Image description

এতটা নির্দয় ও নিষ্ঠুর কখনো ছিল না সিলেট। আধ্যাত্মিক রাজধানী খ্যাত জালালাবাদ অঞ্চলের সামাজিক এবং রাজনৈতিক সম্প্রীতি আজ বিলুপ্তপ্রায়। পতিত আওয়ামী শাসনের শেষক’টি বছর ছিল ভয়ঙ্কর। বিশেষ করে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পর থেকে সিলেটের রাজনীতি ‘বিষাক্ত’ রূপ নেয়। ‘শেখ হাসিনা ক্ষমতার আসনে আমৃত্যু থাকবেন’- এমন ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে নেতাকর্মীদের মাঝে। সিলেটে গ্রুপিং-লবিং তথা রাজনৈতিক পোলারাইজেশন ঘটে তখনই।

রাজনৈতিক কর্মীদের বাইপাস করে নিজ নিজ বলয় শক্ত করতে ডেভিল বা খারাপ লোকদের কাছে টানতে শুরু করেন সিনিয়র গ্রুপ লিডাররা। বিষয়টি এমন ছিল- ‘যাই করো, তোমরা শেষ পর্যন্ত আমার সঙ্গে থাকো।’ ওই সময় হাইকমান্ড থেকে চাপিয়ে দেয়া অনেককে নেতা হিসেবে মানতে হয় সিলেটের স্থানীয় রাজনীতিকদের। যদিও এ নিয়ে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব ছিল ৫ই আগস্ট তাদের পতনের দিন পর্যন্ত। আরোপিত এবং মাঠের নেতাদের অসুস্থ প্রতিযোগিতার সুযোগ কাজে লাগায় বিভিন্ন উপ-গ্রুপের আশ্রয়ে থাকা অপরাধী চক্র। তারা নেতাদের পেছনে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান ঠিক রেখে শেষ পর্যন্ত নিজেদের আখের গুছিয়েছে। আধিপত্য বিস্তার, মানুষকে হয়রানি, বাড়িঘর নির্মাণে চাঁদাবাজি, চোরাকারবার, পরিবহন, ফুটপাথ থেকে চাঁদা আদায়, টেন্ডারবাজিসহ হেন কাজ নেই যা তারা করেনি। এতে কোথাও কেউ বাধ সাধলে লেগে যেত দ্বন্দ্ব। তাদের ধরে এনে টর্চার সেলে চলতো বর্বর নির্যাতন। সেই বর্বরতা থেকে নারীরাও রক্ষা পায়নি।
রিপোর্ট বলছে, প্রত্যেক গ্রুপেরই ছিল একাধিক টর্চার সেল। তারা এতটাই বেপরোয়া ছিল যে, কোনো কোনো টর্চার সেল ছিল ওপেন সিক্রেট। দিনের আলোতেই ভিন্নমত এবং তাদের অপরাধের পথে প্রতিবন্ধকদের ধরে এনে নৃশংস নির্যাতন করা হতো। গ্রুপিং রাজনীতির কারণে প্রত্যেক গ্রুপ লিডার ঘটনা-দুর্ঘটনার বিষয়ে অবহিত হতেন, কখনো কখনো আটকদের উদ্ধারে হস্তক্ষেপ করতেন। কিন্তু তারা তা বন্ধে কোনো পদক্ষেপ নেননি। ফলে পথে পথে ওপেন সিক্রেট এসব টর্চার সেলে দিনের পর দিন বহু মানুষ বর্বরতার চরম শিকার হয়েছেন। 

মেজরটিলা টেক্সটাইল মিল এলাকার এক নারী প্রত্যক্ষদর্শীর (আঞ্চলিক ভাষায়) বয়ান ছিল  এমন “আমি এখনো রাতে ঘুমাইতে পারি না ভাই। ঘুমের ঘোরে ওউ পুয়াটার কান্না হুনি। পুয়াটায় বারবার চিৎকার করে কইছলো আমারে গুল্লি করি মারিলা, তবুও পিঠাইছনা। আধ-মরা করে পুয়াটারে ফার্মেসির বেঞ্চে শুয়াইলো কাফিরর বাচ্ছারা। আমি বেটি মানুষ, তবুও মনে হইছে হাসপাতাল নিয়া যাই’।

