
নানা পথ ও মতকে এক কাতারে নিয়ে এগোতে চায় জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। এর সবকিছুই হবে আলোচনার টেবিলে। আর এই চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলোর ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কমিশনগুলোর সুপারিশ আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌঁছাতে চায় কমিশন।
পাশাপাশি স্বল্প সময়ের মধ্যে ঐকমত্যে পৌঁছে ‘জাতীয় সনদ’ তৈরি করতে চায় তারা। এ ছাড়া শিগগিরই নির্বাচন নিয়ে আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে কমিশনের পক্ষ থেকে। গতকাল জাতীয় সংসদ ভবনের এলডি হলে সরকার গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলো পর্যালোচনা ও গ্রহণ করার লক্ষে গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য বদিউল আলম মজুমদার, ইফতেখারুজ্জামান চৌধুরী, আবদুল মুয়ীদ চৌধুরী, সফররাজ হোসেন, এমদাদুল হক ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার উপস্থিত ছিলেন। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, আমরা রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোর প্রতি যত দ্রুত সম্ভব মতামত জানাতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাই। এ প্রক্রিয়ার পরের ধাপ রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর নির্ভর করছে। আমরা চাই দ্রুত আলোচনা করতে এবং স্বল্প সময়ের মধ্যেই ঐকমত্যে পৌঁছে একটি জাতীয় সনদ তৈরি করতে। তিনি বলেন, সংস্কারের জন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ১৬৬টি সুপারিশের বিষয়ে ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে মতামত চেয়েছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ১৩ মার্চের মধ্যে দলগুলো মতামত জানাবে বলে তারা আশা করছেন। দলগুলোর মতামত পাওয়ার পর শুরু হবে আলোচনা। আলোচনার সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঠিক হয়নি। যখন যে দলের মতামত পাওয়া যাবে, সে সময় থেকেই আলোচনার শুরু হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সংবাদ সম্মেলন শেষে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এরই মধ্যে কয়েকটি রাজনৈতিক দল সময় চেয়েছে। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হয়তো সম্ভব হবে না। তবে সময় বিবেচনা করে আমরা ঈদের আগেই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করতে চাই। সুপারিশগুলোর বিষয়ে কতটি দল একমত হলে সেটি ঐকমত্য ধরা হবে এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, সংখ্যাই কেবল বিবেচ্য বিষয় নয়। আমরা আশা করছি, অধিকাংশ প্রস্তাবের বিষয়ে অধিকাংশ দলই একমত হবে। সেটা হলে সবচেয়ে ভালো হবে আমাদের জন্য। কাজটি সহজ হবে, খুব সহজেই আমরা অগ্রসর হতে পারব। কিন্তু সংখ্যার বিবেচনা যেমন আছে, তেমনি এটাও বিবেচনা করতে হবে, প্রতিটি রাজনৈতিক দলের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান এবং ভিন্ন ভিন্ন শক্তির প্রভাব বিভিন্নভাবে সমাজে আছে। আমাদের এটাও বিবেচনা করতে হবে। কাজেই আমরা পূর্বনির্ধারিত ধারণা নিয়ে এখনই অগ্রসর হচ্ছি না। এগুলোর গুরুত্বকে আমরা বিবেচনা করব। আমরা বারবার বলছি, আমরা আলাপ-আলোচনা করব। কেবল টিক চিহ্নের ওপর নির্ভর করছি না। আমরা মনে করি, আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে অনেক বিষয়ে একমত হতে পারব। সেক্ষেত্রে সংখ্যা এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক দলকে যদি আমরা একমত করতে পারি, তাহলে সেটা গ্রহণযোগ্য হবে। সুপারিশের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে সময় লাগলে, সেটি নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচন এবং সংস্কার প্রক্রিয়ার মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। ফলে নির্বাচনের যে সময়সূচি তৈরির চেষ্টা চলছে, ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন