে। কিন্তু বিক্রয়কর্মীরা প্রতি কেজিতে ডাল, চিনি ও ছোলা ৫০ গ্রাম করে কম দেন।’ দুই কেজি ডাল, দুই কেজি চিনি ও এক কেজি ছোলাতেই প্রায় ২৫০ গ্রামের মতো ওজন কম দিচ্ছেন বলেও তিনি জানান। একই কথা জানান রিকশাচালক সাদিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, অন্যান্য পণ্যের মতো ৫০০ গ্রাম খেজুরে ৫০ গ্রামের মতো ওজন কম দেয় টিসিবির ডিলাররা।
একই দিনে রাজধানীর আফতাবনগর মেইন গেট ও পল্টনে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ট্রাক সেলের সামনেও একই পরিস্থিতি দেখা গেছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার কিছুটা কমে ৯.২৪ শতাংশে নেমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্যসহ সার্বিক মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রিত পর্যায়ের অনেক ওপরে। মানুষের প্রকৃত আয় বাড়ছে না। এ কারণে নিয়মিত টিসিবির ট্রাকের সামনে সুলভে পণ্য কিনতে আসা মানুষের ভিড় বাড়ছে। পণ্যের সরবরাহ বাড়িয়েও অপেক্ষমাণ মানুষের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না টিসিবি।
দ্বিগুণ পণ্য বিতরণের বিষয়ে টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘ভোক্তাদের স্বস্তি দিতে ৬৩ লাখ ফ্যামিলি কার্ডের বাইরে দেশে ৬৪ জেলায় ৪১০টি ট্রাক সেলের মাধ্যমে সুলভ মূল্যে পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। আমরা আমাদের সামর্থ্যের সবটুকু চেষ্টা করছি, যেন কেউ খালি হাতে ফিরে না যায়। টেন্ডার-প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দ্রুত পণ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে, যাতে পণ্য সরবরাহে কোনো ধরনের ব্যাঘাত না ঘটে।