Image description

পুলিশ বাহিনীতে এখনো ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দলীয় তকমা পাওয়া পুলিশেরই প্রভাব। অভিযোগ রয়েছে, বাহিনীর অন্তত ৮০ শতাংশ সদস্যই আওয়ামী লীগের সমর্থনপুষ্ট। যদিও তাঁদের কেউ কেউ বদলি ও ন্যূনতম শাস্তির আওতায় রয়েছেন, কিন্তু পুরো বাহিনীতেই তাঁদের একটি বড় অংশের দৌরাত্ম্য রয়েছে। বাহিনীর ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার, পুলিশকে পূর্ণোদ্যমে কাজে ফেরানো, বাহিনীর ভেতরে যাতে কোনো সাবোটাজ না হতে পারে সে জন্য পুলিশে শুদ্ধি অভিযান এবং একে পুরো ঢেলে সাজানোর দাবি উঠেছে। সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে পুলিশকে আওয়ামী লীগ বলয় থেকে বের করারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে।

পুলিশের সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ একটি ভার্চুয়াল মিটিংয়ে দাবি করেছেন, পুলিশের ও প্রশাসনের ৯০ শতাংশই আওয়ামী লীগের সমর্থক এবং তাঁদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। তাঁর এই বক্তব্যে তিনি জানান, সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের পরিকল্পনা চলছে এবং তাড়াতাড়ি নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। গত ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে তাঁর এই বক্তব্য ভাইরাল হয়।

এর আগে ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় চিত্রশালা মিলনায়তনে জুলাই গণ-অভ্যুত্থান নিয়ে চারটি বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল মন্তব্য করেন, বর্তমান পুলিশের ৮০ শতাংশই আওয়ামী লীগ আমলের; যাদের হৃদয়ে ছাত্রলীগ। তারা এ সরকারের জন্য কাজ করছে না।

এ দুটি ঘটনা ছাড়াও বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা, পুলিশ কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ ও বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণ করে জানা যায়, বাংলাদেশ পুলিশ এখন ক্রান্তিকাল পার করছে। বিশেষ করে জুলাই বিপ্লব ও ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ের ঘটনার পর পুলিশ বাহিনী নানা প্রশ্নের মুখে।

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা ১৫ বছরে বিভিন্ন বিতর্কিত ঘটনার পেছনে এই বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার ভূমিকা সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। এর সঙ্গে ছাত্রলীগের বিপুলসংখ্যক সাবেক নেতাকর্মী ও সমর্থকের এ বাহিনীতে নিয়োগ পাওয়ার বিষয়টিও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে। মনে করা হচ্ছে, বাহিনীতে অন্তত ৮০ শতাংশ পুলিশ সদস্য সাবেক সরকারের দল আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের দলীয় পরিচয়ে নিয়োগ পাওয়া। এর ফলে ছাত্র আন্দোলনে তাঁদের বেশির ভাগই বিতর্কিত ভূমিকা পালন করেন। এরই প্রতিফলন হিসেবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী পুলিশ বাহিনী বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার রোষানলে পড়ে। তাদের বেশির ভাগই এখনো ওই পুলিশ বাহিনীতে রয়েছে, তবে তারা এখনো স্বাভাবিক দায়িত্বে ফিরতে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, পুলিশে আওয়ামী লীগপন্থীরা ঘাপটি মেরে রয়েছে, এটা সত্যি। তাদের কাজে যথেষ্ট শিথিলতা দেখা যায়। সরকারকে সহযোগিতাকারী পুলিশের সংখ্যা তুলনামূলক কম। ফলে তাদের মধ্যে এখনো গাছাড়া ভাব রয়েছে। তিনি ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন, একসময় রাজধানীতে দেখে দেখে আওয়ামী লীগপন্থীদের বড় বড় দায়িত্বে রাখা হতো। আর বিরুদ্ধ মতের পুলিশ সদস্যদের মফস্বলে ফেলে রাখা হতো। গণ-অভ্যুত্থানের পর এই পরিস্থিতির ওলটপালট হয়েছে। ঢাকার পুলিশকে মফস্বলে আর মফস্বল থেকে ঢাকায় বদলি করা হয়েছে বেশির ভাগ পুলিশ সদস্যকে। কিন্তু যাঁদের মফস্বলে পাঠানো হয়েছে তাঁদের মধ্যে আওয়ামী লীগপন্থীই বেশি। তাঁরা কতটুকু কাজ করছেন তা সারা দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি দেখলেই অনুমান করা যায়।

