
উপজেলা পর্যায়ে পূর্ণাঙ্গ ফৌজদারি ও দেওয়ানি আদালত চালুর সুপারিশ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, অর্থবহ ও কার্যকরভাবে জনসাধারণের জন্য সুবিচার প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে উপজেলা পর্যায়ে স্থায়ীভাবে আদালত স্থাপন ও পরিচালনা করা অপরিহার্য। প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে সংস্কার বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার কর্তৃক গঠন করা পৃথক দুই কমিশন এ সুপারিশ করেছে। সুপারিশে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন বলছে, পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাড়া সারা দেশের সব উপজেলায় আগামী দুই বছরের মধ্যে অর্থাত্ ২০২৬ সালের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত স্থাপন করা দরকার। দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালতের পাশাপাশি একই পদমর্যাদায় প্রতিটি উপজেলায় ‘বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি’(এডিআর)-এর জন্য একজন সিনিয়র সহকারী জজ এবং বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির পূর্ণাঙ্গ কার্যালয় স্থাপন করা জরুরি। একই সঙ্গে গ্রাম আদালত রাখা না রাখার বিষয়ে দুই কমিশন ভিন্নমত পোষণ করেছে। স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন গ্রাম আদালত বাতিলের সুপারিশ করলেও রাখার পক্ষে মত দিয়েছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন সুপারিশে বলছে, ন্যায়বিচারের জন্য জনসাধারণ প্রথমেই দ্বারস্থ হয় অধস্তন আদালতের। এ কারণেই বর্তমানে সারা দেশে বিচারাধীন ৪৩ লাখ মামলার সিংহভাগই (প্রায় ৩৮ লাখ) অধস্তন আদালতের আওতাভুক্ত। অর্থাত্, মূলত জেলা পর্যায়ের আদালতগুলোই বিচারপ্রার্থীদের প্রথম গন্তব্য। একজন বিচারপ্রার্থী যদি কোনো প্রত্যন্ত গ্রামের বাসিন্দা হন, তাহলে যে কোনো মামলা দায়ের বা মামলা মোকাবিলা করার জন্য জেলা-সদর পর্যন্ত তাকে যেতেই হয়। দেশে এখনো এমন গ্রাম রয়েছে, যেখান থেকে গণপরিবহনে জেলা-সদরে যেতে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা পর্যন্ত সময় লেগে যেতে পারে। সুতরাং, গ্রামভিত্তিক দেশের অধিকাংশ জনগণের জন্য বিচারপ্রাপ্তিকে সহজলভ্য করতে হলে অধস্তন আদালতকে আরো স্থানীয় পর্যায়ে সম্প্রসারণ অত্যন্ত জরুরি। তবে গ্রাম আদালতকে কার্যকর করতে ইউএনও ও ওসির সমন্বয়ে তদারকি কমিটি ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে পাঁচ সদস্যের উপদেষ্টা প্যানেল গঠন, নিরাপত্তা নিশ্চিতে পুলিশ ফাঁড়ি স্থাপনেরও সুপারিশ করেছে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন।
প্রসঙ্গত, ১৯৮২ সালে দেশের সব উপজেলায় সহকারী জজ পর্যায়ের বিচারকদের নেতৃত্বে দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত চালু করা হয়। আদালতগুলো ১৯৯১ সাল পর্যন্ত বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করে। এ সময়ে গ্রামাঞ্চলের প্রান্তিক জনগোষ্ঠী স্থানীয় পর্যায়ে আদালত সম্প্রসারণের ফলে খুবই উপকৃত হয়। আদালতের সহজগম্যতার কারণে মামলার পক্ষদের হাজিরা এবং সাক্ষীদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পায়। ফলে মামলা নিষ্পত্তি সহজতর ও দ্রুততর হয়। এর ফলে দরিদ্র, নারী ও অন্যান্য সুবিধাবঞ্চিত বিচারপ্রার্থীরা বেশি উপকৃত হন।
১৯৯১ সালে উপজেলা পর্যায় থেকে আদালত প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়। জেলা সদর থেকে যেসব উপজেলার দূরত্ব বেশি এবং দুর্গম সেসব উপজেলা সদরে বর্তমানে ৬৭টি ‘চৌকি আদালত’ চালু রয়েছে। এই আদালতগুলো খুবই অপ্রতুল প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে পরিচালিত হয়। চৌকি আদালতের বিচারকরা এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে সহায়ক জনবল স্থায়ীভাবে উপজেলা পর্যায়ে বসবাস করেন না। বরং প্রায় সব ক্ষেত্রেই তারা জেলা সদর থেকে যাতায়াত করেন। ফলে আদালতের সময়ানুবর্তিতা অনেক ক্ষেত্রেই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। অনেক ক্ষেত্রে বিচারক কোনো কারণে আদালতে আসতে না পারলে মামলার তারিখ থাকা সত্ত্বেও বিচারপ্রার্থীদের ফিরে যেতে হয়। ফলে সময়মতো ও নিয়মিত আদালত পরিচালনা করা অত্যন্ত দুরূহ হয়ে পড়ে।
