
ভোগান্তি রাজধানী ঢাকার মানুষের নিত্য সঙ্গী। ঘর থেকে বের হলেই ভোগান্তি। শব্দদূষণ, বায়ুদূষণ, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা, খানাখন্দের কারণে নগরবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হয়। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশাসন ও পুলিশ বাহিনীর অদক্ষতা ও দায়িত্ব পালনে অমনোযোগিতা। হাসিনা পালিয়েছে, অথচ ওই সময়ের ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় যানবাহনগুলো এখনো দাপিয়ে চলাচল করছে পুলিশের চোখের সামনেই। এতে করে নগরীর মধ্যেও দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ঘটছে। ক্ষমতার পরিবর্তন হলেও নগরবাসীর দুর্ভোগের পরিসমাপ্তি ঘটেনি।
বনানীর ব্যস্ত সড়কে গতকাল দুর্ঘটনায় নারী শ্রমিকের মৃত্যুতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় পবিত্র রমজান মাসেও রাজধানীর বাসিন্দাদের দীর্ঘ ৮ ঘণ্টা অসহনীয় যানজটের ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি ইউটার্নে গতকাল সোমবার ভোর ৬টায় ট্রাকচাপায় এক নারী পোশাক শ্রমিকের মৃত্যু এবং অপর একজন আহত হন। এর জেরে পোশাক শ্রমিকরা বনানী চেয়ারম্যানবাড়ি সড়কের উভয় পাশ ৮ ঘণ্টা অবরোধ করে রাখেন। পরে বেলা ২টায় যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এ সময় বিক্ষোভকারীরা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতেও যানবাহন চলাচল বন্ধ রাখেন। দু’টি পোশাক কারখানার শ্রমিকেরা ওই এলাকার সড়ক অবরোধ করেন। এতে বনানী, মহাখালী, গুলশান, কাকলী, এয়ারপোর্ট রোড, সাতরাস্তা ও প্রগতি সরণিসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোতে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পড়েছে সারা ঢাকা শহরে। সকাল থেকে অফিসগামী মানুষসহ সাধারণ মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়েন। চরম ভোগান্তি নিয়ে অনেক বিদেশগামী যাত্রী পায়ে হেঁটে বিমানবন্দরে পৌঁছান। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দ্রুত ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায় এ ধরনের অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। যথাসময়ে আন্দোলনরত শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা হলে এত দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হতো না বলে সাধারণ মানুষের অভিযোগ।
সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনরত বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা বলছেন, দুর্ঘটনার পর পুলিশ দ্রুত ঘটনাস্থলে পৌঁছায়নি। পুলিশ বিলম্বে যাওয়ায় বিক্ষোভকারীদের সাথে সরকারবিরোধী লোকজন জমায়েত হয়। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশের অভাবে পুলিশের ‘দৃশ্যমান’ অনুপস্থিতি রাস্তায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা থাকা সাধারণ মানুষ অসহায় হয়ে পড়েন। পুলিশের উচ্চ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাও মাঠে ছিলেন না। এমনকি সরকারের কোনো কর্তাব্যক্তি গিয়ে তাদের বুঝিয়ে-সুজিয়ে বাড়ি পাঠাতেও পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে পুরো ঢাকা শহরের অচল রাস্তাকে সচল করার বিষয়ে ন্যূনতম দায়িত্ব নিতে কাউকে দেখা যায়নি।
বিষেজ্ঞরা বলছেন, বনানীর এই দুর্ঘটনাকে নিছক একটি দুর্ঘটনা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি শুধু নগর ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার প্রতিচিত্র না, এর মধ্য দিয়ে বিদ্যমান অন্তর্বর্তী সরকারের সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক অদক্ষতা সবার সামনে উঠে আসে। এই অদক্ষতা মানুষকে ক্ষুব্ধ করছে। সেই জনক্ষোভকে সরকার আমল না দিলে সামনের দিন আরো খারাপ হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
জানা গেছে, গতকাল সোমবার সকাল ৬টায় রাজধানীর বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় নারী পোশাক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। নিহত পোশাক শ্রমিকের নাম মিনারা আক্তার। আহত আরেক পোশাক শ্রমিকের নাম সুমাইয়া আক্তার। তাকে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এ ঘটনায় সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাস্তা অবরোধ করে রাখেন গার্মেন্টস শ্রমিকরা। বেলা ২টায় তারা সড়ক ছাড়েন। পরে সড়কের যান চলাচল স্বাভাবিক হয়। এদিকে বনানীতে পোশাক শ্রমিক নিহত ঘটনায় সেই গাড়ি রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে স্থগিত করেন বিআরটিএ।
