
ছাত্র-জনতার প্রবল আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বিএনপির নেতাকর্মীসহ অনেকে ভেবেছিলেন, তারেক রহমান শিগগিরই হয়তো দেশে ফিরবেন। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের সাত মাস পেরিয়ে গেলেও তারেক রহমানের দেশে ফেরার আভাস নেই। এ নিয়ে দলটির নেতাকর্মীদের মধ্যেও রয়েছে ধোঁয়াশা। তারেক রহমান কবে দেশে ফিরতে পারেন, তা স্পষ্ট করে বলতে পারছেন না বিএনপি নেতারা।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তিনি যেকোনো সময় আসতে পারেন। সব কিছু বিবেচনা করে আসবেন। তাঁর বিবেচনা অনুযায়ী যখন আসা সম্ভব হবে, তখনই আসবেন।’তারেক রহমানের দেশে ফেরা নিয়ে দলটির আইনবিষয়ক সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামালেরও বক্তব্য একই রকম।
বিএনপি বরাবরই দাবি করছে, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সাড়ে ১৫ বছরে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় এক লাখ ৪৫ হাজার মামলা হয়েছে। বিএনপির তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায় পর্যন্ত কেউ হয়রানি থেকে বাদ যাননি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিএনপির এক আইনজীবী নেতা কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তারেক রহমান শুধু তাঁর নিজের মামলা নিয়ে চিন্তা করছেন না। বিএনপির নেতাকর্মী, সমমনা রাজনৈতিক দল ও স্বাধীনচেতা মানুষের বিরুদ্ধে গত ১৬ বছরে অজস্র মামলা হয়েছে। তিনি চান প্রতিটি মিথ্যা মামলা যেন প্রত্যাহার করা হয়।’
যেসব মামলা থেকে খালাস : সর্বশেষ দেড় দশক আগের অর্থপাচার মামলার দায় থেকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অব্যাহতি দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। এ মামলার প্রধান আসামি গিয়াস উদ্দিন আল মামুনের আপিলের ওপর গত ৬ মার্চ এই রায় হয়।
মামলাসংশ্লিষ্ট আইনজীবীদের ভাষ্য, মামলার প্রধান আসামি মামুন নির্দোষ সাব্যস্ত হওয়ায় হাইকোর্টের রায়ের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না থাকলেও খালাসের রায়ের সুবিধা পেয়েছেন তারেক রহমান। বিচারিক আদালত বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যানকে খালাস দিলেও পাঁচ বছর আগে হাইকোর্ট তাঁকে সাত বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। এর আগে গত ১৫ জানুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় উচ্চ আদালত ও বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করে বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ মামলার ছয় আসামিকেই খালাস দেন সর্বোচ্চ আদালত। এ মামলায় বিচারিক আদালত তারেক রহমানকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের সঙ্গে অর্থদণ্ড দিয়েছিলেন।
রায়ে সর্বোচ্চ আদালত বলেন, ‘আপিলের বিষয়বস্তু থেকে এটা প্রমাণ হয় যে এ মামলায় আইনের ষড়যন্ত্রমূলক অপপ্রয়োগ ঘটেছে। মামলাটি ছিল রাজনৈতিক বিদ্বেষপূর্ণ। ফলে আপিল বিভাগের এই রায় আপিলকারীসহ অন্যদের মর্যাদা পুনরুদ্ধারের পাশাপাশি তাঁদের নিরপরাধ ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠিত করবে। এই রায়ের মধ্য দিয়ে খালাসপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অযাচিত কর্মকাণ্ডেরও অবসান ঘটবে।’ এই মামলায়ও বিচারিক আদালত বা হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে তারেক রহমানের কোনো আপিল ছিল না।
এরপর গত ১ ডিসেম্বর আলোচিত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলা থেকেও তিনি খালাস পান। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুত্ফুজ্জামান বাবর, উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল। আর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনকে দেওয়া হয়েছিল যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।
৩১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে করা মামলাটি খারিজ করে দেন নড়াইলের দ্বিতীয় জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মেহদী হাসান। এ মামলায় ২০২১ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি তারেক রহমানকে দোষী সাব্যস্ত করে দুই বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা আনাদায়ে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন আদালত। পুনর্বিচারের আদেশে মামলাটি খারিজ করা হয়।
তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলার হালনাগাদ তথ্য জানতে চাইলে বিএনপির আইনবিষয়ক সম্পাদক, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার কায়সার কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘জনাব তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৮২টির মতো মামলা হয়েছিল। ওয়ান-ইলেভেনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের আমলে এসব মামলা হয়েছে। বেশির ভাগ মামলাই ছিল মানহানির। আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এসব (মানহানির) মামলা খারিজ হয়ে গেছে। তা ছাড়া জরুরি অবস্থার সময় করা কিছু চাঁদাবাজির মামলাও হয়েছিল, যেসব মামলার আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না। শেখ হাসিনার আমলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলাও হয়েছিল। এই মামলাটিরও আইনগত কোনো ভিত্তি ছিল না, যে কারণে সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ মামলাগুলো বাতিল করে দিয়েছেন। বিগত সরকারের আমলে পাঁচটি মামলায় উনাকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের আপিল ও হাইকোর্ট বিভাগ এখন পর্যন্ত চারটি মামলায় তাঁকে খালাস দিয়েছেন।’
এখনো যে মামলার দণ্ড রয়ে গেছে : সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে ২০০৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তারেক রহমান, তাঁর স্ত্রী ডা. জুবাইদা রহমান এবং শাশুড়ি সৈয়দা ইকবাল মান্দ বানুর বিরুদ্ধে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক জহিরুল হুদা। মামলায় চার কোটি ৮১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৬১ টাকার সম্পদের তথ্য গোপন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগ আনা হয় তারেক রহমানের বিরুদ্ধে। আর তারেক রহমানকে সহযোগিতা ও তথ্য গোপনের অভিযোগ আনা হয় জুবাইদা এবং তাঁর মায়ের বিরুদ্ধে।
২০২৩ সালের ২ আগস্ট এ মামলায় তারেক রহমানকে ৯ বছর এবং তাঁর স্ত্রী জুবাইদা রহমানকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন ঢাকার একটি আদালত। এ মামলাটি এখন হাইকোর্টে বিচারাধীন। কায়সার কামাল কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলাটির ক্ষেত্রে যথাযথ আইনি প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হবে।’
বিএনপিতে পদে আছেন সুপ্রিম কোর্টের এমন এক আইনজীবী নাম প্রকাশ না করার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলাটি নিষ্পত্তি হওয়ার আগে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই।’
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় তারেক রহমানকে ২০০৮ সালের ৭ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর মুক্তি পেয়ে যুক্তরাজ্যে যান তিনি। এখন পর্যন্ত সে দেশেই আছেন তিনি।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবীর ব্যাখ্যা হচ্ছে, যেসব মামলায় তারেক রহমানকে সাজা দেওয়া হয়েছে, সব কটিতেই তাঁকে পলাতক দেখনো হয়েছে। তার মানে তিনি কোনো মামলার সাজাই খাটেননি। সম্পদের তথ্য গোপনের মামলাটিতে তাঁকে পলাতক দেখানো হয়েছে। ফলে এই সাজা মাথায় নিয়ে তিনি দেশে ফিরলে তাঁকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করতে হবে, জেলে যেতে হবে। সম্ভবত এ কারণেই তিনি দেশে ফিরছেন না।