Image description

ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় উচ্চাভিলাষী, অতিমাত্রায় অপেশাদার পুলিশ সদস্যদের বিধিবহির্ভূত বলপ্রয়োগের কারণে ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশে নিয়োগ ও প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এসব বিষয়ে পুলিশের পলিসি গ্রুপে একাধিক সভা হয়েছে। এসব সভায় পুলিশের নিয়োগ বিধি ও প্রশিক্ষণে ব্যাপক ইতিবাচক পরিবর্তন করা হয়েছে। পাশাপাশি পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে বলপ্রয়োগ পদ্ধতি, অপারেশনাল অভিযানসহ বিভিন্ন ইস্যুতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হয়েছে। সব মিলিয়ে পেশাদারিত্ব ফিরে এসেছে বাংলাদেশ পুলিশে। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা ও বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ থেকে এসব তথ্য জানা গেছে।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের পুরো সময়ে কিছু অতি অপেশাদার কর্মকর্তার কারণে পুলিশ একটি দলীয় বাহিনীতে পরিণত হয়। নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতি-পদায়ন থেকে শুরু করে কেনাকাটা—সবকিছুই করা হতো দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে। বর্তমান প্রশাসন এসব অনিয়ম থেকে বেরিয়ে পুলিশ বাহিনীকে সত্যিকারের বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে। সংস্কারের কমিটির সুপারিশের আলোকে বেশকিছু সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছে।

পুলিশের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় পুলিশ। টানা কয়েক সপ্তাহ কার্যত পুলিশের কোনো কার্যক্রমই ছিল না। ধীরে ধীরে সে অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটেছে। এখন তদন্ত ও অপারেশনাল কার্যক্রম জোরদারের পাশাপাশি পুলিশের নিয়োগ, পদায়ন, পদোন্নতিসহ কাঠামোগত উন্নয়নেও নানা কাজ চলছে।’

পুলিশ সূত্রের খবর, গত ৫ আগস্টের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার শুরুর দিকে বিভিন্ন থানা ও ইউনিটে তাড়াহুড়া করে অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ও পরিদর্শক পদায়ন দিতে হয়েছে। তবে এখন থানাগুলোতে যোগ্যতার ভিত্তিতে ওসি ও বিভিন্ন পদে পরিদর্শক পদায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পরিদর্শক পদায়নের জন্য এরই মধ্যে নীতিমালা তৈরি করা হচ্ছে। এ নিয়ে সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের ‘পলিসি গ্রুপে’র সভা হয়েছে। এই পলিসি গ্রুপের প্রধান থাকেন পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি)। এতে বিভিন্ন বিভাগ ও ইউনিটের অতিরিক্ত আইজিপিরা সদস্য থাকেন। এই পলিসি গ্রুপ পুলিশের অভ্যন্তরীণ নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেন এবং তা বাস্তবায়ন করেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পলিসি গ্রুপের সভায় সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) পদে সরাসরি নিয়োগ দেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। যদিও বর্তমানে কনস্টেবল ও নায়েক থেকে পদোন্নতি পেয়ে এএসআই হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

পলিসি গ্রুপের বৈঠক সূত্র জানায়, পুলিশ রেগুলেশনস ১৯৪৩-এর প্রবিধান-৭৪৩-এ বিদ্যমান নিয়মে এএসআই পদে সরাসরি নিয়োগের সুযোগ রয়েছে। তবে এএসআই পদে সরাসরি নিয়োগের জন্য বর্তমানে শূন্য পদ না থাকায় পদ সৃজনের বিষয়টি সামনে এসেছে। এজন্য ওই পদে সরাসরি নিয়োগের সুবিধার্থে প্রতি বছর কমপক্ষে ৭ থেকে ৮ হাজার পদ সৃজন করার বিষয়টি আলোচনায় উঠে আসে। তবে এ ক্ষেত্রে বিদ্যমান নিয়মে বিভাগীয় পদোন্নতি পরীক্ষার মাধ্যমে কনস্টেবল বা নায়েক থেকে পদোন্নতি দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো অন্তরায় না হয়, সে বিষয়সহ সংশ্লিষ্ট নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।