সকাল সাড়ে ১০টার দিকে এক্সপ্রেসওয়েতে যানজট কিছুটা কমে আসে। তবে এরপর আবার বনানীর চেয়ারম্যানবাড়িতে এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। জানা গেছে, পোশাক শ্রমিকেরা সেখানে গাড়ি চলতে দেয়নি। এ বিষয়ে ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ওঅ্যান্ডএম কোম্পানির ট্রাফিক সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটি বিভাগের প্রধান হাসিব হাসান খান বলেন, বনানী চেয়ারম্যানবাড়ির কাছে গার্মেন্টস শ্রমিকরা এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধ করায় আমাদের প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা এই সড়ক বন্ধ ছিল। পরে ফের সড়ক স্বাভাবিক হয়।
বেসরকারি চাকরিজীবী গোলাম ওয়াদুদ বলেন, বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে বাসে কারওয়ান বাজারে কর্মস্থলে যাচ্ছিলেন তিনি। সকাল পৌনে আটটার দিকে বনানীতে যানজটে আটকা পড়েন। বাস না চলায় নেমে এক ঘণ্টার বেশি সময় হেঁটে তিনি কর্মস্থলে পৌঁছেছেন। শুধু গোলাম ওয়াদুদই নয়, গতকাল বনানীতে সড়ক অবরোধ হওয়ায় এমন ভোগান্তির শিকার হয় হাজার হাজার মানুষ। রাস্তায় আটকে পড়া মো. সুমন নামে এক যাত্রী বলেন, উত্তরায় যাব বলে বাসে উঠেছি। কিন্তু জাহাঙ্গীর গেট থেকে গাড়ি সামনে যাচ্ছে না। পরে শুনতে পারলাম বনানীতে রাস্তা অবরোধ। এখন গাড়ি সামনেও যাচ্ছে না পেছনেও যাচ্ছে না, কী একটা অবস্থা। এক ঘণ্টা ধরে গাড়িতে বসে থেকে বাসায় ফিরে যাই।
যানজটের বিষয়ে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগের দায়িত্বরত মহাখালী জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) আরিফুল ইসলাম রনি বলেন, সকালে বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি ইউটার্ন ইনকামিংয়ে একজন নারী পোশাক শ্রমিকের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহতকে কেন্দ্র করে প্রায় ৮ ঘণ্টা সড়ক অবরোধ করে রাখে পোশক শ্রমিকরা। এ ক্ষেত্রে বনানী-কাকলী ক্রসিং এবং মহাখালীর আমতলীতে ডাইভারশন দিয়ে গুলশান-২ ও গুলশান ১ হয়ে আমতলী দিয়ে ইনকামিং এবং ভাইস ভার্সা হয়ে আউটগোয়িং এ চলাচল করার ব্যবস্থা করা হয়। বেলা ২টার পর যান চলাচল স্বাভাবিক হয়।
এ বিষয়ে বনানী থানার ওসি রাসেল সরকার বলেন, আন্দোলন করেন তিনটি পোশাক কারখানার শ্রমিকরা। যাদের অধিকাংশের বাড়ি কড়াইল বস্তি। তাই বস্তির লোকজন আন্দোলনে যুক্ত হয়। তারা নিহত শ্রমিকের লাশ নিয়ে মিছিল করে। আন্দোলনকারী শ্রমিকদের আমরা বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেছি তারা এই ঘটনার বিচার পাবে এবং এ ক্ষেত্রে তাদের প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা করা হবে। সকাল থেকে তাদের আমরা বুঝিয়ে আসছি কিন্তু তারা আমাদের কথা শুনছেন না। তারা উল্টো পুলিশের প্রতি মারমুখী আচরণ করে। বনানীতে রাস্তা বন্ধ থাকার কারণে সারা ঢাকায় যানজট ছড়িয়ে পড়ে। পরে ২টায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।
এদিকে পোশাক শ্রমিক নিহত ঘটনায় সেই গাড়ি রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে স্থগিত করে বিআরটিএ। গতকাল বিকালে বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-২ উপ-পরিচালক মো. সানাউল হক এর সই করা এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, মোটরযানটি ঢাকার বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি এলাকায় সকাল ছয়টার দিকে সড়ক দুর্ঘটনায় পতিত হয়ে একজন নারী পোশাক শ্রমিক নিহত হয়েছেন ও একজন আহত হন। এ অবস্থায় সড়ক পরিবহন বিধিমালা-২০২২ এর বিধি ৪৬ অনুযায়ী ঢাকা মেট্রো-ন-১৪-০৭৬২ নম্বর মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হলো এবং মোটরযানটির রেজিস্ট্রেশন সনদ, ট্যাক্স টোকেন, ফিটনেস সনদ, রুট পারমিট ও উক্ত মোটরযানের চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সসহ আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে ঢাকা মেট্রো-২ সার্কেলে হাজির হওয়ার জন্য অনুরোধ করা হলো। অন্যথায় ঢাকা মেট্রো-ন-১৪-০৭৬২ নম্বর মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন স্থায়ীভাবে বাতিল করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে বিআরটিএ ঢাকা মেট্রো-২ উপ-পরিচালক মো. সানাউল হক বলেন, গাড়ির মালিককে একাধিকবার ফোন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ফোন বন্ধ থাকায় তাকে পাওয়া যাচ্ছে না। আগামী তিন কার্যদিবসের মধ্যে পাওয়া না গেলে সেই মোটরযানের রেজিস্ট্রেশন স্থায়ীভাবে বাতিল করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য, ট্রাকটি পরে তেজগাঁও থানা পুলিশ আটক করে। সিসিটিভি ফুটেজ দেখে তেজগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে গাড়িটি আটক করা হয়। তবে চালক পালিয়ে গেছেন। তাকে আটক করার চেষ্টা চলছে বলে পুলিশ জানিয়েছে।