এমন পরিস্থিতিতে বিচার বিভাগ সংস্কার কমিশন মনে করে, বিদ্যমান চৌকি আদালত ব্যবস্থার মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলের জনগণের বিচারপ্রাপ্তির চাহিদা পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য উপজেলা পর্যায়ে আদালত চালু করা দরকার। উপজেলা আদালতগুলোতে সিনিয়র সহকারী জজ ও প্রথম শ্রেণির ম্যাজিস্ট্রেট পর্যায়ের বিচারকদের পদায়ন করতে হবে। দেওয়ানি মামলা গ্রহণে সিনিয়র সহকারী জজের আর্থিক এক্তিয়ার বৃদ্ধি করে বাস্তবানুগ করাও প্রয়োজন। তবে বর্তমান বাস্তবতায় ঢালাওভাবে দেশের সবকটি উপজেলায় স্থায়ী আদালত চালুর প্রয়োজন নাই বলে মনে করে কমিশন। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই উপজেলা এলাকা থেকে জেলা সদরে যাতায়াত আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে গেছে।
কেন গ্রাম আদালত বিলুপ্ত চায় স্থানীয় সরকার কমিশন
স্থানীয় সরকারের বিচার ব্যবস্থায় যে সব দুষ্টক্ষত/সমস্যা পরিলক্ষিত হয়েছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলো চিহ্নিত করেছে কমিশন। এর মধ্যে রয়েছে গ্রাম আদালতে বিচারের নামে প্রহসন চলে। উপজেলা পর্যায়ে কোর্টের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। গ্রাম পুলিশ কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। বিচার প্রক্রিয়ায় সংরক্ষিত নারী প্রতিনিধিদের কার্যকর ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই। স্থানীয় সরকারের ওপর প্রশাসনের প্রভাব বিস্তার। বিচারে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি করা। গ্রাম আদালতের বিচারিক প্রক্রিয়ায় জনগণের আস্থা কম ইত্যাদি। এসব সমস্যা সমাধানে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার অত্যাবশ্যক বলে মনে করে কমিশন। এমতাবস্থায় স্থানীয় সরকার সংস্কারের জন্য আইনি কাঠামোতে ব্যাপক পরিবর্তন আনার পাশাপাশি গ্রাম আদালত ও পৌর সালিশ আইন বিলুপ্ত করে আপস-মীমাংসা ব্যবস্থা প্রণয়নের সুপারিশ করছে কমিশন।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য আবদুর রহমান ইত্তেফাককে বলেন, গ্রাম আদালতের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ন্যায়-অন্যায় নির্ধারণ করে বিরোধের একটা আপসমূলক নিষ্পত্তি করা। কিন্তু স্থানীয় সরকার সংস্থাগুলোর অমনোযোগিতা, অসহযোগিতা ও দুর্নীতির কারণে গ্রাম আদালতগুলো সক্রিয় হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারছে না। এ ব্যাপারে সরকারও সম্পূর্ণ নির্বিকার থাকায় প্রান্তিক পর্যায়ের এই বিচার প্রক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে আছে। পক্ষান্তরে আদালত ও থানার দৌরাত্ম্যে অতিষ্ঠ হয়ে মানুষ অননুমোদিত গ্রাম্য সালিশ বিচারের প্রতি আরো নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তিনি বলেন, বর্তমান গ্রাম আদালত ও পৌর সালিশ ব্যবস্থায় রাজনৈতিক পক্ষ-প্রতিপক্ষ এর প্রভাব বলয় কাজ করে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে এখন নিরপেক্ষ প্রতিনিধির চেয়ে কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত ব্যক্তি মেম্বার, কাউন্সিলর, চেয়ারম্যান ও মেয়র নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক নেতার পক্ষে নিরপেক্ষ বিচার সম্ভব নহে। এছাড়া স্বজনপ্রীতি প্রচলন ব্যাপক। এজন্যই গ্রাম আদালতের চেয়ে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রদত্ত আপস-মীমাংসা প্রথাকেই বিচারপ্রার্থীরা অধিক পছন্দ করছেন। তাই স্বল্প সময়ে, স্বল্প খরচে, নির্ঝঞ্ঝাট ভাবে বিরোধ নিষ্পত্তির একমাত্র সহজ উপায়ই হচ্ছে সালিশ বিচার।