একজন কর্মকর্তা জানান, এএসআই পদে সরাসরি নিয়োগ পদ্ধতির প্রচলন করা হলে বিদ্যমান এসআই (নিরস্ত্র) পদে সরাসরি নিয়োগ পদ্ধতি পর্যায়ক্রমে বাতিল করা যেতে পারে। কারণ এএসআই এবং এসআই পদ দুটি সাংগঠনিক কাঠামোতে পাশাপাশি থাকায় অবস্থানগত কারণে এসআই পদটি শতভাগ পদোন্নতিযোগ্য পদ করা যেতে পারে বলেও আলোচনা হয়।

পুলিশ সদর দপ্তরের রিক্রুটমেন্ট অ্যান্ড কেরিয়ার প্ল্যানিং (আরঅ্যান্ডপি-১) বিভাগের অতিরিক্ত ডিআইজি সারোয়ার মুর্শেদ শামীম কালবেলাকে বলেন, ‘এএসআই পদে সরাসরি নিয়োগের বিষয়টি একেবারে প্রাথমিক আলোচনার পর্যায়ে রয়েছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে পুলিশের অভ্যন্তরীণ মাঠ পর্যায়ে মতামত নিচ্ছি।’

পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, বাস্তবতার নিরিখে পুলিশে নানা সময়ে পরিবর্তন এসেছে। বাহিনীতে কাঠামোগত পরিবর্তনের ক্ষেত্রে নানা স্তর পার করতে হয়। এএসআইর নতুন পদ সৃষ্টি করতে হলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, বাস্তবায়ন অনুবিভাগসহ প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটির অনুমোদন লাগবে। পুলিশ রেগুলেশনস, ১৯৪৩ এর সংশ্লিষ্ট প্রবিধানগুলো অধিকতর সংশোধনের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয় এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হবে। তাই এটি সময়সাপেক্ষ বিষয়। তবে পুলিশ বাহিনীকে ঘুরে দাঁড়াতে কাঠামোগত নানা পরিবর্তনের বিষয়ে আলোচনা চলছে।

পুলিশ সূত্র জানায়, পুলিশ সংস্কার কমিশন থেকে পাওয়া নানা প্রস্তাব নিয়েও পুলিশ বিভাগ কাজ করছে। এরই মধ্যে সরকার পুলিশ বাহিনীর ইউনিফর্ম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছে। চলমান কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রেও বড় ধরনের নীতিগত পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত এসেছে সরকারের কাছ থেকে। বাস্তবতার নিরিখে কনস্টেবল নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের সময় কমানোর জন্য পুলিশ সদর দপ্তর থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দেওয়া হয়। সম্প্রতি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করে কনস্টেবল পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে ছয় মাসের প্রশিক্ষণের পরিবর্তে তা চার মাস করার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা সিদ্ধান্ত দেন। এসবই পুলিশের কাঠামোগত পরিবর্তনের বিষয়। তবে অপারেশনাল কার্যক্রম চালাতেও ব্যাপক সংস্কার শুরু হয়েছে।

