
রাষ্ট্র সংস্কারবিষয়ক মতামত পাঠাতে গত ৬ মার্চ দেশের ৩২টি রাজনৈতিক দল ও জোটকে চিঠি দিয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সেখানে দলগুলোকে স্প্রেডশিটে (হ্যাঁ, না) টিক চিহ্নের মাধ্যমে মতামত প্রদানের জন্য বলা হয়। গত রোববার দলগুলোকে এমন স্প্রেডশিট পাঠানো হয়েছে। তবে সংস্কার ইস্যুতে মতামত প্রদানের এ ধরনকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না বিএনপি। দলটি ছয় সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের ওপর নিজস্ব মতামত লিখিত আকারে বিস্তারিতভাবে তুলে ধরবে। বিএনপি মনে করছে, স্প্রেডশিটে শুধু টিক চিহ্নের মধ্য দিয়ে সব জিনিসকে বিস্তারিত আকারে তুলে ধরা যাবে না। তাই স্প্রেডশিটের পাশাপাশি লিখিত আকারেও মতামত দেবে দলটি। অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে পরবর্তী আলোচনায় বিষয়টি তুলে ধরা হবে। এই ইস্যুতে বিএনপির মিত্ররাও একই কিংবা কাছাকাছি মতামত তুলে ধরতে পারে। ঐকমত্য কমিশন থেকে চিঠি পাঠানোর পর এটা নিয়ে যুগপতের শরিক দলগুলোর সঙ্গে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে বিএনপির।
কমিশন থেকে আগামী ১৩ মার্চের মধ্যে মতামত পাঠাতে বলা হলেও একটু সময় নিয়ে এ কাজটি করতে চায় তারা। মিত্রদের সঙ্গে আরও আলোচনা এবং দল ও দলের বাইরে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক্সপার্টদের সঙ্গে কথা বলে দলীয় মতামত চূড়ান্ত করবে বিএনপি। তারপর লিখিত আকারে সেই মতামত তুলে ধরবে দলটি। এ জন্য বিএনপি আরও সপ্তাহখানেক সময় নিতে পারে। জানা গেছে, মতামত পাওয়ার পর সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য তৈরির লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাদাভাবে আলোচনা শুরু করবে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। চলতি মার্চ মাসের তৃতীয় সপ্তাহে এ বৈঠক শুরু হতে পারে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সংস্কার ইস্যুতে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে, সেগুলোর ব্যাপারে সরকার পরিপত্র জারি করতে পারে। যেগুলো পরবর্তী নির্বাচিত সরকার এসে আইনি রূপ দেবে। এর আগে ঐকমত্য কমিশন থেকে সংবিধান সংস্কার কমিশন, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন, পুলিশ সংস্কার কমিশন, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশন, বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রতিবেদনের হার্ড কপি পর্যালোচনার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে পাঠানো হয়েছিল। কমিশনগুলোর সুপারিশ বিবেচনা ও জাতীয় ঐকমত্য গঠনের জন্য রাজনৈতিক দল ও শক্তির সঙ্গে আলোচনা করতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যার নেতৃত্ব দিচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আর ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে আছেন সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান অধ্যাপক আলী রিয়াজ। বাকি কমিশনগুলোর প্রধানরাও ঐকমত্য কমিশনের সদস্য।
গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করে ঐকমত্য কমিশন। সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দলগুলোর সঙ্গে পৃথকভাবে আলোচনার কথা প্রথম বৈঠকে জানানো হয়েছিল। দলগুলোর সঙ্গে সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে একটি সনদ (জুলাই সনদ) তৈরি করা হবে। এই জুলাই সনদের ভিত্তিতে হবে আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। অধ্যাপক আলী রিয়াজ জানান, মোট ১৬৬টি সুপারিশ চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার-সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে ২৭টি, বিচার বিভাগ-সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসন-সংক্রান্ত ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন-সংক্রান্ত ২০টি সুপারিশ রয়েছে। ওই সুপারিশমালা ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে ৬ মার্চ পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো ‘একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। সংবিধান সংস্কার কমিশনের এই প্রধান বলেন, দ্বিতীয়টি হলো প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এই ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে।
সেগুলো হলো ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে।
এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোকে ‘মন্তব্য’ দেওয়ার জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। বিএনপি এরই মধ্যে সংস্কারবিষয়ক কয়েকটি ইস্যুতে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেছে। ‘সেকেন্ড রিপাবলিক’ ও ‘গণপরিষদ নির্বাচন’ নিয়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে না তারা। দলটি মনে করছে, এর কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই। কারণ, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। এর একটি সংবিধান রয়েছে। এই সংবিধানের আলোকেই বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার শপথ নিয়েছে। যে সময়ে দেশে কোনো সংবিধান রচিত থাকে না, মানে একটা নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তখন গণপরিষদের প্রয়োজন হয়। বিএনপি বিদ্যমান বাহাত্তরের সংবিধান বাতিল চায় না। দলটি মনে করে, বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করতে একে দলীয়করণ করে গণতন্ত্রের বিপক্ষে এবং নিজেদের পক্ষে সাজিয়েছিলেন। এ কারণে সংবিধানে যে ব্যত্যয় বা বিচ্যুতি হয়েছে, সেজন্য সংবিধানের প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রয়োজন। রাজনৈতিক মতৈক্যে যে সংস্কার করবে নির্বাচিত সংসদ।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘আমরা গতকাল (রোববার) স্প্রেডশিটটা পেয়েছি। আর প্রায় সপ্তাহ খানেক আগে আমরা বড় ভলিউমে সংস্কার কমিশনের রিপোর্টগুলো পেয়েছি। সেই রিপোর্টগুলো নিয়ে আমরা অনুশীলন-বিশ্লেষণ করছি, কাজ করছি। বিশ্লেষণ শেষে আমরা মতামত দেব। তবে স্প্রেডশিটে মতামতকে আমরা তেমন গুরুত্ব দিচ্ছি না। কারণ, এখানে আমরা সব জিনিসকে ইন-ডিটেইল (বিস্তারিত) বর্ণনা করতে পারব না। আমরা সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্টের ওপর বিস্তারিত মতামত তুলে ধরব। সঙ্গে স্প্রেডশিটটাও থাকল। তবে এটা নিয়ে আমরা এখনো বিস্তারিত আলোচনা করিনি।’ বিএনপি এ বিষয়ে শরিকদের মতামত নেবে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির এই নীতিনির্ধারক বলেন, বিভিন্ন বিষয়ে আমরা শরিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করি। সেটা আমরা চালু রাখব। গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক কালবেলাকে বলেন, স্প্রেডশিটে কী আছে সেটা আমরা দেখছি। এরপর আমরা মতামত দেব। স্প্রেডশিটের বাইরে লিখিত আকারে কোনো মতামত দেওয়ার প্রয়োজন হলে সেটাও আমরা বিবেচনা করব। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সংস্কার ইস্যুতে বিএনপি ও শরিকরা একই মতামত দিতে পারলে ভালো হতো। তবে এটা নিয়ে বিএনপির সঙ্গে এখনো আনুষ্ঠানিক আলোচনা হয়নি।