
দেশের অন্যতম বৃহৎ পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই থেকে ১৬ বছরে হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছেন অন্তত ৩০ ব্যবসায়ী। তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে এখানকার কয়েক শ ব্যবসায়ী পথে বসেছেন। লাপাত্তা ব্যবসায়ীদের কেউ কানাডা, কেউ দুবাইসহ বিভিন্ন দেশে বিলাসী জীবনযাপন করছেন। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা বলছেন, এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় ব্যবসায়ী সংগঠনে বিচার দিলেও তারা সুবিচার পাননি। উলটো অনেক ব্যবসায়ীকে পালাতে সহায়তা করেছেন কথিত ব্যবসায়ী নেতারা। বিগত সরকারের আমলের পুরোটাই খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই ব্যবসাকেন্দ্রে চলেছে প্রতারকদের রাজত্ব। যে কারণে বিশ্বাসের ভিত্তিতে চলা ব্যবসা-বাণিজ্যে পড়েছে অবিশ্বাসের কালো ছায়া। বাকিতে লেনদেন বন্ধ হয়ে গেছে বললেই চলে। ভোগ্যপণ্যের কেনাবেচায় ডিও ব্যবসা ও স্লিপ বাণিজ্যের মাধ্যমে নানা কৌশলে প্রতারকরা বিপুল অঙ্কের এই টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এদিকে এখানকার ব্যবসায়ীদের সংগঠন খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের নতুন কমিটির নেতারা হাজার কোটি টাকা নিয়ে প্রতারক ব্যবসায়ীদের পালানোর কথা অকপটে স্বীকারও করেছেন। তারা বলেছেন, পালিয়ে যাওয়া ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ ও নতুন করে এ ধরনের প্রতারণা যাতে কেউ করতে না পারে, সেই লক্ষ্যে তারা কাজ শুরু করেছেন।
যেসব ব্যবসায়ী টাকা মেরে পালিয়েছেন : খাতুনগঞ্জ হামিদুল্লাহ মিয়াবাজারসংলগ্ন ইয়াসিন এন্টারপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ মোজাহের প্রায় ৪০০ কোটি টাকা মেরে লাপাত্তা হয়েছেন। ১০০ কোটি টাকা মেরে পালিয়েছেন নুর ট্রেডিংয়ের মালিক নাজিম উদ্দিন। চৌধুরী ব্রাদার্স মেরেছে ১০০ কোটি টাকা। পদ্মা স্টোরের নুরুল আবছার ৬৪ কোটি, শফি ট্রেডার্সের জামাল উদ্দিন ৫৫ কোটি, মা ট্রেডিংয়ের জগন্নাথ মিত্র ৫০ কোটি, শাহজাহান ট্রেডার্সের মালিক মোহাম্মদ শাহজাহান ২৫ কোটি, এয়াকুব অ্যান্ড সন্স ২৫ কোটি, ফরহাদ ব্রাদার্সের ফোরকান ২০ কোটি, কেএন ট্রেডিংয়ের সোনামিয়া মার্কেটের ব্যবসায়ী আহমদ নুর ৫ কোটি, একে ট্রেডার্সের কফিল উদ্দিন ৫ কোটি, ভাই ভাই ট্রেডিংয়ের মমতাজ ৫ কোটি, আল মামুন ট্রেডিংয়ের মাহমুদ উল্লাহ ৮ কোটি, সিমরান ট্রেডিংয়ের জাহাঙ্গীর আলম ৫ কোটি, এনএস ট্রেডিংয়ের মুরাদ ৫ কোটি, আয়ান ট্রেডিংয়ের সরওয়ার ৬ কোটি এবং গাজী ট্রেডিংয়ের রবিউল ২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়া মাহমুদ ট্রেডিংয়ের রাশেদ, মোল্লা মার্কেটের সুভাষ কুন্ডু, তানিশা ট্রেডিংয়ের আবদুল মান্নান, মরিয়ম ট্রেডার্স, এশিয়ান ট্রেডিং, এমজি মার্কেটের তাহের-জাফর, মুরাদ ব্রাদার্সের হাশেম, এফএম ট্রেডার্সসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিভিন্ন অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। সবমিলিয়ে অন্তত ১ হাজার কোটি টাকা এ বাজার থেকে প্রতারণার মাধ্যমে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