কর্মকর্তারা বলছেন, ৫ আগস্টের পর পুলিশের ক্ষতিগ্রস্ত থানা ভবনসহ অবকাঠামোগুলোর প্রয়োজনীয় সংস্কার করা হয়েছে। অপারেশনাল কাজে ব্যবহৃত ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িও দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় পুলিশের কাজে কেউ বাধা দিলে তা শক্তভাবে মোকাবিলারও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে মাঠ পর্যায়ে। অপরাধী যেই হোক, তাকে ছাড় না দেওয়ার মনোভাব নিয়ে কাজ করতে বলা হয়েছে। পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী মাঠ পুলিশ কাজ শুরু করেছে। এরই মধ্যে বিভিন্ন স্থানে বিশৃঙ্খলাকারীদের পুলিশ কঠোর হস্তে দমন শুরু করেছে। তবে পুলিশ আগের মতো প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে মৃদু লাঠিচার্জ, জলকামান নিক্ষেপ ইত্যাদি পদ্ধতি অনুসরণ করছে, যা এরই মধ্যে বিভিন্ন মহলে প্রশংসিত হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ‘ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের পরের কয়েকদিন পুলিশি কার্যক্রম একেবারেই বন্ধ ছিল। এরপর কার্যক্রম শুরু হলে প্রয়োজনীয় অপারেশনাল কাজ চালাতে বেশকিছু চ্যালেঞ্জ সামনে আসে। এসব বিষয় চিহ্নিত করে জনআকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে পুরোদমে পুলিশি কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, এরই মধ্যে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশের আলোকে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। পুলিশ বিশৃঙ্খলা দমন ও বলপ্রয়োগের ক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করছে। পিআরবি ও জাতিসংঘের মানদণ্ড অনুসারে প্রথম থেকে তৃতীয় স্তরে শারীরিক সংস্পর্শ ছাড়া অবৈধ জনতাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বলপ্রয়োগে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা; বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করে অবৈধ জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। কৌশলে শক্তি প্রয়োগ করেও অবৈধ জনতা ছত্রভঙ্গ না হলে বরং আরও সংগঠিত হওয়ার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে। উচ্ছৃঙ্খল জনতা মারমুখী আচরণ করছে। এই অবস্থায় পুলিশ ওয়াটার ক্যানন এপিসি ইত্যাদি ব্যবহার করছে। স্পেসিফিক স্কিল প্রয়োগ করে পরিস্থিতি নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। উপযুক্ত কর্তৃপক্ষের অনুমতি সাপেক্ষে শটগান, সাউন্ড গ্রেনেড, ইনডিভিজ্যুয়াল ফায়ার আর্মস নির্দিষ্ট টার্গেটে ব্যবহারের মাধ্যমে উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা চলছে। অবৈধ উচ্ছৃঙ্খল জনতার আক্রমণের কারণে জনগণের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়, শারীরিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে হয় এবং কমান্ডার ও পুলিশ সদস্যদের এই পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে জনতার ওপর গুলিবর্ষণের নির্দেশকে একটি চরম ব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে। কেবল পুলিশ সদস্যদের বা ব্যক্তির আত্মরক্ষা বা সম্পত্তি রক্ষার অধিকার প্রয়োগের জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে। দলগত আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষেত্রে বেআইনি সমাবেশের দলনেতা ও অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গে পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সমঝোতার চেষ্টা চলছে। বেআইনি জনসমাবেশ ছত্রভঙ্গ করতে ক্রাউড কন্ট্রোল টেকনিকের বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করা হচ্ছে।

পুলিশের অন্য এক কর্মকর্তা বলেন, আটক তল্লাশি ও গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের নির্দেশনা অনুসরণ করা হচ্ছে। বন্দিদের আদালতে আনা-নেওয়ার যানবাহনের মান উন্নত করা হয়েছে। নারী আসামিকে নারী পুলিশের উপস্থিতিতে শালীনতার সঙ্গে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। রাতে তল্লাশি করার সময় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি বা গণ্যমান্য ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করা হচ্ছে। বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে চূড়ান্তভাবে দোষীসাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত মিডিয়ার সামনে কাউকে অপরাধী হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে না।

ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, থানায় জিডি ও মামলা গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। কোনোক্রমেই জিডি প্রত্যাখ্যান করা যাবে না মর্মে মাঠ প্রশাসনে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর কালবেলাকে বলেন, ‘ভেঙে পড়া পুলিশ বাহিনীকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে শুরু থেকেই নানা উদ্যোগ ছিল। অপারেশনাল ও অবকাঠামোগত সংস্কারের পাশাপাশি কাঠামোগত পরিবর্তনেও নানা সিদ্ধান্ত এসেছে, নানা আলোচনা রয়েছে। এর সবকিছুই জনআকাঙ্ক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা স্বাভাবিক রাখার বিষয়টি মাথায় রেখে করা হচ্ছে। পাশাপাশি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে স্বল্প, মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদে কাজ চলছে।

এই কর্মকর্তা বলেন, গত সাত মাসে পুলিশ বাহিনী ঘুরে দাঁড়ালেও মব জাস্টিস ও পুলিশি বা সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার বিষয়টি এখন বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আসছে। মব জাস্টিসের নামে আইন হাতে তুলে নেওয়া এবং পুলিশি কাজে বাধা দেওয়া আইনত অপরাধ, এটা সবাইকে বুঝতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় নাগরিকদেরও দায়িত্ব পালন করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে।