
বিচার বিভাগকে স্বাধীন, নিরপেক্ষ ও কার্যকর করার লক্ষ্যে সংবিধানে ২৯ অনুচ্ছেদে সংশোধন আনার প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। কিছু উপ-অনুচ্ছেদ সংবিধান থেকে যোজন-বিয়োজন করার সুপারিশ করা হয়েছে কমিশনের প্রতিবেদনে। উচ্চ আদালতে বিচারপতি নিয়োগ, পৃথক বিচার বিভাগ সচিবালয় প্রতিষ্ঠা, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা হ্রাস এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠাসহ বিচার বিভাগের বিভিন্ন বিষয় সংস্কারে সংবিধানের এসব সংশোধন জরুরি বলে মনে করে কমিশন। গত ৫ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগের সাবেক বিচারপতি শাহ আবু নাঈম মোমিনুর রহমান নেতৃত্বাধীন এ কমিশন অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধান উপদেষ্টার হাতে এ প্রতিবেদন তুলে দেন।
প্রতিবেদনে সংবিধানের ৪৮, ৪৯, ৫৫, ৮৮, ৯৪, ৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮, ৯৯, ১০০ ও ১০১, ১০২, ১০৩, ১০৪, ১০৫, ১০৬, ১০৭, ১০৮, ১০৯, ১১০, ১১১, ১১২, ১১৩, ১১৪, ১১৫, ১১৬, ১৪৭ এবং ১৫২ অনুচ্ছেদে সংশোধনের প্রস্তাব দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন। এসব অনুচ্ছেদের কিছু জায়গায় সংশোধন এবং কিছু অনুচ্ছেদে নতুন করে উপ অনুচ্ছেদ সংযোজনের সুপারিশ করা হয়েছে। সংস্কার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারকদের নিয়োগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে সীমিত করে নিয়োগ কমিশনকে ক্ষমতায়িত করা, ৫৫(২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে প্রধানমন্ত্রীর নির্বাহী ক্ষমতা থেকে প্রধান বিচারপতি এবং অন্য বিচারকদের নিয়োগের বিষয়কে পৃথক করা, ৯৪ অনুচ্ছেদ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির মতকে প্রাধান্য দেওয়া এবং আপিল বিভাগের ন্যূনতম বিচারক সংখ্যা ৭ (সাত) জন করার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া ৯৫ অনুচ্ছেদে সংশোধন করে রাষ্ট্রপতি আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম বিচারককেই প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করবেন মর্মে বিধান করার কথা বলা হয়েছে। বিচারক হিসেবে নিয়োগের যোগ্যতা পরিবর্তন বিষয়ে প্রস্তাবে বলা হয়েছে, প্রার্থীকে কেবলমাত্র বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে এবং তার বয়স অন্যূন ৪৮ বছর হতে হবে। বিচারকদের অবসরের বয়স বিদ্যমান ৬৭ বছরের পরিবর্তে ৭০ করা, যা ভবিষ্যতে নিযুক্ত বিচারকদের জন্য প্রযোজ্য হবে। বিদ্যমান ১০ বছরের পেশাগত অভিজ্ঞতার পরিবর্তে ১৫ বছরের পেশাগত বাস্তব অভিজ্ঞতার বিধান অন্তর্ভুক্ত করা। সংবিধানে নতুন বিধান ৯৫(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজনের মাধ্যমে বিচারপতি নিয়োগ কমিশনের বিধান করার কথা বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। সুপ্রিম কোর্ট সচিবালয় প্রতিষ্ঠা এবং স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস প্রতিষ্ঠার জন্য ৬৪(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশনের ৩৫২ প্রতিবেদনে ৩২ বিষয়ে সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে। এর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নিয়োগ ও শৃঙ্খলা, অধস্তন আদালতের বিচারকদের নিয়োগ ও চাকরির শর্তাবলি, স্থায়ী অ্যাটর্নি সার্ভিস, স্বতন্ত্র ফৌজদারি তদন্ত সার্ভিস, বিচার বিভাগ সংশ্লিষ্ট সংবিধান সংশোধন, অধস্তন আদালতের সাংগঠনিক কাঠামো, বিচার বিভাগের আর্থিক স্বাধীনতা, বিচার কার্যক্রমে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার, অধস্তন আদালতের ভৌত অবকাঠামো, আদালত ব্যবস্থাপনা অন্যতম। পাশাপাশি বিচারপ্রার্থীদের হয়রানি, বিচার বিভাগের দুর্নীতি প্রতিরোধ, আইনগত সহায়তা, বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি, মামলাজট হ্রাস, গ্রাম আদালত, আইনের সংস্কার, বিচারক ও সহায়ক জনবলের প্রশিক্ষণ, আইন পেশার সংস্কার, আইন শিক্ষার সংস্কার, মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা প্রতিরোধ, বিচারহীনতার সংস্কৃতি এবং সামাজিক ও নৈতিক মূল্যবোধ উন্নয়নেও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। বলা হয়েছে, বিচারকদের ছুটি, বিভিন্ন দিবস উদযাপন, আদালতে প্রকাশ্যে পরবর্তী তারিখ ঘোষণা না করা, আইনজীবীর মৃত্যুতে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ রাখা ইত্যাদি কারণে বিচারপ্রার্থীরা যে হয়রানির শিকার হন, তা বন্ধ করতে হবে।