Image description
৯৮ ভাগ মামলাই খালাস

মাগুরায় ৮ বছরের এক শিশু ধর্ষণসহ একাধিক ধর্ষণের ঘটনায় উত্তাল সারা দেশ। এসব ঘটনায় জড়িতদের বিচার দাবিতে দেশজুড়ে বিক্ষোভ করছে মানুষ। ধর্ষণের বিচার প্রকাশ্যে নিশ্চিত করার দাবিও উঠেছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকারের পক্ষ থেকে তড়িঘড়ি করে ধর্ষণ মামলার বিচার ও তদন্তের সময়সীমা কমিয়ে অর্ধেক করার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে।

তদন্তের সময় ৩০ দিনের স্থলে ১৫ দিন এবং বিচারের সময় ১৮০ দিনের স্থলে ৯০ দিন করতে আইন সংশোধন করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। ধর্ষণ মামলার বিচারের বাস্তব চিত্র একেবারেই ভিন্ন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে করা ধর্ষণ মামলার ৯৮ শতাংশই শেষ পর্যন্ত মিথ্যা প্রমাণিত। ধর্ষণ মামলার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, যথাযথ তথ্য-প্রমাণ না থাকায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। কয়েকটি ট্রাইব্যুনালে পাঁচ মাসেও কোনো ধর্ষণ মামলায় আসামির সাজা হয়নি। বেঁধে দেওয়া ১৮০ দিনের সময়ে বিচার শেষ হয়নি একটি মামলায়ও।

সুপ্রিম কোর্টের তথ্য অনুসারে, ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে দেড় লাখের বেশি ধর্ষণের মামলা বিচারাধীন রয়েছে। এর মধ্যে ৫ বছর ধরে মামলা বিচারাধীন আছে ৩২ হাজার ৯৭২টি। অনুসন্ধানাধীন রয়েছে ২০ হাজার ১৮৩টি মামলা। এসব মামলার কোনোটির তদন্ত নির্ধারিত ৩০ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ হয়নি। এমনকি আদালতে প্রতিবেদন জমা পড়া ১ লাখ ৩১ হাজার ১৩৪টি মামলার তদন্তও বেঁধে দেওয়া সময়ে শেষ করা যায়নি। এদিকে ঢাকায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল রয়েছে ৯টি।

এসব ট্রাইব্যুনালে জানুয়ারিতে মামলা বিচারাধীন ছিল ১৫ হাজার ২১৩টি। বর্তমানে কিছু মামলা নিষ্পত্তি হলেও যুক্ত হয়েছে আরও সহস্রাধিক মামলা। এসব ট্রাইব্যুনালের ২০২৪ সালের অক্টোবর থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত পাঁচ মাসের ধর্ষণ মামলার বিচার কার্যক্রমের প্রাপ্ত তথ্যানুসারে দেখা গেছে, এই সময়ের মধ্যে তিনটি ট্রাইব্যুনালের একটি মামলাতেও সাজা হয়নি। এর মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-১-এ বিগত পাঁচ মাসে ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে ১২টি মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। একটি মামলাতেও আসামিদের সাজা হয়নি। সব মামলাতেই খালাস পেয়েছে আসামিরা। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে করা মামলাও মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে।

এ ছাড়া গত পাঁচ মাস নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ ও ট্রাইব্যুনাল-৯ আদালতে ধর্ষণের একটি মামলাতেও রায়ে আসামিদের সাজা হয়নি। সব মামলাতেই আসামিরা খালাস পেয়েছে। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এ পাঁচ মাসে মাত্র দুটি মামলায় সাজা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সব মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। একই চিত্র নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৪-এ। বিগত পাঁচ মাসে ট্রাইব্যুনালটি দুটি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা মামলায় সাজা দিয়েছেন। এই দুই ট্রাইব্যুনালে শতকরা ৯৮ ভাগের বেশি মামলায় খালাস পেয়েছেন আসামিরা। এ ছাড়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৬ ও ট্রাইব্যুনাল-৭-এ গত ৫ মাসে মাত্র একটি ধর্ষণ মামলায় সাজা হয়েছে আসামির। বাকি সব মামলার রায়ে আসামিরা খালাস পেয়েছেন। এ ছাড়া ঢাকার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এ ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও ধর্ষণের মাধ্যমে হত্যার অভিযোগে করা ৫৫টি মামলায় রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৫২ মামলাতেই খালাস পেয়েছেন আসামিরা। মাত্র তিনটি মামলায় আসামিদের সাজা হয়েছে। সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ড হয়েছে মাত্র একটি মামলায়। আরও ১২ মামলায় সাক্ষী হাজির না হওয়ায় আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬৭ মামলার শতকরা ৯৮ ভাগ মামলাতেই খালাস পেয়েছেন আসামিরা।

যে কারণে খালাস হচ্ছে: নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) নাছিমা আক্তার কালবেলাকে বলেন, ট্রাইব্যুনালে ধর্ষণের যেসব মামলা আসে তার বেশিরভাগই প্রেমের কারণে। বিয়ে করতে না চাইলে এ মামলা দেওয়া হয়। পরে আসামি ও বাদীর বিয়ে হয়ে গেলে মামলা মীমাংসা হয়ে যায়। গ্রামে এক পরিবারের সঙ্গে আরেক পরিবারের কলহেও ধর্ষণের মামলা হয়। সেগুলোতে পরে বাদী প্রমাণ করতে পারে না। এ ছাড়া যেগুলো সত্যিই ধর্ষণ হয়, সেসব মামলাতেও পরে আসামিদের সঙ্গে টাকার বিনিময়ে আপস করে ফেলা হয়। যারা সত্যিকারের বিচার চান, সেসব মামলাতে বড় সমস্যা ডাক্তারি রিপোর্ট, যা ভুক্তভোগীদের পক্ষে আসে না। সম্প্রতি একটি ধর্ষণ মামলায় আসামি আমিন হোসেন রুবেলকে খালাস দেওয়ার সময় শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৫-এর বিচারক মুহাম্মদ সামছুল ইসলাম রায়ের পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেন, বর্তমানে আমাদের সমাজে একটি প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হলে বা বনিবনা না হলে, প্রেমিকের সঙ্গে কোনো মেয়ে পালিয়ে বিয়ে করলে বা প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে নিয়ে বিরোধ তৈরি হলে তারা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। পরে সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে তাদের মধ্যে বিরোধ মিটমাট হয়ে গেলে কিংবা সামাজিকভাবে ট্রাইব্যুনালের বাইরে বিরোধ নিষ্পত্তি হয়ে গেলে অথবা মা-বাবা বিয়ে মেনে নিলে বা প্রেমিক-প্রেমিকার বিয়ে হয়ে গেলে ট্রাইব্যুনালে এসে সাক্ষ্য প্রদান করতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে মামলাগুলো দিনের পর দিন সাক্ষীর জন্য বিলম্বিত হয়। এতে একদিকে যেমন ট্রাইব্যুনালে পাহাড় সম মামলার জট বাঁধতে থাকে, অন্যদিকে আসামিরা বিনা বিচারে দিনের পর দিন ট্রাইব্যুনালের বারান্দায় ঘুরতে থাকেন।

বিচারপ্রার্থীদের পদে পদে ভোগান্তি: রাজধানীর সরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী কালবেলাকে জানান, প্রতারণা করে একজন তার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে। কিন্তু বিয়ের কথা বললে বাঁধে বিপত্তি। উপায় না পেয়ে করেন ধর্ষণ মামলা। তবে মামলা চালাতে গেলে পদে পদে ভোগান্তিতে পড়েন তিনি। ‘কীভাবে ধর্ষণ’ করা হয়সহ তদন্ত কর্মকর্তার বিব্রতকর প্রশ্নের মুখে পড়েন বলে অভিযোগ করেন তিনি। এ ছাড়া টাকা না দিলে রিপোর্ট মিথ্যা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়। সেখানে টাকা দিয়েই শেষ নয়, প্রতি শুনানিতে আইনজীবীকে টাকা দেওয়া, হাজিরার সময় ভোগান্তি, ডিএনএ টেস্ট করা, জানাজানি হলে সামাজিকভাবে হেয় হওয়ার ভয়সহ বিভিন্ন কারণে তিনি মামলা চালাবেন না বলে জানান। তার মতো অনেক ধর্ষণ মামলার বাদী ভোগান্তির কারণে মামলা না চালিয়ে মীমাংসা করার কথা জানিয়েছেন। মামলায় ত্রুটি, তদন্তে গাফিলতি: ২০২৪ সালে থেকে চলতি বছরে রাজধানীর গুলশান, বনানী, উত্তরখান, দক্ষিণখান, লালবাগ, চকবাজার, কামরাঙ্গীরচর, উত্তরা পূর্ব, উত্তরা পশ্চিম ও তুরাগ—এই ১০টি থানার ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করেছে কালবেলা। আদালতে থানাগুলোর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন জিআর শাখা-২-এর রেজিস্টার অনুসারে, এই ১০ থানা ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা মামলা তদন্ত করে ২০২৪-এর জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ১০৪টি ও জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ৫৭টি মামলায় চার্জশিট দিয়েছে। চলতি বছরে তদন্তে প্রমাণিত হওয়ায় ৪২টি মামলায় চার্জশিট দিয়েছে। এ ছাড়া ২০২৪ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত তদন্ত করে অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ১৯টি ধর্ষণ ও ধর্ষণচেষ্টা মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। এসব প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মামলা দায়েরের সময় বাদী মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন। এ ছাড়া তথ্যগত ভুলও রয়েছে। অন্যদিকে ফাঁসাতে ও প্রেমে বনিবনা না হওয়ায়ও মামলা করা হয়েছে। এজন্য এসব মামলা থেকে আসামিদের অব্যাহতির সুপারিশ করেন তদন্ত কর্মকর্তারা। মামলা বিশ্লেষণে দেখা যায়, কামরাঙ্গীরচর থানায় ৮(১২)২৪ নং ধর্ষণ মামলায় তদন্তের জন্য সময় নেওয়া হয়েছে এক বছর দুই মাস।