ভিকটিম ছেলেটা মেজরটিলা এলাকার বাইরের (বহিরাগত) ছিল এমন দাবি করে ওই গৃহবধূ জানান, তারা পরবর্তীতে তাকে হাসপাতালে পাঠিয়েছে। কেবল ধরে এনে নির্যাতন নয়, স্থানীয়দেরও নানাভাবে ডিস্টার্ব করতো ওরা। ভয়ে কেউ কাউকে মুখ খুলতো না, উদ্ধার দূরে থাক। সাধারণরা তাদের পাশ দিয়ে যেতেও সাহস করতেন না। প্রত্যক্ষদর্শীদের দেয়া তথ্য মতে কেবল মেজরটিলা, শাহপরান এলাকা নয়, সিলেটে পথে পথে ছিল অন্তত অর্ধশত টর্চার সেল। এখানকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর হল ছিল একেকটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট। অস্ত্র-গোলাবারুদ সবই মজুত থাকতো হলগুলোতে। সেখানে আয়নাঘরের অস্তিত্বও ছিল।  পরিত্যক্ত ঘর বা সিঁড়ির গোড়ায় থাকা রুমে ছাত্রদের ধরে নিয়ে নির্যাতন করতো ছাত্রনেতা নামধারী ডেভিলরা। সিলেটের ক্যাম্পাসগুলোতে আটকে রেখে ধর্ষণ ও নারী শিক্ষার্থীদের মানসিক এবং শারীরিক টর্চারের অনেক প্রমাণ পেয়েছে প্রশাসন।

রিপোর্ট বলছে, ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণকারী ছাত্রলীগের গ্রুপের সঙ্গে না থাকলে, গ্যাং লিডারদের সালাম না দিলে বা বিরোধী মতাবলম্বী হলেই তাদের  শাস্তি ছিল অবধারিত। বর্বর এসব নির্যাতনে অনেকে পরবর্তীতে মারা গেছেন। কেউ পঙ্গুত্ববরণ বা অসুস্থতা নিয়ে জীবন কাটাচ্ছেন। ৫ই আগস্টের পর সিলেটে টর্চার সেলগুলো থেকে লাঠি, হকিস্টিক, ক্রিকেট স্ট্যাম্প, চেইন, লোহার রড ছাড়াও ইলেকট্রিক শক দেয়ার মতো ভয়ঙ্কর নির্যাতন-সামগ্রী উদ্ধার করেছে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা।

গ্রুপভিত্তিক টর্চার সেল, নিয়ন্ত্রকদের যত কীর্তি: সিলেটে আওয়ামী লীগের একটি বড় গ্রুপ হচ্ছে তেলিহাওর। যে গ্রুপের মূল নেতা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান। তার গ্রুপের নিয়ন্ত্রণাধীন দু’টি টর্চার সেলে চলতো নির্যাতনের স্টিম রোলার। নাসির গ্রুপের সেকেন্ড ইন কমান্ড জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সুজেল তালুকদার ও স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা তানভীর আহমদ ছিল ওই দুই সেলের নিয়ন্ত্রক। আখালিয়া বিডিআর স্কুলের পেছনে সুজেল ও তানভীরের দখল করা বাড়িতে ছিল একটি টর্চার সেলের অবস্থান। ওই সেলকে কেন্দ্র করে গোটা এলাকাকে অপরাধের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে তারা। তবে শেষ রক্ষা হয়নি, খোদ হাসিনা আমলেই অস্ত্র, মাদকসহ গ্রেপ্তার হয় সুজেল-তানভীর।

নাসির গ্রুপের আরেকটি টর্চার সেল ছিল জেলা যুবলীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি সেলিম উদ্দিনের এলাকা সাদাটিকরে। ওই সেল পরিচালনা করতো যুবলীগ নেতা আব্দুল হাই, অলিউর রহমান, দুলাল আহমদ ও জুয়েল খান। এলাকার নিয়ন্ত্রণ রাখতে গিয়ে সেলিম উদ্দিনের বাসার গলিতে নিয়ে অনেককে মারধর করা হতো।

