Image description

রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে নানা দাবি আদায়ে সড়ক অবরোধ। মূল সড়কে দেদার চলছে অটোরিকশা। যেখানে সেখানে বাস থামিয়ে চলছে যাত্রী ওঠানামা। অলিগলি এমনকি প্রধান সড়কগুলোর ফুটপাতসহ অনেকটা অংশে দখল করে নানা পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেন দোকানিরা। রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন সংস্থার খোঁড়াখুঁড়ি। সব মিলিয়ে রাজধানীর সড়কে শৃঙ্খলার লেশমাত্র নেই। রমজান মাস কেন্দ্র করে নগরবাসীর মনে বাড়ছে ট্রাফিক জ্যাম আতঙ্ক। এসব দেখভালের দায়িত্বে থাকা রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশন এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ভূমিকা অনেকটা তথৈবচ। বিআরটিএ মাঝেমধ্যে আশার বাণী শোনালেও মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে সিটি করপোরেশন।

রাজধানীর বেশিরভাগ মূল সড়কের ফুটপাত ও অলিগলি এখন ভাসমান দোকানে ভরপুর। সাধারণ মানুষের রাস্তায় হাঁটার অবস্থাও নেই। রমজানে এই ভোগান্তি আরও ভয়াবহ হতে পারে বলে মনে করছেন নাগরিকরা। ভাঙাচোরা রাস্তা বছরের পর বছর সংস্কার না করা, সেবা সংস্থাগুলোর রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, রাস্তার দুই পাশজুড়ে ভাসমান দোকানের দৌড়াত্ম্য এবং বিআরটিসিসহ গণপরিবহনের স্বল্পতাই মূলত এ ভোগান্তির অন্যতম কারণ। নগরীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিয়ে নগরবাসীর দ্বিমত নেই, তবে সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোর সমন্বয়হীনতার কারণে ভোগান্তি দূর হচ্ছে না। নিত্য ভোগান্তির জন্য সাধারণ মানুষ সিটি করপোরেশনের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলাকে দায়ী করলেও সংস্থাটির কর্তৃপক্ষরা সর্বদাই ঠিকাদারদের ওপর দায় চাপিয়ে দেন।

এদিকে, রমজান মাসে সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ও যানজট নিরসনে নতুন করে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি না করার জন্য সেবাদানকারী সংস্থা এবং ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে অনুরোধ জানিয়েছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)।

রাজধানীর প্রগতি স্বরণি, খিলক্ষেত, বাসাবো, মালিবাগ, আগারগাঁও-পীরেরবাগ হয়ে মিরপুর-২ পর্যন্ত, মোহাম্মদপুরসহ ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটির বিভিন্ন সড়কে গত কয়েক মাসজুড়ে খোঁড়াখুঁড়ি চলছে। কখনো পয়ঃনিষ্কাশনের পাইপ বসানোর জন্য, কখনোবা বিদ্যুতের লাইন বসানোর জন্য কাটা হচ্ছে সড়ক। আর উন্নয়নের নামে এসব খোঁড়াখুঁড়ি নগরবাসীর বড় ভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ছাড়া আসন্ন ঈদুল ফিতর উপলক্ষে রমজান মাসের শুরুতেই রাজধানীর রাজপথ থেকে অলিগলির রাস্তার দুই পাশে বসে গেছে ভাসমান দোকান। এর ফলে রাজধানীতে বেড়ে গেছে যানজট, হচ্ছে জনভোগান্তি। এর ওপর গণপরিবহন স্বল্পতা রয়েছে নগরীজুড়ে।

 

খিলগাঁও এলাকার বাসিন্দা খায়রুল আলম জানান, ঢাকা নগরী যেন দুর্ভোগের নগরীতে পরিণত হয়েছে। রাস্তায় গাড়ি স্বল্পতা, ফুটপাতজুড়ে হকারদের উৎপাত এবং রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি এসব ভোগান্তির কারণ। কিন্তু এসব দূরীকরণে সংশ্লিষ্টদের তেমন কোনো উদ্যোগ নেই।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ারিং সার্কেল তত্ত্বাবদায়ক প্রকৌশলী (পুর) রাজীব খাদেম বলেন, রমজানে রাজধানীর যানজট নিরসনে এরই মধ্যে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে এরই মধ্যে রমজানে নতুন করে খোঁড়াখুঁড়ি করতে নিষেধ করা হয়েছে। পাশাপাশি ডিএসসিসির সম্পত্তি বিভাগ নিয়মিতভাবে ফুটপাতের ভাসমান দোকান উচ্ছেদে তাদের অভিযান অব্যাহত রাখবে বলে আমি জানি।

রাজধানীতে গণপরিবহনগুলোর কর্মীরা নিজেদের মর্জি মতো চালাচ্ছেন গাড়ি। পাশাপাশি যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছেন ইচ্ছামাফিক ভাড়া। রাজধানীজুড়ে পরিবহন খাতে এমন নৈরাজ্য হরহামেশা চলতে থাকলেও বিশেষ কারণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দেখেও না দেখার ভান করছেন। যদিও বিআরটিএর কার্যক্রম অনুযায়ী যানবাহনের ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স নিশ্চিত করা, বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানো বন্ধ, পরিবহন শ্রমিকদের মাদক গ্রহণ বন্ধ, নিরাপত্তা সরঞ্জাম ব্যবহার করা, সড়কের ত্রুটি দূর করা, অবৈধ যান চলাচল বন্ধ করাসহ সড়কে শৃঙ্খলা আনতে বিশেষ করে ১৬টি কাজ করবে সংস্থাটি। কিন্তু মূলত এসব বিষয়কে সংস্থাটি প্রাধান্য না দেওয়ায় রাজধানীজুড়ে বিশৃঙ্খল পরিবহন ব্যবস্থা।

যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাস উচ্ছেদে কঠোর পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। এমন পদক্ষেপ ঠেকাতে ফিটনেসবিহীন পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় বাসগুলো রাতারাতি গোলাপি রং ধারণ করে চালাতে গিয়ে নগরজুড়ে প্রতিদিন গণপরিবহন সংকটে ভয়াবহ যাত্রী দুর্ভোগ তৈরি হচ্ছে। বাসের ভাড়া নির্ধারণের শর্ত লঙ্ঘন করে এমন অব্যবস্থাপনায় গণপরিবহনে ভয়াবহ যাত্রী দুর্ভোগ তৈরি হয়েছে নগরজুড়ে।

আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে রাজধানীর সড়কগুলো এক প্রকার অবৈধ ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার দখলে রয়েছে। এ সুযোগে ঢাকার আশপাশের জেলাগুলো থেকে হাজার হাজার অটোরিকশা ঢাকায় প্রবেশ করেছে। এর ফলে রাজধানীর ট্রাফিক ব্যবস্থা প্রায় ভগ্নদশায় পতিত হয়। প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা ও অভিযানেও এদের নিবৃত্ত করা যায়নি। চালক ও পথচারীদের কেউই মানছেন না ট্রাফিক আইন। দোষীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও আজও সড়কে শৃঙ্খলা ফেরেনি।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, পরিবহন সেক্টরে সীমাহীন নৈরাজ্য চলছে। ভাড়া নৈরাজ্য, ওভারটেকিং, যাত্রী হয়রানি, সড়কে বিশৃঙ্খলভাবে বাস চালানো, যাত্রীদের সঙ্গে পরিবহন শ্রমিকদের বেপরোয়া আচরণ ও গতি সবসময়ই অগ্রহণযোগ্য। তাদের মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো ও আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে সরকারকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। এ বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত বলেন আমি মনে করি।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম কাজল দাবি করেন, পরিবহন খাতের অধিকাংশ সমস্যাই কাঠামোগত। এসব সমস্যার ৮০ শতাংশের জন্য সরকার ও প্রশাসন দায়ী। ট্রাফিক শৃঙ্খলা পক্ষ কার্যক্রমে শুধু মামলা দেওয়া ছাড়া আর তেমন কিছুই হচ্ছে না। পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা ফেরাতে সব পক্ষের সমন্বয় প্রয়োজন। সমন্বিত কর্মসূচি ছাড়া সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব নয় বলে জানান কাজল।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র উপকমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান কালবেলাকে বলেন, আসন্ন রমজানে যানজট নিরসন ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ রাখার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে সভা হয়েছে। বিশেষ করে ইফতারের আগে নগরবাসী যেন নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছতে পারে, সেজন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। অফিস ছুটির আগে থেকেই যানজট নিরসনে সড়কে ট্রাফিক পুলিশের পাশাপাশি থানা পুলিশ দায়িত্ব পালন করবে। মাঠে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও থাকবে।

সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিআরটিএ ব্যর্থ হওয়ার অন্যতম কারণ, সংস্থাটি তাদের মূল কাজের চেয়ে ভিন্ন মাত্রার বাহবা কুড়াতে রাজস্ব আয়ের দিকে গুরুত্ব বেশি দিয়েছে। যার ফলে প্রতি বছর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করতে পারলেও তারা তাদের মূল কাজ সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর ব্যাপারে কোনো উদ্যোগই কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করতে পারেনি সংস্থাটি।

বিআরটিএ চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন এ ব্যাপারে বলেন, আমরা এরই মধ্যে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানামুখী কার্যক্রম শুরু করেছি। বাড়তি ভাড়া নেওয়ার জন্য সম্প্রতি পরিবহনের মালিক পক্ষকে শোকজ করা হয়েছে। এ ছাড়া সড়কে শৃঙ্খলার মানোন্নয়নে আরও অন্যান্য কাজ নিয়মিতভাবে করা হচ্ছে।

বিআরটিএ সূত্রে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ছয় মাসে অর্থাৎ জুলাই ২০২৪ থেকে ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক সফলতা দেখিয়েছে বিআরটিএ। সংস্থাটি এ সময়ে ফিটনেস, নতুন লাইসেন্স প্রদান, নবায়নসহ অন্যান্য কাজে রাজস্ব আদায় করেছে ১ হাজার ৩৩ কোটি ৭২ লাখ ৫৪ হাজার টাকা।

সূত্র মতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে বিআরটিএ রাজস্ব আয় করেছে ২ হাজার ২১৩ কোটি ৫৪ লাখ ৫৪ হাজার টাকা। এসব আয় হয়েছে রেজিস্ট্রেশন, ট্যাক্স টোকেন, নম্বরপ্লেট ও ডিআরসি, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ভ্যাট, এসডি, অন্যান্য এবং অগ্রিম বাবদ।