Image description

‘মুহূর্তের মধ্যে দাউদাউ করে জ্বলা আগুনে একে একে ৪৬ জনের মৃত্যু। সে দিন রাতে বাঁচার জন্য মানুষের চিৎকার, শিশুদের কান্না এখনও কানে বাজে। রাস্তা দিয়ে চলাচল করার সময় পোড়া এই ভবন দেখলেই আঁতকে উঠি।’ বেইলি রোড অবস্থিত গ্রিন কোজি কটেজের ভয়াবহতা নিয়ে এভাবেই বাংলা ট্রিবিউনকে বলছিলেন বিদেশি একটি এনজিওর কর্মকর্তা আমজাদ হোসেন।

তিনি বলেন, ‘এত বড় একটা দুর্ঘটনা ঘটার পরও সরকারের উচ্চপর্যায়ের কারও টনক নড়েনি। কেউ এখনও রেস্তোরাঁ পাড়ার নিয়ম-নীতি ঠিক করতে পারেনি। বেইলি রোডজুড়ে আবাসিক বাণিজ্যিক সব ভবনে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে দেদারসে চলছে রেস্তোরাঁর ব্যবসা। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কোনও উদ্যোগ নেই এসব রেস্তোরাঁ বন্ধ করার। সরকার অপেক্ষায় আছে আরেকটি বড় দুর্ঘটনার। তখন আবার ধরপাকড়ের নাটক করা হবে।’

সরেজমিন দেখা যায়, এখনও ক্ষত নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বেইলি রোডের গ্রিন কোজি কটেজ নামের সাত তলা পোড়া ভবনটি। ভবনের ভেতরে পড়ে আছে ভাঙা কাঁচ, পোড়া চেয়ার টেবিলসহ বিভিন্ন আসবাবপত্র। প্রায় সব দেয়ালেই পোড়া আবহ এখনও জানান দিচ্ছে সে দিনের ভয়াবহতার কথা। পথ দিয়ে হেঁটে যেতে মনে পড়ছে চোখে ভাসছে সেই মৃত্যৃর মিছিল।

গ্রিন কোজি কটেজের এমন দৃশ্য দেখে সাধারণ মানুষ বারবার থমকে দাঁড়ায়। কেউ পুরোনো স্মৃতি মনে করে দীর্ঘশ্বাস পেলে, কেউ ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটার শঙ্কা জানিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে। ক্ষোভ প্রকাশকারীদের একজন সাইদুর রহমান। বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সব সময় দুর্ঘটনার পর সরকারের পক্ষ থেকে জোরেশোরে প্রচারণা চালানো হয়, নিয়মনীতি অমান্য করে যেন ভবন নির্মাণ করা না হয়। পরে আবার সব থেমে যায়। এইভাবেই সাধারণ মানুষের জীবন নিয়ে রঙ তামাশা চলে।

বেইলি রোডে আগুন (3) 

বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ (ফাইল ছবি)

শায়লা শারমিন নামে বেইলি রোডের একজন বাসিন্দা বলেন, ‘আমি শিক্ষকতা করি। আমার মেয়ে সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলে পড়াশোনা করে। প্রায় বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে এই পাড়ার রেস্তোরাঁগুলোতে আড্ডা দেওয়া হয়। যখনই গ্রিন কোজি কটেজের কথা মনে পড়ে অন্যরকম এক ভয় কাজ করে। বাসা কাছে হওয়ায় সে দিনের ভয়াবহ আগুন নিজ চোখে দেখেছি। মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ দেখছি। কিন্তু ঘুরে ফিরে এখন আবার রেস্তোরাঁগুলোর সেই একই দশা দেখে আফসোস লাগছে।’

পর্যাপ্ত ফায়ার সেফটি নেই বেইলি রোডের রেস্তোরাঁপাড়ায়

বেইলি রোডের প্রায় আধা কিলোমিটার সড়কের দুই পাশের ভবনগুলোতে গড়ে উঠেছে অসংখ্য খাবারের দোকান ও ছোট-বড় রেস্তোরাঁ। নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে এসব ভবনে অপরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হয়েছে শতাধিক রেস্তোরাঁ। অথচ এসব রেস্তোরাঁয় নেই শতভাগ অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বা অবকাঠামো। ফলে অগ্নিদুর্ঘটনাসহ নানা ঝুঁকির আশঙ্কা রয়েছে।

