
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু উন্নতি করলেও এখনো এটি ব্যাপক সংস্কারের মুখাপেক্ষী। চিকিৎসকের স্বল্পতা, হাসপাতালগুলোর অতিরিক্ত চাপ, এবং ব্যয়বহুল চিকিৎসার কারণে কোটি কোটি মানুষ এখনো মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) তাদের ৩১-দফা কাঠামোগত সংস্কার পরিকল্পনার আওতায় একটি যুগান্তকারী প্রস্তাব উত্থাপন করেছে: যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস (এনএইচএস) মডেল থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে বাংলাদেশের জন্য একটি সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। এই সাহসী উদ্যোগ বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাকে সবার জন্য সহজলভ্য, সাশ্রয়ী এবং সমতার ভিত্তিতে নিশ্চিত করতে পারে।
এনএইচএস-এর মূল দর্শন হলো সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা, যেখানে প্রত্যেক নাগরিক, তার আর্থিক বা সামাজিক অবস্থান যাই হোক না কেন, মানসম্মত চিকিৎসা সেবা পায়। বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত হলে এটি এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আনতে পারে। বর্তমানে, প্রতি ১০,০০০ জন মানুষের জন্য মাত্র সাতজন চিকিৎসক রয়েছেন, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রস্তাবিত ২২.৮ চিকিৎসকের তুলনায় অনেক কম। বিএনপি প্রস্তাবিত “হেলথ কার্ড” চালু করা হলে দেশের প্রতিটি নাগরিক বিনামূল্যে প্রাথমিক চিকিৎসা সুবিধা গ্রহণ করতে পারবেন। বর্তমানে, দেশের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের ৭৪% রোগীদের নিজেদের পকেট থেকে বহন করতে হয়। এই ব্যবস্থা চালু হলে নিম্নবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এটি বিশাল স্বস্তি নিয়ে আসবে, কারণ তারা আর চিকিৎসা খরচের চিন্তায় চিকিৎসা সেবা গ্রহণে পিছপা হবেন না।
এনএইচএস-এর আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো এর অর্থায়নের কাঠামো। এটি সাধারণ জনগণের করের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা নাগরিকদের পৃথক চিকিৎসা ব্যয় বহন থেকে মুক্তি দেয়। বাংলাদেশেও যদি এই ব্যবস্থা গৃহীত হয়, তবে নাগরিকদের প্রত্যেকটি চিকিৎসা সেবার জন্য পৃথকভাবে অর্থ ব্যয় করতে হবে না। বিএনপি তাদের পরিকল্পনায় মোট দেশজ উৎপাদনের (GDP) ৫% স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ দেওয়ার কথা বলেছে। পর্যাপ্ত অর্থায়ন নিশ্চিত করা হলে দেশের হাসপাতালগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়ন, চিকিৎসা কর্মী নিয়োগ, এবং আধুনিক চিকিৎসা সরঞ্জাম সংযোজন সম্ভব হবে। একইসাথে, সরকারি পর্যায়ে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাবে।
যুক্তরাজ্যের এনএইচএস মডেলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যসেবাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, যাতে মানুষ সহজে ও স্বল্পব্যয়ে চিকিৎসা সেবা পায় এবং তৃতীয় স্তরের বিশেষায়িত হাসপাতালে রোগীর চাপ কমে। কিন্তু বাংলাদেশে এই ব্যবস্থা অনুপস্থিত, যার ফলে মানুষ সরাসরি বড় হাসপাতালগুলোতে ছুটে যায় এবং দীর্ঘ অপেক্ষার সম্মুখীন হয়। বিএনপি এই সংকট নিরসনে প্রতিটি অঞ্চলে অত্যাধুনিক প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা করেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষ সহজেই চিকিৎসাসেবা পাবে এবং হাসপাতালের উপর চাপ কমবে। এছাড়া, এই ব্যবস্থা চালু হলে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, মানসিক স্বাস্থ্যসহ বিভিন্ন রোগের আগাম শনাক্তকরণ ও প্রতিরোধ সম্ভব হবে।
এনএইচএস-এর অন্যতম সফল দিক হলো রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা। বাংলাদেশে সাধারণত রোগ নিরাময়ের দিকে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়, যা ব্যয়বহুল এবং দীর্ঘমেয়াদি সমস্যার সৃষ্টি করে। তবে এনএইচএস প্রতিরোধমূলক চিকিৎসার ওপর গুরুত্ব দেয়, যেমন টিকাদান কর্মসূচি, স্বাস্থ্য পরীক্ষা, এবং জনসচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন। বিএনপি এই ধরনের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে চায়, যাতে সাধারণ মানুষ স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করতে পারে এবং রোগের প্রকোপ কমে।
স্বাস্থ্যসেবায় আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এনএইচএস-এর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যুক্তরাজ্যে ইলেকট্রনিক হেলথ রেকর্ডস (EHR) ব্যবহার করা হয়, যা চিকিৎসকদের দ্রুত রোগীর তথ্য পেতে এবং নির্ভুল চিকিৎসা প্রদান করতে সহায়তা করে। বাংলাদেশেও যদি বিএনপির প্রস্তাবিত ডিজিটাল স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু করা হয়, তবে রোগীর তথ্য সংরক্ষণ, চিকিৎসা পরিকল্পনা, এবং সঠিক রোগ নির্ণয়ে এটি অত্যন্ত কার্যকর হবে।
বাংলাদেশে অনিয়ন্ত্রিত ওষুধের দোকান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার একটি বড় সমস্যা। অনেক সময় ভেজাল ওষুধ এবং ভুল পরীক্ষার রিপোর্টের কারণে রোগীরা মারাত্মক বিপদের সম্মুখীন হয়। এনএইচএস-এর মতো কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হলে এ ধরনের অনিয়ম রোধ করা সম্ভব হবে। বিএনপির পরিকল্পনায় ওষুধের দোকান ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোর যথাযথ লাইসেন্সিং ও তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে, যা জনগণের জন্য নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করবে।
এনএইচএস মডেলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জন্য বিশেষ সুবিধা। বিএনপি তাদের পরিকল্পনায় নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলেছে, যাতে তারা অর্থের অভাবে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত না হয়।
বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবাকে যুগোপযোগী করতে বিএনপির এই পরিকল্পনা অত্যন্ত যুগান্তকারী। এটি কেবল রোগীদের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়নের জন্যও অত্যন্ত কার্যকরী একটি পদক্ষেপ। সার্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, প্রাথমিক ও প্রতিরোধমূলক চিকিৎসা ব্যবস্থাকে জোরদার করা, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা চালু করা এবং ওষুধের মান নিয়ন্ত্রণে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি আধুনিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার দিকে এগিয়ে যেতে পারে।
এই পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করতে হলে যথাযথ অর্থায়ন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতি প্রয়োজন। তবে যদি এটি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তাহলে বাংলাদেশ একটি স্বাস্থ্যকর, সমৃদ্ধ ও উন্নত ভবিষ্যতের পথে এগিয়ে যাবে। বিএনপি শুধুমাত্র একটি নতুন স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা প্রস্তাব করছে না, বরং একটি সুস্থ, শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ গড়ার ভিত্তি স্থাপন করছে। এখনই সময়—আগামীর বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবার রূপরেখা বাস্তবায়নের।