Image description

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যায়। পতন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের। রাজনৈতিক পট-পরিবর্তনের পর ১২ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) নতুন উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে নিয়োগ পান বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণ বিভাগের অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ। সম্প্রতি (১২ মার্চ) তার উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্ব পালনের ৬ মাস পূর্ণ হয়েছে।

এ উপলক্ষ্যে নিজের অভিজ্ঞতা, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তি, বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে আগামীর পরিকল্পনা প্রভৃতি বিষয়ে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের সঙ্গে নিজ কার্যালয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হেড অব নিউজ ইরফান এইচ সায়েম—

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: গত ৬ মাসে আপনি তিন দেশ সফর করেছেন। শিক্ষা ও গবেষণায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক কতটুকু বেড়েছে?

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ: গত ৬ মাসে ইন্টারন্যাশনাল আউটপুট বাড়ানোর জন্য কাজ করেছি। এর অংশ হিসেবে বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমরা নেটওয়ার্কিং করেছি। সেটা দুইভাবে— প্রথমত ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে ডিগ্রি এবং গবেষণা কার্যক্রম শুরু করা। আরেকটা হচ্ছে— শিক্ষক ও শিক্ষার্থী বিনিময়।

গত নভেম্বরে নাইজেরিয়ার লরিন বিশ্ববিদ্যালয়ে ডি-৮ এর কনফারেন্সে অংশ নিয়ে একটি ইন্টারন্যাশনাল সম্পর্ক তৈরি করতে পেরেছি। এতে সবচেয়ে বড় কাজটি হবে র‍্যাংকিং করার সময়। ডি-৮ ভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের যে নেটওয়ার্কিং হবে, সেটি সেখানে কাজে দেবে।

এরপর চীনে গিয়েছি। সেখানে ব্লু ইকোনোমি ও ওশিয়ানোগ্রাফি নিয়ে একটি কনফারেন্সে অংশ নিয়েছি। ওখানে দুটি কাজ হয়েছে। প্রথমত, জাপানিজ গভর্মেন্ট ফার্স্ট ইনস্টিটিউট অব ওশিয়ানোগ্রাফির অর্থায়নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ওশিয়ানোগ্রাফির উপর গবেষণা প্রতিষ্ঠান করতে চায়। এটা নিয়ে সেখানে একটি সভা হয়েছে ঢাবি ও ফার্স্ট ইনস্টিটিউট অব ওশিয়ানোগ্রাফির সঙ্গে। সভায় একটি প্রজেক্ট ডিজাইন করেছি। এখন সেটা পাঠানো হবে আমাদের সরকারের এক্সটার্নাল রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্টে। সেখান থেকে জাপানিজ অ্যাম্বাসিতে পাঠানো হবে। তারা সেটা চীনে পাঠালে প্রজেক্টটি তখন ফাইনাল হবে। দ্বিতীয়ত, ব্লু ইকোনোমিকে এখন সবাই খুবই গুরুত্ব দিচ্ছে। আমাদের যেমন মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় করছি, ওরা ওশিয়ানোগ্রাফিকে কেন্দ্র করে অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় করছে। আমরা সেই ওশিয়ানোগ্রাফি রিলেটেড বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে এমওইউ করার প্রস্তাব করেছি। এছাড়া কুনমিং বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে একটি এমওইউ করার উদ্যোগ নিয়েছি। এর অধীনে দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ক্যান্সার সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা হবে। এটা অর্থায়ন করবে জাপান সরকার।