সিলেটের নাম্বার ওয়ান ডেভিল খ্যাত রঞ্জিত সরকারের নিয়ন্ত্রণে ছিল অন্তত ১০টি টর্চার সেল। টিলাগড়ের গোপালটিলাস্থ রঞ্জিতের বাসার গলিতে ছিল একটা সেল। এটি পরিচালনা করতো রঞ্জিতের নিকটাত্মীয়  ছাত্রলীগ নেতা রাজিব সরকার। গোপালটিলার বাসিন্দারা জানিয়েছেন- সন্ধ্যা হলে ভয়ে ওই গলি দিয়ে তারা যাতায়াত করতেন না। প্রায় সময় গলি থেকে তারা চিৎকার শুনতেন। এ সেলের নিয়ন্ত্রকদের তালিকায় রঞ্জিতের ভাগ্নে মিঠু তালুকদারের নামও রয়েছে।

মেজরটিলা ওয়ান ব্যাংকের বিল্ডিংয়ের পেছনের অংশ ছিল সিলেটের আলোচিত টর্চার সেল। এ সেলের নিয়ন্ত্রক ছিল রঞ্জিতের সেকেন্ড ইন কমান্ড ওই এলাকার অপরাধের মূল হোতা কাউন্সিলর জাহাঙ্গীর আলম। তার সঙ্গে ছিল জেলা যুবলীগের অর্থ সম্পাদক কামরুল ইসলাম, তার ভাই জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি নাজমুল ইসলাম ও ওয়ান ব্যাংক বিল্ডিংয়ের মালিক কাইয়ূম চৌধুরী। ওই টর্চার সেলে প্রতিদিন গড়ে ৪-৫ জনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। বহুতল ওই বিল্ডিংয়েই ছিল আগ্নেয়াস্ত্রের গোডাউন। জমি কিনতে আসা প্রবাসী, পরিবহন শ্রমিক, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের নির্যাতন করা হতো ওই সেলে। মেজরটিলার সিদ্দিক প্লাজার নিয়ন্ত্রক ছিল কাউন্সিলর রুহেল, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা আমির আলী, যুবলীগ নেতা রুমন আহমদ, যুবলীগ নেতা মোহাম্মদ আলী ওরফে অস্ত্র আলী। মেজরটিলা বাজারের ব্যবসায়ী, টমটম চালক, সিএনজি চালক, ভাসমান হকারদের সেখানে এনে নির্যাতন করা হতো। শাহপরান হাসপাতালের পাশে ছিল জাহাঙ্গীরের ভাগ্নে ও আলোচিত ছাত্রলীগ ক্যাডার হাবিবুর রহমান পংকির টর্চার সেল। তার ভাই ছাত্রলীগ ক্যাডার মুজিবুর রহমান রুহিতের টর্চার সেল ছিএ খাদিম চৌমুহনা সংলগ্ন ছড়ার সঙ্গে যুক্ত একটি আন্ডারগ্রাউন্ডে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন- ওই টর্চার সেলে চিনি বহনকারী ট্রাকের চালকদের মারধর করা হতো। স্থানীয়দের কেউ কেউ ওই সেলকে আয়নাঘরও বলতেন। ৫ই আগস্টে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা ওই টর্চার সেল থেকে বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র ও ভারত থেকে আসা চোরাই পণ্য চা পাতা, চিনি, কসমেটিক্স উদ্ধার করেছে। শাহপরান মাজার গেটের ঠিক উল্টোদিকে প্রত্যাশা কমপ্লেক্স। এর পেছনে আরেকটি টর্চার সেল ছিল পংকি ও রুহিতের সহোদর মিজানুর রহমান রকির। শাহপরান বাজারের ব্যবসায়ী, এলাকার প্রবাসীরা চাঁদা না দিলে তাদের ওই টর্চার সেলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। রাতে চলতো অসামাজিক কাজও। ৫ই আগস্টের পর গা ঢাকা দিয়েছিল দুর্ধর্ষ ওই ছাত্রলীগ ক্যাডার। শ্বাসরুদ্ধকর এক অবস্থা থেকে মোটামুটি মুক্তি পেয়েছিল শাহপরান এলাকা। কিন্তু ৬ মাসের ব্যবধানে তারা ফের আতঙ্কিত। রকি এখন ছাত্রদল পরিচয়ে প্রকাশ্যে আসার চেষ্টা করছে জানিয়ে এক ব্যবসায়ী বলেন, স্থানীয় এক ছেলেকে ধরে নিয়ে নির্যাতনের কারণে রকির সঙ্গে এলাকাবাসীর দ্বন্দ্ব হয়। পাশের মৎস্যজীবী দু’টি গ্রামের মানুষের ওপর নানাভাবে অত্যাচার করতো তারা। প্রায়ই মৎস্য ব্যবসায়ীদের ধরে নিয়ে যেতো। এ নিয়ে বিচার সালিশ হয়েছে বহুবার, কিন্তু কাজ হয়নি। এক পর্যায়ে গোটা গ্রামবাসী রকি, পংকি, তার বাবা রাজা মিয়া এবং মামা কমিশনার জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। আতঙ্কিত ওই ব্যবসায়ী মানবজমিন প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে বলেন, ৫ই আগস্টের আগে রকিরা ছিল আওয়ামী লীগ। এখন ফেসবুকে পোস্ট দিচ্ছে সে নাকি বিএনপি।রাজনৈতিক পরিচয় যাই হোক, আমরা তাদের অত্যাচার থেকে বাঁচতে চাই।

