Image description
বাজারে ইতিবাচক প্রভাব, জুলাই-ডিসেম্বরে নিত্যপণ্যের আমদানি ব্যয় কমেছে ৫.৬৬%, সরবরাহ বেড়েছে ২২%

ভোগ্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামাল আমদানির আড়ালে টাকা পাচার বন্ধ হওয়ায় এখন পণ্যের আমদানি বেড়েছে। এতে পণ্যের জোগান বেড়ে মজুত ও খুচরা বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে বাজারে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। কিছু পণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। পাশাপাশি ডলারের হিসাবে আমদানি কমলেও পরিমাণে বেড়েছে। কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমেছে ও এলসির আড়ালে টাকা পাচার বন্ধ হওয়ায় ঋণপত্রের পুরো পণ্যই দেশে আসছে। একই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, বন্দর কর্তৃপক্ষ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর তদারকি বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে নিত্যপণ্যের এমন চিত্র পাওয়া গেছে।

সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলে ওই সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা পালিয়ে যান বা আত্মগোপন করেন। তাদের অনেকেই এখন ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত নেই। এতে নিত্যপণ্যের বাজারে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য অনেকটা কমে গেছে। পাশাপাশি আমদানিকারকের সংখ্যা বেড়েছে। ফলে পণ্যের আমদানি বাড়ছে। আগে আওয়ামী ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরা নিত্যপণ্য আমদানি ও সরবরাহ করার একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। তারা নিজেদের মতো করে পণ্য আমদানি করে তা বাজারজাত করতেন। এতে চট্টগ্রাম ও ঢাকাকেন্দ্রিক বড় ব্যবসায়ীদের একটি গ্রুপ সক্রিয় ছিল। সরকার পতনের কারণে গ্রুপটিও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। ওই সিন্ডিকেট পণ্য আমদানির যে এলসি খুলত তার সব পণ্য আমদানি না করে বিদেশে টাকা পাচার করে দিত। এতে হিসাবে পণ্য বেশি আমদানি হলেও বাস্তবে ছিল কম। গ্রুপটি ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের এলসি খুলতে দিত না। তারা নিজেরা পরিকল্পিতভাবে পণ্য আমদানি ও বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। নিত্যপণ্য তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রেও তারা একইভাবে টাকা পাচার করত। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক তদন্তে এসব তথ্য ওঠে এসেছে।

ভোজ্যতেল, চিনি, ছোলা, পেঁয়াজের বড় আমদানিকারক ছিল এস আলম গ্রুপ। ফলের বড় আমদানিকারক ছিল নাসা গ্রুপ। ওষুধের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত বেক্সিমকো গ্রুপ। এছাড়া আরও কয়েকটি বড় গ্রুপ নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। এসব গ্রুপের বিরুদ্ধে নিত্যপণ্য আমদানির আড়ালে টাকা পাচারের ঘটনা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে উদঘাটিত হয়েছে।

প্রতিবছর রোজার আগে থেকেই নিত্যপণ্যের দাম থাকে ঊর্ধ্বমুখী। সরকার নানা পদক্ষেপ ও হুমকি-ধমকি দিয়েও দাম কমাতে পারে না। কিন্তু এবার সরকার রোজায় অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে নিত্যপণ্যের আমদানি, উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে। পণ্য ও কাঁচামাল আমদানিতে এলসি মার্জিন শিথিল করা হয়েছে। রোজানির্ভর পণ্য ১ থেকে ৫ শতাংশ মার্জিন দিয়েও আমদানি করা যাচ্ছে। এসব পণ্য আমদানিতে ব্যাংকের বেঁধে দেওয়া দামে ডলারের জোগান নিশ্চিত করা হয়েছে। একই সঙ্গে বাকিতে বা বৈদেশিক ঋণ নিয়ে পণ্য আমদানিরও সুযোগ দেওয়া হয়েছে। যেসব উদ্যোক্তা নিত্যপণ্য বা এর কাঁচামাল আমদানি করবেন তাদের অন্যান্য সুবিধাও দেওয়া হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো এলসি ফি বা কমিশন বা অন্যান্য চার্জ ন্যূনতম পর্যায়ে রাখার নির্দেশনা রয়েছে। রোজার অনেক আগে থেকে এসব পদক্ষেপ নেওয়ায় আমদানি যেমন বেড়েছে, তেমনি এলসি খোলার হারও বেড়েছে। ফলে সরবরাহ বেড়েছে। আমদানির অপেক্ষায় আরও পণ্য রয়েছে যেগুলো আগামী এক সপ্তাহ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে চলে আসবে। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজারে প্রায় সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম কমেছে। ডলারের দামও স্থিতিশীল রয়েছে। এসব কারণে পণ্যের আমদানি খরচ কমেছে।