সর্বশেষ জাপানে গিয়েও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। দেশটির কোবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিম্পোজিয়ামটি আমি মনে করি সবচেয়ে ফলপ্রসূ প্রোগ্রাম। এ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর যদি করতে পারি তাহলে এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি মাইলফলক হবে। এর মাধ্যমে ঢাবির সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল প্রেজেন্স হবে কোবে বিশ্ববিদ্যালয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মধ্যে। উদাহরণ হিসেবে তিন বছরের পিএইচডি প্রোগ্রামের আওতায় বিশ্ব ব্যাংকের কাউকে যদি আমরা এখানে নিয়ে এসে পড়াই। সেক্ষেত্রে আমাদের মর্যাদা বাড়বে। ঠিক তেমনি জাপান থেকে মাস্টার্স লেভেলের একজন ছাত্র সেখানে এক বছর এবং আমাদের এখানে এসে এক বছর পড়বে। সেক্ষেত্রে আমাদের মর্যাদা বাড়বে, পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল প্রেজেন্সও বাড়বে। আমাদের শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রেও তাই। 

এই ৬ মাসে আমি এতটুকু উন্নতি করতে পেরেছি। এটা তো মাত্র শুরু করেছি। তবে সফলতার সঙ্গে সব করেছি, বিষয়টি এমন না। আমরা শুরু করেছি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্কিংটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। আমাদের যে বৈশ্বিক র‍্যাংকিং, সেখানে এসব কাজ আমাদেরকে এগিয়ে রাখবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: একসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণের অভিযোগ উঠতো। গণমাধ্যমেও বিষয়টি নিয়ে লেখালেখি হতো। বর্তমানে আপনি তো শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের প্রধান। এক্ষেত্রে বর্তমান প্রশাসন কেমন ভূমিকা পালন করবে?

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ: প্রথমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের একটা নীতিমালা রয়েছে। সেখানে যা যা আছে তা খুব কঠোরভাবে পালন করছে বর্তমান প্রশাসন। যেন একমাত্র মেধাবীরাই শিক্ষকতায় আসতে পারে। এখানে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বা স্বেচ্ছাচারিতার কোনো সুযোগ রাখা হয়নি। দ্বিতীয়ত শিক্ষক নীতিমালা যদি আমাদের পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় তা করার উদ্যোগ নেওয়া।

আমরা শিক্ষক নিয়োগের এই নীতিমালাকে আরও যুগোপযোগী করার জন্য একটি কমিটি করেছি। এই কমিটিতে আমি থাকবো না। কারণ যে নীতিমালা আমি প্রয়োগ করবো সে নীতিমালা তৈরির কমিটিতে আমি থাকলে সেটি সাংঘর্ষিক হবে। একাডেমিক কাউন্সিলের সবাই আমাকে থাকার অনুরোধ করলেও আমি না করেছি। নিরপেক্ষ কাউকে দিয়ে এ নীতিমালা তৈরি করতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শুধু সিজিপিএ দেখে কী শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়? নিয়োগের ক্ষেত্রে আর কোন কোন বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন?

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ: শিক্ষক সিলেকশন প্রসেসের সময় ভাইভা বোর্ডে চেয়ার হিসেবে আমি থাকি। আর বোর্ডে সদস্য থাকেন তারা— সংশ্লিষ্ট ডিন, বিভাগের চেয়ারম্যান, একজন সিন্ডিকেট সদস্য এবং একজন সাবজেক্ট এক্সপার্ট। আমি প্রথমেই কমিটিকে বলে দেই আমরা মেধার ভিত্তিতে সব প্রসেস সম্পন্ন করবো এবং পরবর্তীতে এর ভিত্তিতেই শিক্ষক হিসেবে সুপারিশ করবো।

প্রথমত, মেধা এবং যোগ্যতার বাইরে অন্য কোনোকিছু আমি বিবেচনা করবো না। দ্বিতীয়ত আরেকটা কথা বলবো যে, শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে মেধাই একমাত্র যোগ্যতা না। এর পাশাপাশি অতিরিক্ত কিছু যোগ্যতা থাকতে হবে। সেটা হলো প্রার্থীর সততা থাকতে হবে, ন্যায়পরায়ণতা থাকতে হবে এবং প্রার্থীকে ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ হতে হবে। আরেকটা হলো— বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক হওয়ার যে চারিত্রিক গুণাবলি প্রয়োজন সেটা তার মধ্যে থাকতে হবে। শিক্ষক নিয়োগের প্রত্যেকটি সিলেকশন বোর্ডে আমি এই চারটি কথা বলে দেই।