তাঁর মতে হাইওয়েতে পরিবহনে ডাকাতি, বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, অপহরণ ইত্যাদি অপরাধ বাড়লেও তাঁরা মনোবলের কথা বলে হাত গুটিয়ে রেখেছেন। সরকারের এত দিন পরে এসে যাঁরা মনোবলের কথা বলে কাজ করছেন না তাঁরাই মূলত আওয়ামী লীগপন্থী। বেনজীর আহমেদের বক্তব্য সম্পর্কে এ পুলিশ কর্মকর্তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদ ডিএমপি কমিশনার ছিলেন, র‌্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন, আইজিপি ছিলেন। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে তিনি ছিলেন। তিনি তো জানবেনই কতসংখ্যক পুলিশ আওয়মী লীগের অনুসারী রয়েছে। তাঁর কথা উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। 

সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগপন্থী পুলিশ কর্মকর্তাদের বড় বড় পদে বসাতে একের পর এক ইউনিট তৈরি করেছে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, পুলিশের মূল অপারেশনাল ইউনিট রয়েছে ১৩টি। এর মধ্যে রয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর, বিশেষ শাখা (এসবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), পুলিশ টেলিকম, র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন, পুলিশ স্টাফ কলেজ, ট্যুরিস্ট পুলিশ, নৌ পুলিশ, অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটিইউ), বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, মাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) ইউনিট। জেলা পুলিশের ৬৪টি, প্রশিক্ষণকেন্দ্র ছয়টি, ইন-সার্ভিস ট্রেনিং সেন্টার ৩০টি, এপিবিএন ২০টি এবং রিজার্ভ ফোর্স আরআরএফের সাতটি ইউনিট রয়েছে। রেঞ্জ অফিসের আটটি ইউনিট, মেট্রোপলিটনের আটটি ইউনিট, হাইওয়ের ৯টি ইউনিট, রেলওয়ের সাতটি ইউনিট, শিল্পাঞ্চলের ৯টি ইউনিট, বিশেষায়িত ট্রেনিং সেন্টার ও পিএসটিএসের একটি করে দুটি ইউনিট রয়েছে। সব মিলিয়ে এখানে পুলিশের ১৭০টি ইউনিট। এর সঙ্গে মূল ১৩টি ইউনিট যোগ করলে বর্তমানে বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীতে ইউনিট রয়েছে সর্বমোট ১৮৩টি।

দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলা বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে ২০১৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর গঠন করা হয় অ্যান্টিটেররিজম ইউনিট (এটিইউ)। বেশ কিছু জঙ্গিবিরোধী অভিযান এটিইউ পরিচালনা করলেও সেগুলো নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। অনেকই মনে করে, সেগুলো ছিল সাজানো জঙ্গি নাটক। আবার অনেকের মতে, এটিইউ ছিল আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শ দমনের প্রধান হাতিয়ার।

জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার পুলিশ সংস্কারেও কাজ শুরু করেছে। এ লক্ষ্যে গঠিত সংস্কার কমিশন পুলিশকে ঢেলে সাজানোর লক্ষ্যে প্রস্তাব ও সুপারিশ তৈরি করেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করেন, পুলিশ বাহিনীকে পুরোদমে কাজে ফেরাতে হলে এবং তাদের ইমেজ পুনরুদ্ধার করতে হলে বাহিনীতে সংস্কার জরুরি। একে ঢেলে সাজাতে হবে। তা না হলে আওয়ামী লীগপন্থী পুলিশ সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগে তাঁরা আবারও যেকোনো সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারেন।