Image description

অপরাধের ঘটনা বেড়ে চলছে। প্রকাশ্যে দুষ্কৃতকারীরা সংঘবদ্ধ হয়ে অস্ত্রশস্ত্র  নিয়ে মহড়া দিচ্ছে অলিতে-গলিতে। অপরাধে ব্যবহার করছে লুটের অস্ত্র। প্রতিনিয়ত ছিনতাই, ডাকাতি, রাজনৈতিক বিরোধ, জমি দখল, অপহরণ, মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি ও খুনের মতো ঘটনা ঘটছে। এমনকি থেমে নেই ধর্ষণের ঘটনাও। সর্বত্রই চলছে অপরাধ ঘটানোর প্রতিযোগিতা। এ সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে বেপরোয়া হয়ে উঠছে অপরাধীরা। এমন ঘটনা একের পর এক ঘটতে থাকা নিয়ে উদ্বেগ আর শঙ্কায় সাধারণ মানুষ। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঘটিত সকল ঘটনায় জনমনে তৈরি হচ্ছে ভীতি, আতঙ্ক আর উদ্বেগ। বর্তমান পরিস্থিতিতে অপরাধীদের দমানো না গেলে অপরাধের মাত্রা আরও বেড়ে যাবে। এই মুহূর্তে অপরাধ মোকাবিলায় পুলিশের কঠোর অভিযান ও সক্রিয়তা জরুরি। পুলিশের উদ্ধার না হওয়া অস্ত্রগুলো বড় ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে। 

সাবেক আইজিপি নূরুল হুদা মানবজমিনকে বলেন, এ রকম ঘটনা আগেও ঘটেছে। বিগত বছরগুলোতে ফিরে তাকালে দেখা যায় এর চেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে। তুলনামূলকভাবে অপরাধের পরিসংখ্যান দেখলে এ রকমই বের হবে। বর্তমান সময়টাতে মানুষের চাহিদাটা অনেক বেশি। সবকিছু ঠিক থাকবে, স্বৈরাচার সরকার নেই। মোটকথা মানুষের চাহিদা বেশি এজন্য ফ্রাস্টেশনটাও বেশি। জিনিসপত্রের দাম কমেনি, লোকের তো এমনিই অর্থনৈতিক সচ্ছলতা নেই। তার উপর যদি আবার নিরাপত্তার ঘাটতি থাকে সেটিও তো একটা মৌলিক চাহিদা। তিনি বলেন, এসব অপরাধকে দমাতে প্রতিরোধ-প্রতিকার জরুরি। যে ঘটনাগুলো ঘটে গেছে, সেগুলোকে তদন্ত করে অপরাধীদের দ্রুত আইনের আওতায় আনতে হবে। অস্ত্র লুট হওয়ার বিষয়টি উদ্বেগের বিষয়। জননিরাপত্তা রক্ষায় এসব অস্ত্র দ্রুত উদ্ধারে জোর দিতে হবে এবং অভিযান চলমান রাখতে হবে। এগুলো অপরাধীদের হাতে থাকা রাষ্ট্রের জন্য হুমকি, ক্ষতি। লুট হওয়া অস্ত্র আইনশৃঙ্খলার জন্য বড় হুমকি। মারাত্মক, সেটি দুষ্কৃতকারীরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ও বিভিন্ন অপরাধে ব্যবহার করতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও কঠোর হতে হবে অপরাধ দমনে।

সাবেক আইজিপি নূর মোহাম্মদ মানবজমিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বাড়ে-কমে। কিন্তু এইবারের বিষয়টি একদমই অন্যরকম। পুলিশের ওপর এবার যে ধকলটা গেল এখনো কিন্তু পুলিশ ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারেনি। এই ছয়-সাত মাসে পুলিশের যেভাবে একটু ঠিক হওয়া উচিত ছিল সেটি কিন্তু পারেনি। বাস্তবিক অর্থে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি কিন্তু এখনো দেখছি না। আমি মনে করি এই যে পুলিশ যেভাবে আক্রান্ত হচ্ছে- এখনো তারা ট্রমা কাটিয়ে উঠতে পারেনি, এখনো এই ধাক্কার মধ্যেই যাচ্ছে। কোথাও গেলে মানুষজন অপমান করে, কোথাও গেলে কেউ তাদের কথা শুনতে চায় না। উল্টো কেউ কেউ পুলিশের ওপর চড়াও হয়। এই যে, পুলিশের মোরাল যে ডাউনটা হয়েছে- সেখান থেকে তাদেরকে টেনে উঠাতে হবে। আইনশৃঙ্খলা বা অপরাধ দমন নিয়ন্ত্রণে মোটামুটি দুই-তিনটা কাজ করে। যখন অপরাধ বেড়ে যায় তখন পুলিশের এক্টিভিটি, গতিবিধি দৃশ্যমান করে। এলাকায় তথ্য অপরাধীদের তথ্য সংগ্রহ করে। জোরালো তৎপরতা এবং অভিযান পরিচালনা করা হয়। এবং সোর্স রিচ করে কারা কারা অস্ত্র ব্যবহারের সঙ্গে সম্পৃক্ত, রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পৃক্ত, মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত এগুলো লিস্ট ধরে ধরে এলাকাভিত্তিক অপারেশন পরিচালনা করে। এবং সেটি খুবই নিবিড়ভাবে করতে হবে। অপরাধজনিত এলাকাগুলোতে টহল কার্যক্রম বৃদ্ধি করা। এলাকায় বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে নিয়ে মিটিং পরিচালনা করে।  দেশব্যাপী আওয়াজ তুলতে হবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে মাঠে নেমে যেন অপরাধীদের মধ্যে ভয়ভীতি তৈরি হয়। কিন্তু সেই আওয়াজটাইতো দেখা যাচ্ছে না।    