একজন শিক্ষার্থী মেধাবী কিনা এটা তার সিজিপিএ দেখে হয়ত জানা যাবে। তবে তার চারিত্রিক গুণাবলি কেমন অথবা সে কতটা সৎ এটা ৫ মিনিট ভাইভা নিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সিলেকশন প্রসেসের সময় আমি সংশ্লিষ্ট বিভাগের শিক্ষকদের কাছে জানতে চাই। কারণ তারা একটা লম্বা সময় ওই শিক্ষার্থীকে পড়িয়েছেন। সবার মতামতের ভিত্তিতে যারা যোগ্য তাদের আমরা সুপারিশ করি। আমরা সুপারিশ করলেই যে নিয়োগ হয়ে যায় বিষয়টি এমন নয়। এই সুপারিশ সিন্ডিকেটে যায়। তারপরেও কিছু সমস্যা থেকে যায়। আমি চাই না কোনো অসৎ ও ইন্টিগ্রিটিবিহীন যার কোনো ব্যক্তিত্ব নেই এরকম মানুষ শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান, অন্তত আমি যতক্ষণ উপ উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে দায়িত্বে আছি।

এ বিষয়টি মাথায় রেখে আমি সিন্ডিকেটে দুইটি প্রস্তাব রেখেছি। প্রথমত. আমরা একটা কমিটি করতে পারি যে কমিটি নিয়োগ প্রক্রিয়াধীন বা সুপারিশপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তির নামে যদি অভিযোগ আসে তা যাচাই-বাছাই এবং অনুসন্ধান করে একটা সিদ্ধান্তে আসবে। আমরা চাই মেধাবী ব্যক্তিরা এখান আসুক আবার এই প্রক্রিয়ায় কেউ হয়রানির শিকার হোক তা যেন না হয়। দ্বিতীয়ত. নিয়োগের সময় নিয়োগপ্রাপ্ত ব্যক্তি অঙ্গীকার করবে যে ‘আমি কখনও কোনো নিষিদ্ধ সংগঠনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না অথবা রাষ্ট্র ও সরকারের বিরুদ্ধে এবং নৈতিকতা বিবর্জিত কোনো কাজ করবো না’। যদি ভবিষ্যতে কখনও এই প্রত্যয়ন ভুল প্রমাণিত হয় তাহলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে।

এ সবকিছু করার মূল কারণই হচ্ছে আমাদের করা নিয়োগ প্রক্রিয়া খুব স্বচ্ছতার সাথে যেন হয়। কোনোভাবে যেন কোনো বাজে মানুষ বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ না পেতে পারেন। তার সমস্ত ব্যবস্থা তৈরি করছি। এর বাইরে আমরা বর্তমান যে নীতিমালা তার উন্নয়ন করার জন্য কমিটি করেছি।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে এগিয়ে নিতে বর্তমান প্রশাসন কি উদ্যোগ হাতে নিয়েছে? 

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ: বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) হিসেবে আমি র‍্যাংকিং কমিটির প্রধান। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এই ৬ মাসে ইন্টারন্যাশনাল প্রেজেন্স বাড়িয়েছি। কেননা বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে বিষয়টির গুরুত্ব অনেক। তবে বৈশ্বিক র‍্যাংকিংয়ে অনেকগুলো ফ্যাক্টর কাজ করে। একটা হলো ইন্টারন্যাশনাল আউটপুট। এর আবার দুইটা প্রেক্ষিত রয়েছে। এক হলো রিসার্চ আর স্টুডেন্ট— এজন্য আমরা একটা ইন্টারন্যাশনাল অফিস তৈরি করেছি। দুই হলো ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট— বিদেশ থেকে যেন আমাদের এখানে বেশি পরিমাণে শিক্ষার্থী আসে এবং আমাদের শিক্ষার্থীরা যেন সহজেই বাইরে যেতে পারে। এর মাঝে যত বাঁধা আছে সেগুলো দূর করার চেষ্টা করছি। 