চিনি চোরাচালানে ভাগ বসাতে বিসিকে টর্চার সেল:

বিসিক শিল্প নগরী এলাকায় ছাত্রলীগ ক্যাডার আহমদ সাজন এবং সুরমা গেইটে হাসান আহমদ আরও দুটি টর্চার সেল গড়ে তুলে। সিলেট-তামাবিল রুটের চলাচলকারী চিনি চোরাচালানে ব্যবহৃত ট্রাকের চালকদের বন্দি রাখা হতো ওই দুটি টর্চার সেলে। প্রায় সময় চিনি লুট করে দু'টি সেলে রাখা হতো। ৫ই আগস্ট স্থানীয়রা হাসানের বাড়ি ও মোটরসাইকেলের দোকানে আগুন দেয়। সেই সঙ্গে তার টর্চার সেলও গুঁড়িয়ে দেয়। দাসপাড়ায় ডেভিল রঞ্জিত সরকারের ঘনিষ্ঠ সিনিয়র সাইফুল ইসলাম তার প্রতিষ্ঠান সাইফুল এন্টারপ্রাইজের পেছনকে টর্চার সেল হিসেবে ব্যবহার করতো। বর্তমানে সাইফুল পলাতক। এ ছাড়া এমসি কলেজে ছাত্রলীগ সভাপতি দেলোয়ার হোসেন রাহী, সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ সভাপতি রুহেল দুটি টর্চার সেল চালাতো। স্থানীয়  কামরুল ও সাবেক ছাত্রনেতা দেবাংশু দাস মিঠুর নেতৃত্বে এমসি কলেজ হোস্টেলে আরেকটি টর্চার সেল ছিল। ডেভিল রঞ্জিত সরকারের নিয়ন্ত্রিত ছাত্রলীগ ক্যাডাররা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে আরও দুটি টর্চার সেল গড়ে তুলেছিল। ডেথ জোন খ্যাত টিলাগড়ের এক সময়ের অধিপতি মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আজাদুর রহমান আজাদ। হাসিনা সরকারের পতনের বহু আগে থেকেই তার গ্রুপের শক্তি কমতে থাকে। তারপরও নিভু নিভু আলোতে নিজের গ্রুপটাকে ধরে রাখার চেষ্টা করেন পারিবারিকভাবে প্রভাবশালী কমিশনার আজাদ। তার গ্রুপের নেতাদেরও একটি টর্চার সেল ছিল।

বালুচরে মসজিদ সংলগ্ন চৌরাস্তায় সবচেয়ে বড় টর্চার সেল নিয়ন্ত্রণ করতো আলোচিত কাউন্সিলর ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিরণ মাহমুদ নিপু। প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে তার গ্রুপের অনুসারীরা ওই এলাকায় মহড়া দিতো।  সম্প্রসারিত সিটি হওয়ায় বালুচরে তখন অনেকে বাসাবাড়ি করছে। বিভিন্ন নামে তাদের চাঁদার জন্য বাধ্য করতো নিপু, রাজি না হলে ধরে এনে সেলে রেখে নির্যাতন করতো। দু'বছর আগে নিপু গ্রুপের সদস্যরা দলবদ্ধ হয়ে সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা আরিফ আহমদকে কুপিয়ে খুন করে। এ ঘটনায় নিপুর বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়। এতে তার গ্রুপের ১০ ক্যাডারসহ তাকে জেলে যেতে হয়। 

জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক প্রবাসীকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমানের কাছের লোক টিলাগড়ের আলোচিত হেরোইন সম্রাট কবির ওরফে হেরোইন কবিরের টর্চার সেল ছিল পূর্ব শাপলাবাগে। দেশ কাঁপানো জঙ্গি নেতা শায়খ আব্দুর রহমানের এক সময়ের আস্তানা পূর্ব শাপলাবাগ। সূর্যদীঘল বাড়ি খ্যাত সেই আস্তানা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। অভিশপ্ত সূর্যদীঘল বাড়ির পাশেই  হেরোইন কবিরের আস্তানা। স্থানীয়রা জানান, এলাকায় প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে প্রতিবাদী বা প্রতিপক্ষের লোকজনকে ধরে নিয়ে কবির তার সেলে রেখে নির্যাতন করতো। হাসিনা সরকারের প্রথমদিকে হেরোইন ও ইয়াবার অন্যতম প্রধান হাট ছিল পূর্ব শাপলাবাগ।

বাগবাড়ি থেকে রিকাবীবাজার বিধান গ্রুপের ৩ টর্চার সেল:
সিলেটের আলোচিত ক্যাডার ও নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বিধান কুমার সাহার নেতৃত্বে নগরীর বাগবাড়ির আখড়া মন্দির, মনিকা সিনেমা হলের সামনে এবং রিকাবীবাজার স্টেডিয়াম এলাকায় তিনটি টর্চার সেল ছিল। বাগবাড়ি আখড়া মন্দির সেলের নিয়ন্ত্রণ করতো বিধানের নিকট আত্মীয়  মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক বিদ্যুৎ ভূষণ দেব। সঙ্গে যুবলীগ নেতা বিপ্লব দাশ, শিবু দাশ, গোবিন্দ দাশ, সৌমিত্র সেন, টিপু দত্ত পুরকায়স্থসহ জেলার ছাত্রলীগের দুর্ধর্ষ ক্যাডাররা। ওই সেলের নানা কাহিনী এখন মানুষের মুখে মুখে। মদিনা মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ী, পরিবহন শ্রমিকরা তাদের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। রিকাবীবাজার ছিল তার অন্যতম টর্চার সেল। পুরাতন একটি ভবন দখলে নিয়ে সেখানে এটি গড়ে তোলা হয়। এ সেলের নিয়ন্ত্রক বিধানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী জেলা যুবলীগ সম্পাদক শামীম ওরফে সীমান্তিক শামীমের বন্ধু জেলা যুবলীগের সহ-সভাপতি হাসান আহমদ চৌধুরী, মদন মোহন কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি অরুন দেবনাথ সাগর, জেলা যুবলীগের সদস্য খালেদ আহমদ, সুহেল ওরফে বোঙ্গা সুহেল, মদন মোহন কলেজের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক মিফতাহুল হোসেন লিমন। ওসমানী মেডিকেল এলাকায় মনিকা সিনেমা হলের সামনে একটি দোকানে টর্চার সেল চালাতো বিধান গ্রুপের নেতা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি  ছাত্রলীগ প্রেসিডেন্ট সাগর হোসাইন। সঙ্গে ছিল ছাত্রলীগের সাবেক নেতা আলী আহমদ। পরবর্তীতে সাগর গ্রুপ বদলায়। সে নগরের আসাদ গ্রুপের নেতা হিসেবে ওই টর্চার সেলের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখে। মহানগর

ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এমএইচ ইলিয়াস দিনার দরগাহ গেইট এলাকায় একটি টর্চার সেল নিয়ন্ত্রণ করতো। বিশেষ করে সিলেট, কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট থেকে আসা চোরাই চিনির ট্রাক চালকদের ওই সেলে নিয়ে নির্যাতন করা হতো। সিলেটের আলোচিত ক্যাডার পীযূষ ছিল ভয়ঙ্কর। প্রকাশ্য অস্ত্র হাতে সে একাধিকবার নগরীতে মহড়া দিয়ে আলোচনায় আসে। জল্লারপাড় ওয়াকওয়ে ও দাড়িয়াপাড়াস্থ পাঁচভাই রেস্টুরেন্টের গলিতে দু'টি টর্চার সেল ছিল তার। এ সেল দু'টি পরিচালনা করতো মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক সজল দাস অনিক, আকাশ সহ কয়েকজন দুর্ধর্ষ ক্যাডার। এ দুটি টর্চার সেল নিয়ে অতিষ্ঠ ছিলেন জিন্দাবাজারবাসী। দুটি টর্চার সেলের নানা ঘটনা বিভিন্ন সময় নগরে আলোচিত হয়েছে। এক সময় পীযূষ নগরের মাছুদিঘীরপাড়ের প্রবেশমুখের উল্টোপাশে জমি দখল করে টর্চার সেল গড়ে তুলে। ওই এলাকা থেকে পীযূষ অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান জমিটির নিয়ন্ত্রণ নিলে পীযূষের বাহিনী আস্তানা পরিবর্তন করে। 