আগে নিত্যপণ্য ঢাকা ও চট্টগ্রামভিত্তিক গুটিকয়েক বড় গ্রুপ আমদানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। এবার সরকার বড় বড় গ্রুপের পাশাপাশি ছোট ছোট উদ্যোক্তাদেরকেও আমদানিতে উৎসাহিত করেছে। এতে দেশের বড় বড় ব্যবসা কেন্দ্রগুলোর পাশাপাশি ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তারাও এলসি খুলে পণ্য আমদানি করেছেন। আগে আমদানি করত শুধু ঢাকা ও চট্টগ্রামকেন্দ্রিক বড় ব্যবসায়ী গ্রুপগুলো। যে কারণে তারা আগে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারত। এখন চারদিক থেকে আমদানি হওয়ায় এককভাবে কেউ বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এছাড়া দেশের বিভিন্ন বাজারে একই পণ্যের দামে হেরফের হচ্ছে। আমদানি ও উৎপাদন খরচের ভিন্নতার কারণে এমনটি হচ্ছে। তবে সয়াবিন তেল পরিশোধনকারী কোম্পানি কয়েকটি। এর বাজার তাদের বৃত্ত থেকে বের করা এখনো সম্ভব হচ্ছে না। যে কারণে সয়াবিন তেলের দাম না বাড়লেও বাজারে এর সংকট রয়েছে।

এদিকে নিত্যপণ্যের বড় আমদানিকারক ও উৎপাদনকারী কয়েকটি গ্রুপকে সরকার থেকে নানাভাবে চাপ দেওয়া হয়েছে পণ্যের দাম সহনীয় রাখতে। এতেও দাম কিছুটা কমেছে। অন্যান্য বছর নিত্যপণ্যের বড় যে সিন্ডিকেট ছিল সেটি এবার তেমনভাবে সক্রিয় নয়। তাদের বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ এখন তদন্ত হচ্ছে। সবজিসহ আরও কিছু পণ্যের দাম কমাতে এবার সরকার ভিন্ন কৌশল নিয়েছে। আড়ত থেকে দাম নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। ফলে পাইকারি পর্যায়ে দাম কমেছে। এর প্রভাব পড়েছে খুচরা পর্যায়ে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সৃষ্ট রাজনৈতিক অস্থিরতায় শিল্প উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এখন উৎপাদন বাড়তে শুরু করেছে। ফলে সরবরাহ যেমন বেড়েছে, তেমনি শিল্প পণ্যের দামও স্থিতিশীল রয়েছে।

আগে রাজনৈতিক দলের পক্ষে মাফিয়াগুলো যেভাবে সক্রিয় থাকত, এখন সেভাবে নেই। এতেও সরবরাহ বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ডলারের হিসাবে নিত্যপণ্য আমদানি কমেছে। কিন্তু পরিমাণে বেড়েছে। ডলারের দাম স্থিতিশীল থাকায়, ব্যাংকের নির্ধারিত দরে ডলারের জোগান পাওয়ায়, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমায় এবং এলসির আড়ালে টাকা পাচার বন্ধ হওয়ার কারণে এমনটি হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে নিত্যপণ্যের আমদানি ব্যয় কমেছে ৫ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কিন্তু পণ্যের আমদানি বেড়েছে ২২ শতাংশ। এর মধ্যে লবণ ও চিনির আমদানি ব্যয় কমেছে ৩১ দশমিক ৬২ শতাংশ, আর আমদানি বেড়েছে ৩৩ শতাংশ। দুগ্ধজাত পণ্যের আমদানি ব্যয় কমেছে ১৪ দশমিক ৬৫ শতাংশ, আর আমদানি বেড়েছে ১২ শতাংশ। পরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি খরচ কমেছে ১০ দশমিক ৬২ শতাংশ, আমদানি বেড়েছে ১৪ শতাংশ। অপরিশোধিত সয়াবিন তেলের আমদানি খরচ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমার পরও কারখানাগুলোতে কাঁচামালের জোগান স্বাভাবিক রয়েছে। এ খাতে আমদানি খরচ কমেছে ৭৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অথচ আমদানি বেড়েছে। ভোজ্যতেলের কাঁচামাল আমদানির নামে এস আলম গ্রুপসহ কয়েকটি গ্রুপ বড় অঙ্কের টাকা পাচার করেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে। যে কারণে সয়াবিন তেলের কাঁচামাল আমদানি প্রায় ৭৮ শতাংশ কমার পরও এর সরবরাহে ঘাটতি নেই।

আগে ডলার সংকটের কারণে ফল আমদানিতে বিধিনিষেধ ছিল। যে কারণে এগুলোর আমদানি একেবারেই কম হতো। এখন ডলারের জোগান বাড়ায় আমদানিতে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করা হয়েছে। ফলে আমদানি বেড়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে আমদানি বেড়েছে ৭ দশমিক ৪৯ শতাংশ। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমার কারণে এলসির খরচ কমেছে ৩ দশমিক ২৯ শতাংশ।