আমাদের শিক্ষার্থীদের বিদেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে একটা প্রতিবন্ধকতা হলো— আমরা ওপেন ক্রেডিট সিস্টেমে নাই। আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি এবং প্ল্যান করছি। ইতোমধ্যে পেপার তৈরি করেছি যা নিয়ে ডিনস কমিটিতে এবং সিন্ডিকেট মিটিংয়ে আলোচনা হবে। এটা করা গেলে আমাদের শিক্ষার্থীদের এক্সচেঞ্জ বাড়বে এবং ইন্টারন্যাশনাল আউটপুটও বাড়বে। 

একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম খুব গুরুত্বপূর্ণ। এখানে একটা স্মার্ট আউটলুক থাকতে হয়। ভর্তির দিন থেকে শুরু করে সার্টিফিকেট পাওয়া পর্যন্ত প্রশাসনিক ব্যবস্থাটা কেমন তা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। আমাদের এদিকে উন্নতি করার দরকার আছে। এটার উন্নয়নে আমরা বেশ কিছু পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছি। আমরা এ পুরো প্রক্রিয়াকে অনলাইনভিত্তিক করতে চাই। আমাদের আইসিটি সেল এ বিষয় নিয়ে কাজ করছে। তারা পরিকল্পনা সাজাচ্ছেন। 

আরেকটা বিষয় হলো রিসার্চ। এটা আমরা কয়েকভাবে বাড়াতে পারি। একটা হলো জয়েন্ট রিসার্চ, আরেকটা হলো রিসার্চ ফান্ডিং জোগাড় করে দেওয়া। 

র‍্যাংকিং কমিটির অফিস থেকে সব ফ্যাকাল্টিতে যোগাযোগ অব্যাহত রাখা হয়েছে। আমরা বোঝার চেষ্টা করছি যে কোন কোন জায়গায় আমাদের প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। কিছু কিছু প্রতিবন্ধকতা হয় সেল্ফ সোর্সিংয়ের অভাবে আর কিছু আছে এনকারেজমেন্টের অভাবে। এই লিমিটেড রিসোর্সই অপটিমাম ইউজ করে এনকারেজমেন্টের পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এজন্য আমরা প্রত্যেক ফ্যাকাল্টিতে শিক্ষকদের নিয়ে মিটিং করেছি। গবেষণা এবং শিক্ষার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা আছে তা চিহ্নিত করে এর সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করছি। এছাড়াও আমাদের একটি ব্র্যান্ডিং কমিটি রয়েছে। আমরা দেশের এক নম্বর বিশ্ববিদ্যালয় আমাদের একটি ব্র্যান্ডিং থাকা উচিত। বছরব্যাপী আমরা যেসব কার্যক্রম করি তা সবাইকে জানানো উচিত। 