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি গ্রিন কোজি কটেজে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের পর সিটি করপোরেশন, রাজউকসহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায় থেকে অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নিয়ে নড়েচড়ে বসলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার গুরুত্ব কমে গেছে। জনসাধারণ বলেছে, শুধু দুর্ঘটনা ঘটলেই সরকার মানুষের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার নাটক করে। এর আগে হুঁশ থাকে না।

বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুন (ছবি: কবির হোসেন)

বেইলি রোডে বহুতল ভবনে আগুন (ফাইল ছবি)

শাহারুল ইসলাম নামের শান্তিনগরের একজন বাসিন্দা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এই এলাকায় প্রায় ২০ বছর ধরে বসবাস করি। গত বছর এখানে আগুন লাগার পর থেকে মনের মধ্যে একটা অন্যরকম আতঙ্ক বিরাজ করছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ আশেপাশের সব রেস্টুরেন্ট একই ধরনের ঝুঁকি। কোথাও অগ্নিনির্বাপণের সঠিক ব্যবস্থা নেই। এমনি সরকারিভাবেও এসব কিছু কখনও তদারকি করা হয় না।

রোকসানা রশীদ নামের আরেকজন স্থানীয় বাসিন্দা বলেন, পুরো ঢাকাজুড়েই অপরিকল্পিত নগরায়ন গড়ে উঠেছে। কোথাও কোনও নিয়মনীতির বালাই নেই। সরকারের উচ্চপর্যায়ে বসে বসে শুধু দুর্ঘটনার লাশ গোনা তাদের কাজ। দুর্ঘটনার আগে যা করণীয় সেদিকে কারও নজর নেই। গ্রিন কোজি কটেজে দুর্ঘটনার এতদিন পরেও কেন এই ভবন ভাঙ্গা হলো না তার কোনও সদুত্তর নেই। এত বড় ঘটনা ঘটেছে অথচ জড়িত কারও শাস্তি হয়নি।

সিলিন্ডারে ঠাসা অধিকাংশ রেস্তোরাঁ

বেইলি রোডের প্রায় প্রতিটি রেস্তোরাঁ সিলিন্ডারে ঠাসা। ‘বাইতুল আবেদীন শপিং সেন্টার’ নামে একটি সাত তলা ভবন দেখা যায়, কেবল নামেই শপিং সেন্টার। আদতে এই ভবনের পুরোটাজুড়েই বিভিন্ন রেস্টুরেন্টের দোকান। ‘বার্গার এক্সপ্রেস’, ‘ক্যাফে জেলাটেরিয়া’, ‘সেশিয়েট’, ‘ওয়েসিস ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট’সহ আরও বেশ কয়েকটি খাবারের দোকান আছে এই ভবনে। প্রতিটি রেস্টুরেন্টেই ব্যবহার হচ্ছে গ্যাসের বড় বড় সিলিন্ডার।

সিলিন্ডার এবং সেফটি সিকিউরিটির বিষয়ে ‘ওয়েসিস ক্যাফে অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের’ ম্যানেজার মো. রাসেল বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘লাইনের গ্যাস না থাকায় আমরা সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করি। এই ভবনে সেফটি-সিকিউরিটি ঘাটতি আছে, এটা সত্য। কিন্তু আমাদের তো কিছু করার নেই। কারণ ভবনের সব কিছুই ম্যানেজার দেখেন।’

বেইলি-রোডে-আগুন 

বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ (ফাইল ছবি)

রেস্টুরেন্টে কীভাবে রান্না হয়, লাইনের গ্যাস নাকি সিলিন্ডারে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এই ভবনটির একপাশে লাইনের গ্যাস আছে, অন্য পাশে নেই। অন্য পাশে অবস্থিত বার্গার এক্সপ্রেস, ক্যাফে জেলাটেরিয়া, সেশিয়েট রেস্টুরেন্টগুলো সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করে। তাছাড়া যেগুলোতে লাইনের গ্যাস আছে তারাও কিন্তু সিলিন্ডার ব্যবহার করে। বেইলি রোড এলাকায় এমন কোনও রেস্টুরেন্ট নাই যেখানে বড় বড় সিলিন্ডারের গ্যাস ব্যবহার করা হয় না।

