Image description

বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তারা যুগ্ম সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি। দুই বছর পার হলেও এখনো তাঁদের পদোন্নতির জট খুলছে না। কবে নাগাদ পদোন্নতি হবে, সেটাও বলতে পারছেন না দায়িত্বশীল কেউই। বিএনপির শাসনামলে নিয়োগ পেলেও চাকরির পুরোটা সময় কেটেছে আওয়ামী আমলজুড়ে।

শেষ মুহূর্তে এই ব্যাচের নিয়োগ নিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশ্ন তোলায় তাঁদের কপাল পুড়েছে বলে মনে করছেন ব্যাচের কর্মকর্তারা। তাঁদের দাবি, তাঁরা রাজনৈতিক গ্যাঁড়াকলে পড়েছেন, কোনো পক্ষই তাদের আপন ভাবছে না। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এমন তথ্য। জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় ২০০২ সালে ২৪তম বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়া শুরু হয়।

আর চূড়ান্ত নিয়োগ হয় ২০০৫ সালের ১৩ জুন। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট বলছে, ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তার সংখ্যা চার হাজার ৯২৯। এর মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের ৩৪৪ জন এবং পুলিশ ক্যাডারে ২১৫ জন। এ ব্যাচে শুধু স্বাস্থ্য ক্যাডারে দেড় হাজার এবং সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারে প্রায় আড়াই হাজার কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়।

এই ব্যাচ ২০০৫ সালের ২ জুলাই চাকরিতে যোগ দেয়। বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডারের ১৯ কর্মকর্তাসহ এ ব্যাচের পদোন্নতির যোগ্যতা অর্জন করেছেন ৩৩৭ জন উপসচিব। ২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি এসব কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। সেই হিসাবে ২০২৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি যুগ্ম সচিব হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছেন তাঁরা। দুই বছরের বেশি সময় পার হলেও এখনো তাঁদের পদোন্নতির দরজা খোলেনি।

বিষয়টির অগ্রগতি জানতে চাইলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ) মো. এরফানুল হক বুধবার কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি এখনো প্রক্রিয়াধীন। ঈদের আগে হবে কি নাএমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, বলা মুশকিল। এটা বলতে পারেন যে পদোন্নতির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারির পরই বিসিএস ২৪তম ব্যাচের কর্মকর্তাদের যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতির তোড়জোড় শুরু হয়। কয়েকটি বৈঠকও করে পদোন্নতির জন্য সুপারিশকারী কর্তৃপক্ষ সুপিরিয়র সিলেকশন বোর্ড (এসএসবি)। ওই সময় এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের অনেকে প্রশাসন ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির একান্ত সচিব (পিএস) ও বিভিন্ন জেলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে কর্মরত ছিলেন। এই ব্যাচের কর্মকর্তারাই মূলত ২০২৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে হাসিনা সরকারকে জয়ী হতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেন। নির্বাচনে জয়ী হয়ে টানা চতুর্থবারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন শেখ হাসিনা। সরকার গঠনের কয়েক মাসের মাথায় সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং প্রতিষ্ঠানটির সাবেক গাড়িচালক আবেদ আলী ইস্যুর উদ্ভব হয়। এরই মধ্যে সরকারি চাকরিতে কোটা ইস্যু বহালের রায় দেন আদালত। এ নিয়ে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা।

এমন পরিস্থিতিতে চীন সফর শেষে গত বছরের ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে হাওয়া ভবন থেকে পাঠানো তালিকায় বিসিএসে চাকরি হতো। এ সময় কোনো পরীক্ষাই হতো না। ২০০২ সালে ২৪তম বিসিএস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। বিএনপির আমলে ওই সময়ে যতগুলো পরীক্ষা হয়েছে, চাকরি হয়েছে, সব কটির তালিকা হাওয়া ভবন থেকে পাঠানো হতো। ওই তালিকা অনুযায়ী চাকরিপ্রার্থীদের চাকরি দেওয়া হতো।

প্রধানমন্ত্রীর এমন মন্তব্যে নড়েচড়ে বসেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা। এর পরই এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের ছাত্রজীবন এবং পরিবার ও আত্মীয়-স্বজনের রাজনৈতিক পরিচয় খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেওয়া হয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে। বিশেষ করে ওই সময় বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রদল-শিবিরের পদধারী যাঁরা নিয়োগ পেয়েছেন, তাঁদের বিষয়ে খোঁজখবর নিতে বলা হয়। এতে প্রশাসনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।