আমাদের বুঝতে হবে র‍্যাংকিং নির্ভর করে অনেকগুলো বিষয়ের ওপর। এখানে টিচিং গুরুত্বপূর্ণ, রিসার্চ গুরুত্বপূর্ণ, স্মার্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম আবার ইন্টারন্যাশনাল আউটপুটও গুরুত্বপূর্ণ। এর বাইরেও আরও অনেক বিষয় আছে। অ্যালামনাইদের সাথে আমরা প্রোডাক্টিভভাবে কাজ করতে চাই। র‍্যাংকিংয়ের সাথে জড়িত যেসব বিষয় রয়েছে প্রত্যেকটির জন্য আমাদের আলাদা আলাদা কমিটি রয়েছে। এই কমিটিগুলোর কাজ আশা করছি এই রোজার মধ্যেই গুছিয়ে আনতে পারবো।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: গত ১৫ বছরে ক্যাম্পাসের অনেক শিক্ষক প্রতিহিংসার শিকার হয়েছেন, অনেকেই একাডেমিক কার্যক্রমের বাহিরে ছিলেন। এখন তারা ফের একাডেমিক কার্যক্রমে ফিরতে চাচ্ছেন। আবার ৫ আগস্টের পর অনেক আওয়ামীপন্থী শিক্ষককে একাডেমিক কার্যক্রমে শিক্ষার্থীরা চাচ্ছেন না। তাদের অনেককেই একাডেমিক কার্যক্রম থেকে বিরত রাখাও হয়েছে। তাদের নিয়ে প্রশাসনের অবস্থান কি?

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ: এটা সত্য যে গত ১৫ বছরে অনেক শিক্ষক অনেকভাবে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন। তাদের মধ্যে কেউ চাকরিচ্যুত হয়েছেন, কেউ পদোন্নতিতে বৈষম্যের শিকার হয়েছেন। তারা যদি প্রশাসন বরাবর আবেদন করেন সেক্ষেত্রে আমাদের একটা কমিটি করা আছে। সে কমিটি এগুলো যাচাই-বাছাই করে সত্যতা পেলে, আবেদনকারী যদি প্রাপ্য হন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তা করবে। এটার একটা প্রক্রিয়া আছে, সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে ভুক্তভোগী শিক্ষকরা সহযোগিতা চাইতে পারেন। 

এটাও সত্য যে, বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক গত ১৫ বছরে অনেক কাজকর্ম করেছেন যা শিক্ষক সুলভ না। এর ফলে ওই শিক্ষক ব্যক্তিগতভাবে যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তেমন আমাদের শিক্ষক সমাজকে কলুষিত করেছেন। পাশাপাশি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কলুষিত করেছেন। এসব শিক্ষকদের বিষয়ে কী করা যায় এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আবার অন্যায়ভাবে কাউকে অপ্রয়োজনীয় ভিক্টিমাইজ করে তার ক্যারিয়ার ধ্বংস করা আরেক ধরনের অন্যায়। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কালেক্টিভ চিন্তা রয়েছে। এটা নিয়ে এখনও কংক্রিট কোনো আলোচনা সিন্ডিকেটে আসেনি। 

তবে আমার ব্যক্তিগত চিন্তা হচ্ছে, এটা সত্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষক অপরাধ করেছেন যা দেশের প্রচলিত আইনেই অপরাধ এবং নৈতিকতার দিক থেকে তো অবশ্যই এদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। দেশের প্রচলিত আইন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন যথাযথ অনুসরণ করে তাকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং যত দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করা যায় তত আমাদের জন্য ভালো হবে। তাদের শাস্তি নিশ্চিত করা গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে বাকি যারা আছেন তারা কেউ আগামীতে অশিক্ষক সুলভ আচরণ আর করবেন না। এতে শিক্ষার যে সুষ্ঠু পরিবেশ তা নষ্ট হবে না। 

সত্যিকার অর্থে যারা অপরাধী তাদের শাস্তি দিতে চায় এই প্রশাসন। বাকি যারা আছেন তাদের নিরপরাধ মনে করতে চাই এবং তাদের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক কীভাবে উন্নয়ন করা যায় এবং শিক্ষাবান্ধব পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা যায় সেটা হলো গুরুত্বপূর্ণ। ফলে তাদের বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গি কী সেটা আলোচনা করে জানাতে হবে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: শিক্ষক রাজনীতি নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা হয়। রাজনীতিতে কত শতাংশ শিক্ষক জড়িত রয়েছে?