লালবাগ থানার ১৯(১১)২২ নং ধর্ষণ মামলায় তদন্তের জন্য সময় নেওয়া হয়েছে ২ বছর দুই মাস। অর্থাৎ তদন্তের জন্য বেঁধে দেওয়া ৩০ দিনের সময় মানা হয়নি। শুধু তাই নয়, ২০২৪ সালে উচ্চ আদালতের সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেওয়া ১ লাখ ৩১ হাজার ১৩৪টি মামলার তদন্তও বেঁধে দেওয়া সময়ে শেষ করা যায়নি। অনুসন্ধানাধীন ২০ হাজার ১৮৩টি মামলার অধিকাংশই নির্ধারিত সময় পেরিয়ে গেছে। তবে ধর্ষণ মামলায় ডিএনএ টেস্টের রিপোর্ট পেতে অনেক বেশি সময় লাগে। এজন্য তদন্ত রিপোর্ট দিতে অনেক দেরি হয় বলে দাবি করেছেন বিভিন্ন মামলার তদন্ত কর্মকর্তারা।

মামলার তদন্তের দীর্ঘসূত্রতার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে ১৫ দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করার নির্দেশনা বাস্তবসম্মত কি না প্রশ্নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ প্রসিকিউটরিয়াল উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট এহসানুল হক সমাজী কালবেলাকে বলেন, ‘যারা ধর্ষণ মামলার তদন্ত করবেন, তারা যেন শুধু ওই মামলার তদন্তেই নিয়োজিত থাকেন। তা না হলে বিভিন্ন মামলার তদন্তের চাপে ধর্ষণ মামলা সঠিক সময়ে রিপোর্ট দেওয়া যায় না। তাই শুধু ধর্ষণ মামলার তদন্তের জন্য স্পেশালাইজ এজেন্সি বা টিমকে নিয়োজিত করা উচিত। তাহলে ১৫ দিনে তদন্ত শেষ করা যাবে। এ ছাড়া ধর্ষণ মামলার তদন্তে বড় সমস্যা মেডিকেল রিপোর্ট দেরিতে আসে। এগুলো কীভাবে দ্রুত দেওয়া যায়, সেদিকে নজর দিতে হবে।’ অধিকাংশ ধর্ষণ মামলায় খালাস ও বিচারে বিলম্বের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় মিথ্যা মামলা করা হয়। পরে মীমাংসা করে নেওয়া হয়। বর্তমান সময় অনুয়ায়ী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন সংশোধন করা উচিত। এতে যারা দোষী তারা যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পায়। অন্যদিকে মিথ্যা মামলা দিলে তার বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।

’ এদিকে ধর্ষণের মামলাগুলো দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে নিষ্পত্তির দাবি জানিয়ে সম্মিলিত নারী প্রয়াসের সভাপতি অধ্যাপক ড. শামীমা তাসনীম বলেছেন, ‘আমরা দেখে এসেছি ধর্ষণের ঘটনায় অনেক সময় আলামত নষ্ট করা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রভাবে ধর্ষকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। অনেক সময় থানায় মামলাও নেওয়া হয়নি।’ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে মোট ২ হাজার ৫২৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩৬৭ কন্যাশিশুসহ ৫১৬ জন। তার মধ্যে ৮৬ জন কন্যাশিশুসহ ১৪২ জন দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে, ১৮ জন কন্যাশিশুসহ ২৩ জনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে, ৫ জন কন্যাশিশুসহ ৬ জন ধর্ষণের কারণে আত্মহত্যা করেছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্যমতে, ২০২৪ সালে দেশে ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪০১ নারী। এর মধ্যে ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৩৪ জন এবং ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন ৭ জন। ধর্ষণচেষ্টার শিকার হয়েছেন ১০৯ জন। এর মধ্যে ধর্ষণচেষ্টার পর হত্যা করা হয় ১ জনকে। যৌন হয়রানি ও উত্ত্যক্তের শিকার হয়েছেন কমপক্ষে ১৬৬ নারী। উত্ত্যক্তের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ২ জন ও খুন হয়েছেন ৩ নারী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন ৬ জন পুরুষ এবং নির্যাতন ও হয়রানির শিকার হয়েছেন ৩৫ জন পুরুষ।