যেভাবে টাকা হাতিয়ে নেন প্রতারকরা : খাতুনগঞ্জে সরেজমিন এবং ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে টাকা মেরে দেওয়ার অভিনব চিত্র পাওয়া গেছে। এ বাজারে বিশেষ করে ভোগ্যপণ্য-চাল, ডাল, তেল, চিনি, গম ও এলাচের ব্যবসা হয়। প্রতিদিন গড়ে ৫০০ কোটি টাকার কেনাবেচা হয়ে থাকে। বিভিন্ন তফশিলি ব্যাংকের ৫০টিরও বেশি শাখার মাধ্যমে হয় লেনদেন।
চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা পণ্যের বিশাল একটি অংশ কেনাবেচা হয় খাতুনগঞ্জ-চাক্তাইয়ের পাইকারি বাজারে। আমদানিকারকদের কাছ থেকে পাইকাররা পণ্যের ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) কিনে থাকেন। ডিও স্লিপ নিয়ে গুদাম থেকে পণ্য ছাড় করেন ক্রেতা। সর্বনিম্ন এক সপ্তাহ থেকে সর্বোচ্চ এক মাসের বাকিতে ডিও কিনে চেক দেওয়া হয়। পণ্যের দাম ওঠানামার ওপর ভিত্তি করে প্রতিদিনকার ট্রেড বা ব্যবসা হয়ে থাকে।
সূত্র জানায়, অনেক ব্যবসায়ী আছেন যারা গুদামে পণ্য না থাকলেও কেবল ডিও বিক্রি করেন। সেই ডিও এক হাত থেকে অন্য হাতে ঘুরতে থাকে। আন্তর্জাতিক বাজারে সংশ্লিষ্ট পণ্যের বুকিং রেট বাড়া-কমার ওপর পাইকারি বাজারেও পণ্যটির দর ওঠানামা করে। এই দর ওঠানামাতেই কেউ ‘রাজা’ কেউবা ‘ফকির’ হয়ে যান। বিশেষ করে রমজানের আগে খাতুনগঞ্জ-চাক্তাই বাণিজ্যকেন্দ্র থাকে সরগরম। বেচাকেনার মধ্যে ক্রেতা-বিক্রেতার মাঝখানে ‘ব্রোকাররা’ মূল নিয়ামকের ভূমিকা পালন করে থাকেন। তাদের স্থায়ী কোনো প্রতিষ্ঠান না থাকলেও সকাল থেকে তারা এ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে ওই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে ঘুরে বেড়ান। শত বছর ধরে বিশ্বাসের ওপর বাকিতে পণ্য বেচাকেনা এখানে রেওয়াজ হয়ে ওঠে। কিন্তু গত ১৫ বছরে সেই বিশ্বাসের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে প্রতারণার কারণে।
দেখা গেছে, শত শত টন পণ্যের ডিও কিনেছেন ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্ট গুদামে গিয়ে সেই পণ্য মিলছে না। আবার পণ্যের বিপরীতে কয়েক কোটি টাকার চেক দেওয়া হলেও নির্ধারিত সময়ে দেখা গেছে সেই চেকও পাশ হচ্ছে না। একপর্যায়ে পণ্যের বিক্রেতা বাজার থেকে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে লাপাত্তা হয়ে যান। পরে পাওনাদার ব্যবসায়ী মামলা করে কিংবা ব্যবসায়ী সংগঠনে বিচার দিলেও দেখা গেছে আর কাজ হচ্ছে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ২০/৩০ শতাংশ পাওনা পরিশোধের শর্তে দেনাদার ব্যবসায়ী বাজারে ফিরে এলেও শেষ পর্যন্ত পাওনাদারদের ক্ষতির মাশুল গুনতে হয়।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য : ১০ বছর আগে খাতুনগঞ্জে সবচেয়ে বড় টাকা আত্মসাতের ঘটনা ইয়াসিন এন্টারপ্রাইজের। গম ও চনাসহ বিভিন্ন পণ্যের ডিও বেচাকেনার ৪০০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান এই প্রতিষ্ঠানের মালিক মোজাহের হোসেন। অভিযোগ আছে, খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যাসোসিয়েশনের তৎকালীন শীর্ষ নেতারা এ ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার পরিবর্তে তাকে কানাডা পালিয়ে যাওয়ার সব ব্যবস্থা করে দেন। ওই ব্যবসায়ী নেতারা তার আগে মোজাহেরের ভবন ও মালেক মাঝির গুদামে থাকা পণ্য বিক্রি করে নিজেদের পাওনা বুঝে নিলেও সাধারণ পাওনাদারদের বিষয়টি তারা বিবেচনা করেননি। এককভাবে মীর গ্রুপের কাছে ২০ কোটি টাকার বেশি পাওনা রয়েছে। পাওনা দাবিতে মেসার্স হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স একাধিক মামলা করেছে। প্রতিষ্ঠানের মালিক মীর মোহাম্মদ হাসান যুগান্তরকে মামলা দায়েরের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
