Image description

সারা দেশে সব ধরনের অপরাধ বেড়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পিটিয়ে হত্যা, নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি, চুরি, ডাকাতি, দস্যুতা, ছিনতাই, অপহরণ, চাঁদাবাজি, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে হামলা, দখল, চোরাচালান, মাদক ব্যবসার মতো অন্তত ১১ ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা বেড়েছে। এসব নিয়ন্ত্রণে জোরালো পদক্ষেপ না থাকায় সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত।

অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সমাজে অপরাধমূলক নানা ঘটনায় স্পষ্ট যে মানুষ কতটা অসহিষ্ণু এবং ভুক্তভোগীরা কত অসহায়। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর দায়িত্বে ঘাটতির বিষয়টিও দৃশ্যমান। দায়িত্বশীলদের সঠিক জবাবদিহির আওতায় না আনা, আইন না মেনে চলার চর্চা এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগ না থাকা এসব ঘটনার পেছনে অনেকাংশে দায়ী বলে তাঁরা মনে করছেন। 

অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় পুলিশ সদর দপ্তরের পক্ষ থেকে মহাপুলিশ পরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম এরই মধ্যে সারা দেশে পুলিশকে দমন তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। কালের কণ্ঠকে আইজিপি বলেন, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সব ধরনের চেষ্টা চলছে।

রাজধানীতে সম্প্রতি বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা বেড়েছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মাসিক প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্যে এর সত্যতা মেলে। তথ্য বলছে, চলতি বছরের গত দুই মাসে (জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি) রাজধানীতে ২৬৯টি নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। এর মধ্যে জানুয়ারিতে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটে ১২৭টি।

ফেব্রুয়ারিতে তা বেড়ে হয়েছে ১৪২টি। এর বাইরে চুরির ঘটনা ২৬৩টি, ডাকাতি, ছিনতাই ও দস্যুতার ঘটনা ১১৪টি, খুনের ঘটনা ৭৪টি। খুনের ঘটনা যেখানে জানুয়ারিতে ছিল ৩৬টি, ফেব্রুয়ারিতে সেখানে বেড়ে ৩৮টি হয়েছে। এসব ঘটনায় গত দুই মাসে রাজধানীতে মামলা হয়েছে তিন হাজার ৩৫৭টি। গ্রেপ্তার মোট সাত হাজার ৩১০ জন।এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী এক হাজার ১৪১ জন ও চাঁদাবাজ ১৭৩ জন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইকারী এক হাজার ১৪১ জন ও চাঁদাবাজ ১৭৩ জন। 

মহানগরের সাম্প্রতিক অপরাধমূলক পরিস্থিতি নিয়ে ডিএমপির পুলিশ কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী বলেন, ৫ আগস্ট-পরবর্তী পরিস্থিতিতে পুলিশ অনেক সমস্যার মধ্যে রয়েছে।  তবে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চলছে। 

পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যানেও অপরাধ বেড়ে যাওয়ার তথ্য রয়েছে। তথ্য অনুযায়ী, গত বছর প্রথম ছয় মাসের (জানুয়ারি-জুন) তুলনায় এর পরের সাত মাস (জুলাই ২৪-জানুয়ারি ২৫) প্রায় সব ধরনের অপরাধের ঘটনায় মামলার সংখ্যা বেড়েছে। নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা সমাজে আতঙ্কে আছে মানুষ।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, দেশে যেখানে গত বছর প্রথম ছয় মাসে গড়ে ২৭২টি হত্যা মামলা হয়েছে, সেখানে এর পরের সাত মাসে গড়ে ৩১৪টি হত্যা মামলা হয়। একই সময় যেখানে প্রথম ছয় মাসে গড়ে ১৪৫টি ডাকাতি ও দস্যুতার ঘটনায় করা মামলা হয়, পরের সাত মাসে গড়ে ১৭৮টি মামলা হয়েছে। অপহরণের ঘটনায় গত বছরের প্রথম ছয় মাসে গড়ে ৪৭টি করে মামলা এবং পরের সাত মাসে গড়ে ৬৭টি করে মামলা হয়। অন্যদিকে বিশৃঙ্খল ঘটনায় হামলা ব্যাপক বেড়েছে। গত বছরের প্রথম ছয় মাসে এ ধরনের মোট ১৪টি মামলা হয়। পরের সাত মাসে গড়ে মামলা হয় ১৭টি। পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় প্রথম ছয় মাসে গড়ে ৪৭টি করে মামলা হলেও শেষের সাত মাসে ৬৭টি করে মামলা হয়েছে। একই সঙ্গে প্রথম ছয় মাসে চোরাচালানের মামলা হয় ১৬৬টি এবং পরের সাত মাসে মামলা হয় ১৭৩টি।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে দেশে খুন, চুরি ও ডাকাতির মতো অপরাধের ঘটনা গত পাঁচ বছরের একই মাসের তুলনায় বেড়েছে।

চলতি বছরের জানুয়ারিতে অন্তত ২৯৪টি হত্যা মামলা হয়েছে, যা গত বছরের একই মাসে ছিল ২৩১টি। এর আগের চার বছরের একই মাসে এই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২১৪, ২৬৪ ও ২৭৩টি। এর বাইরে চলতি বছরের প্রথম মাসে ডাকাতির মামলা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭১টি, যা গত বছরের জানুয়ারিতে ছিল ১১৪টি। অপহরণের মামলাও চলতি বছরের জানুয়ারিতে বেড়েছে।

আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী ও বিভিন্ন সূত্র বলছে, দেশে অপরাধ বাড়ার মূলে বিভিন্ন কারণের মধ্যে রয়েছে অবৈধ অস্ত্রের ব্যবহার, প্রলোভনে পড়ে অবৈধ কাজে লিপ্ত হওয়া, বেকারত্ব ও হিংসা-বিদ্বেষ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী জোরালোভাবে ঘুরে না দাঁড়াতে পারা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, পারিবারিক ও সামাজিক সম্পর্ক নড়বড়ে হওয়া।

সাম্প্রতিক অপরাধবিষয়ক পরিস্থিতি নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে রোজার সময় শপিং মল, ব্যাংক, বীমাগুলোতে মানুষের ভিড় বাড়ে। রেলস্টেশন, বাস টার্মিনাল ও সদরঘাটসহ অন্যান্য জায়গায় মানুষের উপস্থিতি বাড়ে। এ জন্য মূলত এসব জায়গা লক্ষ করে তৎপর হয় অপরাধীরা।

জরুরি বৈঠক : সাম্প্রতিক ধর্ষণ, নৈরাজ্য ও মব জাস্টিসসহ এ ধরনের ঘটনার বিরুদ্ধে আরো কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরির নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করারও সিদ্ধান্ত হয়েছে। রবিবার বিকেলে সচিবালয়ে আইন মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত এক সভার পর সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল ও তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মাহফুজ আলম।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা কালের কণ্ঠকে বলেন, সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজনে বিজিবিকেও প্রস্তুত রাখার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।

ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার নজরুল ইসলাম গতকাল কালের কণ্ঠকে বলেন, এই মুহূর্তে রাজধানীতে ছিনতাইকারী ও ডাকাতদলকে নিয়ন্ত্রণ করা বড় চ্যালেঞ্জ।

নারী-শিশু নির্যাতন বেড়েছে : গত দুই মাসে দেশে ধর্ষণের শিকার হয়েছে কমপক্ষে ১০৭ জন। এর মধ্যে ৬৬ জন ১৮ বছরের কম বয়সী শিশু। এ সময় ২২৪ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়।

বেসরকারি মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। সংস্থাটি দেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ নিজস্ব অনুসন্ধানে এসব তথ্য সংগ্রহ করে।

আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ৪০১ জন নারী ধর্ষণ ও দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের ২০২৪ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালে দেশে ১৭ হাজার ৫৭১টি নারী-শিশু নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে।

পুলিশ ও গোয়েন্দা প্রতিবেদন বলছে, চলমান সামাজিক অস্থিরতার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমাজে নারী-শিশু নির্যাতন ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। সর্বশেষ মাগুরায় ধর্ষণের শিকার শিশু নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় চলছে। শিশুটি গত শনিবার থেকে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন। শিশুটির অবস্থা গতকাল রবিবার বিকেল পর্যন্ত অপরিবর্তিত বলে নিশ্চিত করেছে সংশ্লিষ্ট সূত্র। তবে সামরিক হাসপাতালের চিকিৎসক ও  ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শিশুটির চিকিৎসায় সর্বোচ্চ চেষ্টা চালাচ্ছেন বলেও জানিয়েছে সূত্রটি। 

গণপিটুনি বেড়েছে : গণপিটুনিতে নির্বিচারে মানুষ হত্যা বেড়েছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দুই মাসে ৩০টি ঘটনায় গণপিটুনিতে নিহত হয়েছে ১৯ জন। আহত ২০ জন। প্রতিটি ঘটনায় মামলা হলেও সামাজিক অস্থিরতার পাশাপাশি আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার প্রবণতার কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসছে না। পুলিশ, মানবাধিকার সংগঠন ও ভুক্তভোগী সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।

এর আগে গত বছর ২০১টি গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হয় ১৭৩ জন। আহত ৮৮ জন। এই হিসাবে গত বছরের প্রতি চার থেকে পাঁচ দিনে একজন নিহত হয়েছে।

এইচআরএসএসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের আগস্ট থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সাত মাসে গণপিটুনির ১১৪টি ঘটনায় নিহত হয়েছে ১১৯ জন।

সর্বশেষ গত রবিবার একই দিন রাজধানীতে পৃথক স্থানে চুরি ও ছিনতাইকারী সন্দেহে আটজনকে গণপিটুনি দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী এলাকায় চারজন, চকবাজারে দুজন ও মতিঝিলে দুজনকে পিটুনি দেওয়া হয়।

ডাকাতি-দস্যুতা-ছিনতাই বেড়েছে : বনশ্রীতে গুলি করে স্বর্ণ ব্যবসায়ীর ২০০ ভরি স্বর্ণ ও এক লাখ টাকা ছিনতাইয়ের ঘটনার পর মোহাম্মদপুর এলাকায় রিকশা থামিয়ে এক নারীর কাছ থেকে ছিনতাই, হাজারীবাগ এলাকায় ডাকাত পড়ার ঘটনাসহ প্রতিদিন এ ধরনের আরো বহু ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।

পরিস্থিতি সামাল দিতে এর মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কোর কমিটির বৈঠক হয়েছে। এতে অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর কঠোর হওয়ার সিদ্ধান্ত হয় বলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে।

সম্প্রতি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রামে বেদেশ থেকে আসা দুজন প্রবাসী ডাকাতের কবলে পড়েন। ডাকাতদল তাঁদের সর্বস্ব নিয়ে যায়। দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগে কুমিল্লার মিয়াবাজার হাইওয়ে থানার ওসিকে প্রত্যাহার করা হয়। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে রাজশাহীগামী একটি যাত্রীবাহী বাসে ডাকাতির সময় দুই নারীকে শ্লীতাহানির অভিযোগ পাওয়া যায়।

এ ব্যাপারে হাইওয়ে পুলিশের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি দেলোয়ার হোসেন মিয়া গতকাল রবিবার বিকেলে কালের কণ্ঠকে বলেন, স্বীকার করছি সম্প্রতি মহাসড়কে ডাকাতি কিছুটা বেড়েছে। তবে নিয়ন্ত্রণে আমরা নানা উদ্যোগ নিয়েছি।