
ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটানোর জুলাই গণঅভ্যুত্থানে জীবন দিয়েছেন হাজারো নির্দোষ মানুষ। তার মধ্যে সুমাইয়া আক্তার জুলাইয়ে শহীদ হওয়া প্রথম নারী। ১৯ বছর বয়সি এই তরুণী নতুন সংসার পেতেছিলেন। কোল আলো করে এসেছে ফুটফুটে এক কন্যাসন্তান। গত ২১ জুলাই শিশুসন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে বারান্দায় এসেছিলেন হেলিকপ্টারের শব্দ শুনে। সেই হেলিকপ্টার থেকে ছোঁড়া বুলেটেই প্রাণ হারান সুমাইয়া।
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয় সুমাইয়া। করোনার সময় আর্থিক সংকটের মধ্যেই সুমাইয়ার বাবা সেলিম মাদবর মারা যান। এরপর মা আছমা বেগম সন্তানদের নিয়ে বরিশালের মেহেন্দীগঞ্জ থেকে নারায়ণগঞ্জে চলে আসেন। বড় ছেলে শাকিল গার্মেন্টে ও মেজো ছেলে সজল কার্টন ফ্যাক্টরিতে কাজ শুরু করেন। সুমাইয়া নিজেও একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তার পরিবার তিন বছরেরও বেশি সময় ধরে এ এলাকায় বসবাস করছে।
দুবছর আগে কুমিল্লার বাসিন্দা জাহিদ হোসেনের সঙ্গে বিয়ে হয় সুমাইয়ার। স্বামী সোনারগাঁয়ের কাঁচপুরে একটি পোশাক কারখানায় কর্মরত। সদ্য শুরু হওয়া সংসার নিয়ে হাজারো স্বপ্ন ছিল সুমাইয়ার। কিন্তু বিয়ের পর স্বামী ও তার পরিবারের যৌতুক নিয়ে চাপ দেওয়াসহ নানা কারণে সংসারে তেমন সুখ পাননি সুমাইয়া। সন্তান গর্ভে আসার পর নিজের শারীরিক সমস্যার কথা চিন্তা করে চাকরি ছাড়েন। গত বছরের ১২ মে একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দেন সুমাইয়া। মেয়ের নাম রাখেন সুবাইয়া। এরপর নবজাতককে নিয়ে তিনি মায়ের কাছে চলে যান। ভালো করে খাওয়া-দাওয়া করিয়ে মেয়ের স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করাতে তাকে নিজের কাছে এনে রেখেছিলেন মা আসমা বেগম। ২৭ জুলাই নিজের বাসায় ফেরার কথা ছিল সুমাইয়ার। তবে তার আগেই সেই বাড়িতে মায়ের সামনে মেয়ের মত্যু হয়।
তখন ফ্যাসিস্ট হাসিনার বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন জোরদার হচ্ছিল। ২১ জুলাই শিশুসন্তানকে ঘুম পাড়িয়ে মাত্র বসেছেন সুমাইয়া। কিন্তু জানালা দিয়ে আকাশে হেলিকপ্টার দেখে কৌতূহলবশত জানালার পাশে যান তিনি। হঠাৎ একটি শব্দ হয়; এরপরই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আসমা বেগম ভেবেছিলেন হয়তো অসুস্থতায় অচেতন হয়ে গেছে মেয়ে। কিন্তু কাছে গিয়ে দেখতে পান রক্তে ভেসে যাচ্ছে মেঝে। চেষ্টা করেও নাক-মুখ থেকে অনর্গল ছোটা রক্ত আটকানো যাচ্ছিল না। দ্রুত তাকে নিয়ে যাওয়া হয় স্থানীয় একটি হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক সুমাইয়াকে মৃত ঘোষণা করেন। পরে বোনের স্বামী বাড়ি ফিরে বারান্দার গ্রিলে বুলেট দেখতে পান, যা থেকে প্রমাণ হয় হেলিকপ্টার থেকে টার্গেট করে করা গুলিতে নিহত হন সুমাইয়া।
মাত্র ১৯ বছর বয়সি এক তরুণী যে জীবনে কখনো সুখের দেখা পায়নি, তাকে নির্মমভাবে জীবন দিতে হলো। সদ্য হওয়া সন্তানের মুখে ‘মা’ ডাক শোনার জন্য আকুল ছিলেন সুমাইয়া। নিজের মায়ের কাছে বারবার জানতে চাইতেন- কত মাস পর ‘মা’ ডাকতে পারে বাচ্চারা।
যে সন্তানকে সুস্থ করতে নিয়ে এসেছিলেন নিজের কাছে, ঘরের ভেতরে রেখেও তাকে বাঁচাতে পারলেন না মা আসমা বেগম। এখন তার সময় কাটে সুমাইয়ার সন্তানকে ঘিরে। কন্যা সুমাইয়াকে তিনি খুঁজে ফেরেন নাতনির মধ্যে।
কারো কাছে মেয়ে হত্যার বিচার চান না আসমা বেগম। আল্লাহর বিচারের অপেক্ষায় চেয়ে আছেন তিনি। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রথম নারী শহীদ সুমাইয়া। তার এবং হাজারো শহীদের রক্তে ভেজা পথ ধরে সফল হয়েছে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলন। তাদের এই ত্যাগ ধারণ করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠবে, অবসান হবে সব বৈষম্য ও বঞ্চনার-এটাই প্রত্যাশা সুমাইয়ার পরিবারের।