পীরমহল্লার মূর্তিমান আতঙ্ক আফতাবের টর্চার সেল এবং...: 
সিলেট মহানগরীর সুবিদবাজার এলাকার অপরাধ রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ ছিল সাবেক কাউন্সিলর নগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি আপ্তাব হোসেন খানের। তার নেতৃত্বে তিনটি আলোচিত টর্চার সেল ছিল। জমি দখলে বাধা কিংবা চাঁদা দিতে অস্বীকৃতি জানালেই ওইসব সেলে এনে টর্চার করা হতো নিরীহ লোকজনকে। এর মধ্যে আলোচিত টর্চার সেল ছিল আপ্তাবের পীরমহল্লা এলাকায় দখল করা একটি বাড়ি। প্রকাশ্য দিনদুপুরে ওই বাড়িতে নিয়ে লোকজনকে নির্যাতন করা হতো। এ নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ এয়ারপোর্ট থানায় দায়ের করা হলেও পুলিশের কোনো অ্যাকশন ছিল না।  পীর মহল্লার টর্চার সেল নিয়ন্ত্রণে ছিল আপ্তাবের ভাই আমির হোসেন, মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম সুমন, অর্থ সম্পাদক শাহনূর আহমদ, ক্যাডার রুহিন, ফয়সল আহমদ, সায়মন্ড। আপ্তাবের অন্যতম সহযোগী কুখ্যাত ক্যাডার বাবুল হোসেন ওরফে পাঙ্গাশ নিয়ন্ত্রণ করতো বাদাম বাগিচার টর্চার সেল। ওই এলাকার কলোনির বাসিন্দা, ভাসমান হকার, রিকশা ও টমটম চালকরা চাঁদা না দিলে পাঙ্গাশ তার টর্চার সেলে ধরে এনে নির্যাতন করতো। বনখলাপাড়ার শেষ প্রান্তে ছিল আরেকটি টর্চার সেল।

ওয়ার্ড স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা রুবেল আহমদ ও মঞ্জুর আহমদ ওই সেলে লোকজনকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করতো। আম্বরখানা পয়েন্ট সংলগ্ন হোটেল হিমেলের ছাদে একটি টর্চার সেল ছিল। এ সেলের নিয়ন্ত্রক ছিল ছাত্রলীগ সম্পাদক রাহেল সিরাজ। ওই টর্চার সেলে এক ব্যবসায়ীকে মারধরের ঘটনায় সিরাজের সহযোগী সাদ্দাম গ্রেপ্তার হয়েছিল। ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক রাহেল সিরাজের নিয়ন্ত্রণে ছিল বড়বাজার ও সাপ্লাই এলাকার আরও দুটি টর্চার সেল। বড়বাজার এলাকায় দু’বছর আগে সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হন বিএনপি নেতা আ ফ ম কামাল। জনশ্রুতি আছে; রাহেল সিরাজের সহযোগী সশস্ত্র ক্যাডাররা আ ফ ম কামালকে খুন করে। এ ঘটনায় সন্ত্রাসী রাজু সহ কয়েকজন গ্রেপ্তার হয়। সাপ্লাই গলির মুখে রাহেল সিরাজের টর্চার সেল নিয়ন্ত্রণ করতো গোয়াইনঘাট উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি সুফিয়ান আহমদ সহ কয়েকজন। রাহেলের ভাই রুমেল সিরাজ ও জৈন্তাপুরের আলমগীর হোসেনেরও ওই সেলে নিয়ন্ত্রণ ছিলো।