
এখন দৌড়ের ওপর আছেন আওয়ামী শাসনামলে নির্বাচনী দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তারা। তাঁরাই ছিলেন গত সরকারের আমলে পুলিশের সবচেয়ে দাপুটে কর্তাব্যক্তি। গত মঙ্গলবার এ ধরনের ৮২ পুলিশ কর্মকর্তাকে ওএসডি করার পর এখন তাঁদের অর্জিত অবৈধ সম্পদের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে যাচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
সম্প্রতি এ বিষয়ে পত্র দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। শিগগিরই অনুসন্ধান শুরু হবে। তবে বিষয়টি নিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা দুদকের কোনো দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ করে কথা বলতে রাজি হননি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পৃথক তিনটি প্রজ্ঞাপনে ৮২ কর্মকর্তাকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি) করা হয়। ৮২ কর্মকর্তার মধ্যে একজন অতিরিক্ত আইজিপি, ১৩ জন ডিআইজি, ৪৯ জন অতিরিক্ত ডিআইজি ও ১৯ জন পুলিশ সুপার পদমর্যাদার কর্মকর্তা রয়েছেন। আদেশে ওএসডির কারণ সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানানো হয়নি। তবে একটি সূত্র জানায়, এই ৮২ জন কর্মকর্তা ২০১৮ সালের বিতর্কিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করেন। সাধারণত গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে সরিয়ে কোনো কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হলে এটিকে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে ধরা হয়। যদিও সরকারি ভাষ্য অনুযায়ী, এটি প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাসের অংশ। দেশের ইতিহাসে একযোগে এত বেশিসংখ্যক পুলিশ কর্মকর্তার একযোগে ওএসডি করার ঘটনা এবারই প্রথম।
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৪ সালের দশম ও ২০২৪ সালের দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি-জামায়াত ও সমমনারা বর্জন করে।
২০১৮ সালে এসপি পদে দায়িত্ব পালন করা তিনজন কর্মকর্তা জুলাই হত্যাকাণ্ডের আসামি হওয়ায় এর আগেই ওএসডি হয়েছেন। আর ঝালকাঠি জেলার এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী জুবায়েদুর রহমান কিছুদিন আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন।
সবাই ছিলেন দাপুটে কর্মকর্তা : ২০১৮ সালে জাতীয় নির্বাচনে দেশের ৬৪ জেলার পুলিশ সুপাররা (এসপি) ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার খুব কাছের। তাঁদের দাপটও ছিল বেশ। পুরো পুলিশ বাহিনীতে নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিসহ প্রায় সব কিছুতেই তাঁদের হাত থাকত। অনেকে পেয়েছেন দ্রুত পদোন্নতি। তাঁদের কেউ কেউ ওই সরকারের সময় এসপি থেকে দুই-তিন বছরের মাথায় ডিআইজি পদে পদোন্নতি বাড়িয়ে নেন।
তাঁদের একজন সৈয়দ নুরুল ইসলাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এমনকি প্রভাব খাটিয়ে দুই ভাইকেও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় জনপ্রতিনিধি করার সুযোগ পান তিনি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নুরুল ইসলামসহ কয়েকজন পলাতক বলে জানা গেছে। ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় সৈয়দ নুরুল ইসলাম কুমিল্লার এসপি ছিলেন। মো. শহিদুল্লাহ ওই সময় ছিলেন রাজশাহীর এসপি। সম্প্রতি তিনি গ্রেপ্তার হয়েছেন। ডিএমপির ডিবি এবং উত্তরা বিভাগের ডিসিসহ বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন এই কর্মকর্তা।
নির্বাচনের সময় কক্সবাজারের এসপি ছিলেন এ বি এম মাসুদ হোসেন। তাঁর সময় অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা হত্যার ঘটনায় তিনি ছিলেন ব্যাপক সমালোচিত। পরে তাঁকে এসপি হিসেবে রাজশাহীতে বদলি করা হয়। ২০১৮ সালের নির্বাচনে পুরস্কার হিসেবে তাঁকে অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিও দেওয়া হয়। ওই এসপিদের আরেকজন ছিলেন শাহ মিজান শাফিউর রহমান। তিনি ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় ঢাকা জেলার এসপি ছিলেন। ২০১৪ সালে লক্ষ্মীপুরের এসপি হওয়ার পর থেকে তাঁর দ্রুত উন্নতি ঘটে। ২০তম ব্যাচের আরেক এসপি জিহাদুল কবির ২০১৮ সালে নির্বাচনের সময় চাঁদপুর জেলার এসপি ছিলেন। এর আগে তিনি ২০১২ সালে পুলিশ সুপার হিসেবে মাগুরা জেলার দায়িত্ব পান। পরে রাজবাড়ী ও পাবনা জেলার এসপি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মোহাম্মদ নূরে আলম মিনা চট্টগ্রামের এসপি ছিলেন। পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে ডিআইজি হন। ২০১৮ সালে কিশোরগঞ্জে এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মাশরুকুর রহমান খালেদ। পরে তাঁকে পদোন্নতি দিয়ে ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজির দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাদারীপুরের তৎকালীন এসপি মোহাম্মদ সরোয়ার হোসেন অতিরিক্ত ডিআইজি হিসেবে পদোন্নতি পান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় মোকতার হোসেন ছিলেন ভোলার এসপি। সেখানে কর্মরত থাকাকালে জড়িয়ে পড়েন নারী কেলেঙ্কারিতে। নারী কনস্টেবলের সঙ্গে তাঁর অনৈতিক সম্পর্কের একাধিক অডিও ভাইরাল হওয়ার পরও অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পান।
ইলিয়াছ শরীফ ছিলেন নোয়াখালীর এসপি। পরে তিনি পদোন্নতি পেয়ে অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি হন। জাহাঙ্গীর আলম সরকার ওই সময় ছিলেন ফেনীর পুলিশ সুপার। মাদরাসাছাত্রী নুসরাত হত্যার ঘটনায় তিনি ছিলেন ব্যাপক সমালোচিত। একদশ নির্বাচনের সময় গাজীপুরের এসপি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সামসুন্নাহার। এর আগে ওই জেলার এসপি ছিলেন ব্যাপক আলোচিত পুলিশ কর্মকর্তা ডিবির সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদ। বর্তমানে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে। সিরাজগঞ্জের এসপি টুটুল চক্রবর্তী একসময় কুমিল্লার এসপি ছিলেন। ওই সময় তাঁর বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে জমা পড়লেও তাঁকে সরাতে সক্ষম হয়নি তৎকালীন কর্তৃপক্ষ। তিনি কুমিল্লার এসপি হলেও পুলিশ বাহিনীতে প্রভাব বিস্তার করতেন বলে জানা গেছে। নির্বাচনের আগে তাঁকে সিরাজগঞ্জে বদলি করা হয়।