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট দুই হাজার থেকে ২২০০ শিক্ষক রয়েছে। এর মধ্যে ক্যাম্পাসে রয়েছেন ১৫শ থেকে ১৭শ শিক্ষক। বাকি ৪০০-৫০০ শিক্ষক শিক্ষা ছুটিতে বিদেশে আছেন। ক্যাম্পাসে থাকা শিক্ষকদের মধ্যে ৫০ শতাংশের মতো পিএইচডিধারী। এ পরিমাণ মেধাবী স্কলার দেশের অন্যকোনো প্রতিষ্ঠানে আছে? যাদের প্রত্যেকে ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও জাপানের মতো উন্নত দেশগুলো থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। তাদের মধ্য থেকে ১০ শতাংশ শিক্ষক সরাসরি শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বাকি ৯০ শতাংশ শিক্ষকই পঠন-পাঠন, গবেষণা, একাডেমিক কার্যক্রমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকতে চান। হাতেগোনা কয়েকজনকে পাবেন যারা এক্টিভিজম করে। 

কিন্তু এই এক্টিভিজম যারা করেন তাদের কাজই সমাজে ও গণমাধ্যমে সবচেয়ে বেশি প্রচারিত এবং প্রসারিত হয়। এদিকে বাকি ৯০ শতাংশ শিক্ষক যে এতো শিক্ষা ও গবেষণায় ডেডিকেটেড তাদের কথাটা তো আর আসে না। আমাদের একজন শিক্ষক যখন আমেরিকা বা ইউরোপে যায়, তখন তিনি সবচেয়ে ভালো পাবলিকেশনে লেখা পাবলিশ করেন। তার আন্তর্জাতিক খ্যাতি হয়। ক্যাম্পাসে ফিরে আসার পর আমি তাকে সে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারি না, সে পরিমাণে তাকে ব্যবহার করতে পারি না। 

এখন সময় এসেছে তাদের নিয়ে কথা বলার। তাদের কীভাবে আরও প্রোডাক্টিভ করতে পারি। তাছাড়া আমাদের যে ১০ শতাংশ শিক্ষক রাজনীতির সঙ্গে জড়িত তাদের মধ্যেও খারাপভাবে জড়িতদের সংখ্যা খুব কম। অনেকেই আছেন ইতিবাচকভাবে জড়িত। তাদের তো আলোচনায় দেখি না, আলোচনায় আসে যারা নোংরাভাবে জড়িত তারা। এই আলোচনার নিচে আমাদের যে এতো এতো রিসোর্স পার্সন আছে তা চাপা পড়ে আছে।

দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস: আপনি তো সাত কলেজের প্রধান সমন্বয়কের দায়িত্বে ছিলেন। এসব কলেজ আর ঢাবির অধিভুক্ত থাকছে না। সর্বশেষ কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন? 

অধ্যাপক ড. মামুন আহমেদ: সাত কলেজের সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হলো অধিভুক্তি থাকছে না। তবে এটা বাস্তবায়নে একটি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় সেই প্রক্রিয়া শুরু করেছে, সরকারের সাথে আলোচনা করছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, সাত কলেজের সমস্যাটা শুধুমাত্র তৈরি হয়েছে তখনকার যারা সরকারে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে ছিলেন তাদের অপরিণামদর্শী আচরণের কারণে। এর খারাপ ফলাফল এখন আমাদের ভোগ করতে হচ্ছে। এটার একটা সমাধান হওয়া প্রয়োজন। 

আমাদের প্রথমে মনে রাখতে হবে, সাত কলেজের বর্তমান শিক্ষার্থী যারা তাদের স্বার্থ। পাশাপাশি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বার্থও রক্ষা করতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার যে মান সেটি রক্ষার বিষয়টি আমাদের মাথায় রাখতে হবে। সরকারের রাজনৈতিক সীমাবদ্ধতা থাকে। রাস্তায় আন্দোলন হলে সরকারকে বিব্রতকর অবস্থায় পড়তে হয়। আমাদের এসব বিষয়ও মাথায় রাখতে হয়।