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, বর্তমানে অপরাধের যে সংখ্যা এবং হিংস্র্রভাবে যে অপরাধগুলো হচ্ছে- তার প্রেক্ষাপটে অমরা এটি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চেয়ে অপরাধীদের শক্তি অনেক বেড়ে গেছে। যেখানে সশস্ত্র বাহিনী বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে মাঠে আছে, অপারেশন ডেভিল হান্ট চলছে এরমধ্যে এইরকম অপরাধের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার পিছনে মূলত দুই-তিনটি প্রেক্ষাপট আছে। প্রথম প্রেক্ষাপট হলো, অপরাধীরা যেকোনো সমাজে তাদের অপরাধমূলক দৌরাত্ম্য বা কর্মকাণ্ড বা পরিকল্পনা ঘটায় যখন তারা দেখে অপরাধ করলে কোনো না কোনোভাবে তারা পার পেয়ে যাবে। একই সঙ্গে তারা দেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বা সাধারণ মানুষ খুব একটা সক্রিয় নেই। অপরাধী গ্রেপ্তার হলেও সেখান থেকে সহজে বেরিয়ে আসতে পারবে বা এইরকম পরিস্থিতিতে মামলা হলেও গ্রেপ্তার হতে পারে- নাও পারে। আবার মামলা হতেও পারে নাও পারে। এই রকম একটা বাস্তবতা তৈরি হয় তখন সমাজে অপরাধী ও অপরাধের দৌরাত্ম্য বাড়ে। শীর্ষ পর্যায়ের অপরাধী থেকে শুরু করে একবারে ছোট অপরাধীদের অপরাধের প্রবণতা বাড়ে। তারা মনে করে এখনই অপরাধ করার সময় অনেক কিছুর ঘাটতি রয়েছে। 

তিনি বলেন, দ্বিতীয় প্রেক্ষাপট হলো- বর্তমান ডেভিল হান্ট অপারেশনসহ গত ছয় মাসে যে অভিযান পরিচালনা হয়েছে সেগুলো মোটা দাগে নিরাপত্তার প্রশ্নে কোনো পরিপূর্ণ বার্তা অথবা প্রভাব তৈরি করতে পারিনি। অপরাধগুলো বলা হলেও ডেভিল হান্ট বা যারা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা বা বাধার সৃষ্টি করছে সবার জন্য এই অভিযান কিন্তু এটি দেখে মনে হচ্ছে অভিযানটি রাজনৈতিক হচ্ছে। পলিটিক্যাল ডেভিলদের খুঁজে বের করার জন্য এই অভিযানের বাস্তবতা সেটি মনে হচ্ছে। যারা রাজনৈতিকভাবে কোনো নাশকতা বা অস্থিরতা সৃষ্টি করতে চায়- অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। 

তিনি বলেন, ৫ই আগস্টের পরে গত ছয় মাসে পুলিশ যে অতীতের চেয়ে খুব একটা মুক্ত হতে পেরেছে, নিজেকে সংশোধন করতে পেরেছে  সেটিও দেখি না। এখনো কোনো কোনো থানা বা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা বাণিজ্যের অভিযোগ আছে, গায়েবি মামলা, অজ্ঞাতনামা আসামি যেটার অবিষ্কারক পুলিশ নিজেই এসবসহ মানুষকে বিভিন্নভাবে হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। পুলিশ পুলিশের কাছ থেকে ঘুষ নিচ্ছে, পুলিশও পুলিশের কাছে নিরাপদ না সেখানে তারা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার বিষয়ে কীভাবে নিশ্চিত করবেন। এ সব নিয়ে মানুষের মধ্যে নানা ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। এই পরিস্থিতিতে কঠোর অভিযান পরিচালনা করা দরকার। শুধু রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে অভিযান পরিচালনা করলে হবে না। দেশের বাস্তবতা ও প্রেক্ষাপটে পুলিশকে সক্রিয় করতেই হবে এ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। 

আইনজীবী কেএম মাহফুজ মিশু মানবজমিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে- এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। যেদিকে তাকাচ্ছি সেদিকে কোনো না কোনো ঘটনা ঘটছে। অনেক সময় দেখা যাচ্ছে- পুলিশও সহযোগিতা করছে না। কারণ তাদের মধ্যে এখনও ভীতি রয়েছে। যে সকল অপরাধীকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে- তাদের আদালতে পাঠানোর পরে তাদের জামিনের ব্যাপারে আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট কর্তা-ব্যক্তিদের একটু সজাগ থাকা উচিত। এই পরিস্থিতি চলমান থাকলে মানুষ আরও ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাবে। অপরাধের তুলনায় তুলনামূলক অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না।