শুধু ২৪তম ব্যাচই নয়, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় নিয়োগ পাওয়া অন্য কর্মকর্তাদের মধ্যেও ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। উল্লেখ্য, ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর বিসিএস ২১, ২২, ২৪ ও ২৫তম ব্যাচের নিয়োগ হয়। বর্তমান প্রশাসনে তাঁরা উপসচিব ও যুগ্ম সচিব পদে কর্মরত। তাঁদের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষের সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে নতুন করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা নিয়েই অনেকেই চিন্তিত ও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তাঁদের কেউ কেউ বলেন, প্রশাসনে তাঁদের চাকরির বয়স হয়েছে ২০ বছরের বেশি। সামনে যুগ্ম সচিব পদে পদোন্নতি পাওয়ার কথা। এখন এ ধরনের প্রশ্ন উঠলে তাঁদের জন্য খুবই বিব্রতকর ও অমানবিক। নিয়োগ বিএনপি আমলে হলেও তাঁদের ২০ বছরের চাকরির প্রায় পুরো সময়টাই কেটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে। তাঁরা বলেন, ১৬ বছর ধরে সার্ভিস দিয়েও কি আমাদের আবারও পরীক্ষা দিতে হবে? নতুন করে গোয়েন্দারা কী তথ্য নেবেন? এর মাধ্যমে আমাদের সামাজিকভাবে হেয় করা হচ্ছে।

জানা গেছে, সাড়ে তিন শ কর্মকর্তার এই ব্যাচের বর্তমানে ২৬ জন ডিসি রয়েছেন। হাসিনা সরকারের আমলসহ এই ব্যাচের অন্তত ৭২ জন কর্মকর্তা ডিসির দায়িত্ব পালন করেছেন। মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের একান্ত সচিবের (পিএস) কাজ করেছেন অন্তত ৫২ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্যরা হলেন সালমান এফ রহমানের পিএস আবু সালেহ মোহাম্মদ ওবায়দুল্লাহ; যিনি রোহিঙ্গা ক্যাম্পের পরিচালক, সাবেক বিদ্যুত্ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর পিএস, কেরানীগঞ্জের ইউএনও এবং চট্টগ্রামের ডিসি আবুল বাসার মো. ফখরুজ্জামান; যিনি বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের পরিচালক, শিক্ষামন্ত্রী নওফেলের পিএস ও বি. বাড়িয়ার ডিসি শাহগীর আলম;  নরসিংদীর ডিসি আবু নঈম মোহাম্মদ মারুফ খান, যিনি পরিবেশ উপদেষ্টার পিএস, গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ার সন্তান ঢাকা ও গাজীপুরের ডিসি আনিসুর রহমান এখন রয়েছেন ওয়াকফ প্রশাসকের কার্যালয়ে। পরিকল্পনামন্ত্রী আবদুস সালামের পিএস আবদুল হামিদ মিয়া আছেন ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষের প্রশিক্ষণ উপদেষ্টা হিসেবে। একই জায়গায় আছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের পিএস আলমগীর হোসেন, কুড়িগ্রামের ডিসি মোহাম্মদ সাইদুল আরীফ আছেন বিয়াম ফাউন্ডেশনে, ভূমিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দের পিএস ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের নেতা মো. সাদেকুল ইসলাম আছেন মাদরাসা ও কারিগরি বিভাগে, মুন্সীগঞ্জ ও গাইবান্ধার ডিসি কাজী নাহিদ রসুল আছেন নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষে, একই প্রতিষ্ঠানে সচিবের দায়িত্বে আছেন জামালপুরের ডিসি শ্রাবস্তী রায়, স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালিক ও এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক আবুল কালাম আজাদের পিএস কামরুল হাসান রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পদে আছেন। পুলিশ ক্যাডারের বেশির ভাগ কর্মকর্তাই অতিরিক্ত ডিআইজি হয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করছেন। একসময় বেশির ভাগ জেলার পুলিশ সুপারও (এসপি) ছিলেন তাঁরা। এ ধরনের আরো অসংখ্য কর্মকর্তা গত ১৫ বছরে সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী-সচিবের পিএস ও বিভিন্ন জেলার ডিসি-এসপির দায়িত্ব পালন করেছেন। এর ফলে এই ব্যাচের কর্মকর্তাদের পদোন্নতির বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করছে এসএসবি।