করার ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহম্মদ ইউনূস বলেছেন, সরকারের পক্ষ থেকে বারবার বলা হয়েছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে আশা করি খুব শিগগিরই এ ব্যাপারে আরও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ আসবে। ফলে সংস্কার কমিশনের কাজ বা ঐকমত্য কমিশনের কাজের কারণে নির্বাচনি প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণ আমি দেখি না। সুপারিশে মতামতের ক্ষেত্রে বিকল্প হিসেবে আংশিকভাবে একমত রাখা হয়েছে। এসব মতামতের পরিণতি কী হবে বাংলাদেশ প্রতিদিনের এমন প্রশ্নে আলী রীয়াজ বলেন, এসব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। অর্থাৎ এগুলো ফয়সালা হবে আলোচনার টেবিলে। এ সময় সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, কেবল রাজনৈতিক দল নয়, দেশের প্রত্যেকটি নাগরিকের সব সংস্কারের বিষয়ে সুস্পষ্ট মতামত দেওয়ার অধিকার রয়েছে। এ জন্য ওয়েবসাইটের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নাগরিকদের মতামত জানতে চাওয়া হবে।
ঐকমত্য কমিশনের লিখিত বক্তব্য : সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর অনুরোধের প্রেক্ষিতে ৩৪টি রাজনৈতিক দলের কাছে ছয়টি কমিশনের পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনের হার্ড কপি ২২ ফেব্রুয়ারির মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হয়। আগে সব দলকে প্রতিবেদনগুলোর সফট কপিও প্রেরণ করা হয়েছে। তিনি আরও জানান, এরপর ঐকমত্য কমিশনের সদস্যরা তিন দফা বৈঠকে মিলিত হন এবং সংশ্লিষ্ট কমিশনগুলোর প্রতিবেদন থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশগুলোকে চিহ্নিত করা হয়। পরে পাঁচটি কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশসমূহকে ছকের আকারে বিন্যস্ত করা হয়। এসব ছকে পুলিশ সংস্কার কমিশনের সুপারিশগুলোকে যুক্ত করা হয়নি। কারণ, পুলিশ সংস্কার কমিশন মনে করে, তাদের সুপারিশসমূহ প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব। আলী রীয়াজ আরও বলেন, ছকসমূহ গত ৬ মার্চ ৩৪টি রাজনৈতিক দল ও জোটের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। এতে মোট সুপারিশের সংখ্যা হচ্ছে ১৬৬টি। এর মধ্যে সংবিধান সংস্কার সংক্রান্ত সুপারিশ ৭০টি, নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার বিষয়ে সুপারিশ ২৭টি, বিচার বিভাগ সংক্রান্ত সুপারিশ ২৩টি, জনপ্রশাসন সংক্রান্ত সুপারিশ ২৬টি এবং দুর্নীতি দমন কমিশন সংক্রান্ত সুপারিশ ২০টি। প্রতিটি সুপারিশের ক্ষেত্রে দুটি বিষয়ে মতামত চাওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো সংশ্লিষ্ট সুপারিশের বিষয়ে একমত কি না। এতে তিনটি বিকল্প রাখা হয়েছে। সেগুলো হলো-’একমত’, ‘একমত নই’ এবং ‘আংশিকভাবে একমত’। এ তিনটি বিকল্পের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত জানাতে অনুরোধ করা হয়েছে। দ্বিতীয়টি হলো প্রতিটি সুপারিশের বিষয়ে সংস্কারের সময়কাল ও বাস্তবায়নের উপায়। এ ক্ষেত্রে ছয়টি বিকল্প আছে। সেগুলো হলো- ‘নির্বাচনের আগে অধ্যাদেশের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের আগে গণভোটের মাধ্যমে’, ‘নির্বাচনের সময় গণভোটের মাধ্যমে’, ‘গণপরিষদের মাধ্যমে’ ‘নির্বাচনের পরে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে’ এবং ‘গণপরিষদ ও আইনসভা হিসেবে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে’। এসব ঘরের যে কোনো একটিতে টিক চিহ্ন দিয়ে মতামত দিতে বলা হয়েছে। এর বাইরে প্রতিটি সুপারিশের পাশে দলগুলোর ‘মন্তব্য’ দেওয়ার একটি জায়গা রাখা হয়েছে। গত বছরের অক্টোবরে গঠন করা ছয়টি সংস্কার কমিশন গত ৮ ফেব্রুয়ারি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেয়। এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে ঐকমত্য তৈরি করতে আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে ঐকমত্য কমিশন।