‘বার্গার এক্সপ্রেস’ রেস্টুরেন্টের রান্না ঘরে ঢু মারতেই দেখা গেলো গ্যাসের বড় বড় সিলিন্ডার। সাংবাদিক পরিচয়ে এই রেস্টুরেন্টের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে কথা বলতে গেলে ম্যানেজার দ্রুত বেরিয়ে যান। রেস্টুরেন্টটির ক্যাশ কাউন্টারে বসা একজন কর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এখানে লাইনের গ্যাস না থাকায় আমরা সিলিন্ডার ব্যবহার করি।

সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুলের বিপরীতে আছে আরেকটি চার তলা ভবন। ভবনটির চিকন একটি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতেই দোতলা এবং তিন তলাজুড়ে ‘সুলতান'স ডাইন’ রেস্টুরেন্ট। এছাড়াও ‘প্যারাডাইস ফ্রুটস জুস বার’ নামে ছোট একটি খাবারের দোকানও আছে। এই ভবনের রেস্টুরেন্টগুলোও পুরোপুরি সিলিন্ডার নির্ভর। ভবনটিতে বেশ কয়েকটি বড় বড় সিলিন্ডার দেখা যায়। নিচতলায় প্যারাডাইস ফ্রুটস জুস বারে বড় একটা সিলিন্ডার দেখা যায়।

গ্রিন কোজি কটেজ সম্পর্কে কী বলছেন দায়িত্বশীলরা

গ্রিন কোজি কটেজের সার্বিক বিষয়ে জানতে প্রথমেই কথা হয় এই ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা মো. জাহিদের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, আমাদের কাজ হচ্ছে শুধু এটার দেখাশোনা করা। এই ভবন কি ভাঙবে নাকি আবার নতুন করে বানাবে, নাকি সারা জীবন এভাবে থাকবে এসবের কিছুই জানি না। আমি দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে এখানে সাংবাদিক ছাড়া আর কাউকে কখনও আসতে দেখিনি। মূলত ৫ আগস্টের পর এই ভবনের পোড়া মালামাল লুট হলে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় দেখভালের জন্য।

এই ভবনের নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আরও দুই জন হলেন- দ্বীন ইসলাম ও মো. মোশাররফ হোসেন। ভবনের বিষয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে তারা জানান, আমরা দায়িত্বে আসার পর থেকে এই ভবন এভাবেই পড়ে আছে। আন্ডারগ্রাউন্ডে পানি জমে মশা-মাছি জন্মেছিল, দুর্গন্ধ ছড়িয়েছিল আশেপাশে। তখন আমরা বিষয়টি মালিকপক্ষকে অবহিত করলে তারা সিটি করপোরেশনের অনুমতি নেয়। পরবর্তীতে আমরা এটা পরিষ্কার করি। কারণ এর আগে আমাদের জানানো হয়েছিল সরকারি নির্দেশনা ছাড়া কিছু করা যাবে না।

baily road in 

বেইলি রোডে পুড়ে যাওয়া গ্রিন কোজি কটেজ (ফাইল ছবি)

বেইলি রোডের পোড়া ভবনের হালচাল সম্পর্কে জানতে কথা হয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. রাসেল রহমানের সঙ্গে। বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন, এটা তো এখন একটা ক্রাইম স্পট। এখানে এখন সিটি করপোরেশনের কিছু করার আছে কিনা আমার ঠিক জানা নেই। এর মামলা চলমান আছে। তাছাড়া এ সম্পর্কে রাজউক ভালো বলতে পারবে।

গ্রিন কোজি কটেজের ভয়াবহতার কথা স্মৃতিচারণ করে সিটি করপোরেশনের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, সেদিন আমি ও আমার পরিবার গিয়েছিলাম এই ভবনের রেস্তোরাঁয় খেতে। সৌভাগ্যক্রমে সেখান থেকে পরে পাশের অন্য আরেকটি রেস্তোরাঁয় চলে যাই। এরমধ্যেই দুর্ঘটনা ঘটে। সে দিনের মানুষের আহাজারি এখনও মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।

গ্রিন কোজি কটেজ সম্পর্কে জানতে রাজউকের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. ছিদ্দিকুর রহমান সরকারকে (অব.) মেসেজ এবং কল করলেও তার কোনও উত্তর পাওয়া যায়নি। তবে এ বিষয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের একজন কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ নিয়ে মামলা নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত কিছু করা যাবে না। আদালত যা সিদ্ধান্ত দেবে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ভবন সম্পর্কিত কোনও গাফিলতি যদি রাজউকের কোনও কর্মকর্তার থেকে থাকে সেটিও আদালত দেখবে।