খাতুনগঞ্জ ছিদ্দিক ট্রেডার্সের মালিক আবু সাঈদ চৌধুরী সম্রাট যুগান্তরকে বলেন, ২০১১-২০১২ ও ২০১৩ সালে গম, চিনিসহ ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায় তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিপুল অঙ্কের টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। পদ্মা স্টোরের নুরুল আবছার তাদের কাছ থেকে ৪ কোটি টাকা মেরে দেন। তার বিরুদ্ধে মামলায় এক বছর সাজা ও তিনগুণ টাকা দেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। সাজা খেটে বের হলেও টাকা দিচ্ছেন না নুরুল আবছার। তিনি বলেন, ব্যবসার নামে প্রতারণা করে বিভিন্ন ব্যবসায়ী আমাদের কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন। যে কারণে আমরা অনেকটাই নিঃস্ব হয়ে গেছি। ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যবসা করলেও প্রতারক ব্যবসায়ীদের খপ্পরে পড়ে একদিকে পুঁজি হারিয়েছি, অন্যদিকে ব্যাংকের দেনাদার হয়ে দেউলিয়া হয়েছি। প্রতারক ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে বিচার নিয়ে ট্রেড অ্যাসোসিয়েশন নেতাদের কাছে গেলেও তারা পাওনা টাকা আদায়ে কোনো ভূমিকাই রাখেননি বলে অভিযোগ করেন সম্রাট।
মোহাম্মদ ইউনুচ নামে আরেক ব্যবসায়ী জানান, আয়ান ট্রেডিং নামে একটি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ব্যবসায়ীর ৬০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে লাপাত্তা হয়ে যায়। ৭/৮ জন পাওনাদার তাদের কাছে বিচার নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু কৌশলে ওই ব্যবসায়ী বাজার থেকে সরে গেছেন। এ কারণে ওই প্রতিষ্ঠানের মালিকের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা করা হয়েছে।
ওই সময়ে খাতুনগঞ্জ ট্রেড অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন মাহবুবুল আলম, সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ ছগীর আহমদ। দুজনই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। ৫ আগস্টের পট পরিবর্তনের পর তরুণ ব্যবসায়ীরা ওই ব্যবসায়ী সংগঠনে নিয়ে আসেন নতুন নেতৃত্ব। অ্যাসোসিয়েশনের বর্তমান সভাপতি মীর গ্রুপের আবদুস সালাম এবং সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান। এ বিষয়ে আবদুস সালাম যুগান্তরকে বলেন, প্রতারণার শিকার ব্যবসায়ীদের বিষয়টি আমরা অগ্রাধিকার দিচ্ছি। এ ধরনের প্রতারণা সমষ্টিগতভাবে রোধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ যাতে টাকা মারতে না পারে বা টাকা মেরে বিদেশ পালাতে না পারে, সেই ব্যবস্থা আমরা করব। পালিয়ে গেলে বিদেশ থেকে ধরে আনার ব্যবস্থাও করব।
সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রহমান বলেন, প্রতারণা বন্ধে বাকিতে বেচাকেনা ৯০ শতাংশ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। যদিও যুগ যুগ এখানে বিশ্বাসের ওপর বাকিতে কোটি কোটি টাকা লেনদেন হতো। এখন সেই বিশ্বাস উঠে গেছে। আশা করছি, ভবিষ্যতে এখানে ব্যবসায়িক প্রতারণা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হবে।