Image description
বিবদমান গ্রুপগুলো যেমন তর্ক-বিতর্কে জড়িয়েছে, তেমনি শক্তির মহড়া দেখাতে গিয়ে সংঘর্ষেও জড়াচ্ছে, সাবেক ছাত্রনেতারা অনেকে বলছেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের হতে পারছে না ছাত্রসংগঠনগুলো

প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্বে থাকা ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে তীব্র বিরোধ তৈরি হয়েছে। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে সাংগঠনিক শক্তি গড়ে তোলার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। ফলে বিবদমান গ্রুপগুলো যেমন তর্ক-বিতর্কে জড়িয়েছে, তেমনি শক্তির মহড়া দেখাতে গিয়ে সংঘর্ষেও জড়াচ্ছে। 

এমন বাস্তবতায় ছাত্ররাজনীতি কোন পথে যাচ্ছে, তা নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে।

 
কেউ বলছেন, গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ছাত্ররাজনীতির হারানো গৌরব ফিরে পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছিল। গণ-অভ্যুত্থানের ছয় মাস পর সেই সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসছে।

 

সাবেক ছাত্রনেতারা অনেকে বলছেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তি থেকে বের হতে পারছে না ছাত্রসংগঠনগুলো। ফলে মূল দলের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে সংগঠনগুলো সংঘাতময় পরিস্থিতি তৈরি করছে।

 
এভাবে চলতে থাকলে ক্যাম্পাসগুলোতে অস্থিতিশীলতা বাড়বে।

 

রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, দলীয় লেজুড়বৃত্তি ছাত্রসংগঠনগুলোকে  ছেঁকে ধরেছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন প্রায় অসম্ভব বলা যায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ও জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন দল গঠনের পর রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ তৈরি হতে পারে।

 
বৈষম্যবিরোধীদের নেতৃত্বে থাকা ছাত্ররা নতুন ছাত্রসংগঠনও গঠন করছে। ফলে ক্যাম্পাসগুলোতে তারা সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর চেষ্টা করবে। তখন ছাত্রদল ও শিবিরের বাইরে তারাও ক্যাম্পাসে একটি শক্তি হিসেবে দাঁড়াতে পারে।

নতুন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন গঠনের নেতৃত্বের দৌড়ে এগিয়ে থাকা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের সমন্বয়ক তাহমিদ আল মুদ্দাসসির চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের মুখোমুখি অবস্থান উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। ছাত্রসংসদ নির্বাচন পিছিয়ে দিতে ক্যাম্পাসগুলোতে উত্তপ্ত পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে।

এই উত্তপ্ত পরিস্থিতি ক্যাম্পাসকে একসময় দীর্ঘ সহিংসতার পথে নিয়ে যাবে। এ জন্য আমরা অনতিবিলম্বে বিশ্ববিদ্যালয়সহ প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ চাই। ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের প্রতি আহ্বান থাকবে, লেজুড়বৃত্তি ছাত্ররাজনীতির জন্য ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ হয়েছিল। এখনো যদি এমন করে রাজনীতি করে যান, তাহলে আপনাদের পরিস্থিতি ভালো হবে না।

দুই মেরুতে ছাত্রদল-শিবির

খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেটের এমসি কলেজ, টঙ্গীর তামিরুল মিল্লাত মাদরাসা ও চট্টগ্রাম কলেজের অপ্রীতিকর ঘটনায় দুই মেরুতে এসে দাঁড়িয়েছে ছাত্রদল ও ইসলামী ছাত্রশিবির। এসব ঘটনায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ছাত্রদল ও ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

গত রবিবার বিকেলে দেশের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে ছাত্রশিবির। এর বিরোধিতা করেছে ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়ন। তারা বলছে, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের গণহত্যায় নৈতিক দায় ইসলামী ছাত্রশিবিরকে নিতে হবে। অনুতাপ ও বিবেকবোধ থেকেই ছাত্রশিবিরের মধুর ক্যান্টিনে আসা উচিত নয়।

রবিবার রাতেই ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়নের মধুর ক্যান্টিনের সামনে শিবিরের সংবাদ সম্মেলনের বিরোধিতাকে রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের প্রমাণ বলে মন্তব্য করে পাল্টা বিবৃতি দেয় ছাত্রশিবির।

সংগঠনটি বলে, ছাত্রদল ও ছাত্র ইউনিয়নের বিবৃতি প্রমাণ করে যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট), সিলেটের এমসি কলেজ, টঙ্গীর তামিরুল মিল্লাতে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের অপকর্মের দায় ছাত্রশিবিরের ওপর চাপাতে ব্যর্থ হয়ে তারা নতুন ইস্যু তৈরি করে অপরাজনীতি করার চেষ্টা করছে।

ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির কালের কণ্ঠকে বলেন, সাধারণ শিক্ষার্থীদের নামের অপব্যবহার করে গোপন তৎপরতার রাজনীতিতে অভ্যস্ত ছাত্রশিবির চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা করেছে। কুয়েটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন ও ছাত্রশিবির ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর অতর্কিত হামলা করেছে। এভাবে বিনা উসকানিতে ক্রমাগত হামলার কারণে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা শঙ্কা রয়েছে। ছাত্রদলের কর্মীদের ওপর অকারণে হামলা না করলে কোনো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হতো না।

ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় সভাপতি জাহিদুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ছাত্ররাজনীতির মূল যে লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য শিক্ষাবান্ধব, শিক্ষার্থীবান্ধব, সেবামূলক প্রতিযোগিতা, রাষ্ট্রের ভবিষ্যতের নেতৃত্ব তৈরিসেগুলো যে পন্থায় অর্জিত হবে, আমরা তেমন ছাত্ররাজনীতিই চাই।

ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধে কার লাভ

ক্যাম্পাসগুলোতে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি কেন তোলা হচ্ছে, তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা আছে। দীর্ঘ বছরের ছাত্ররাজনীতি শুধু দলীয় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের দাবিদাওয়ায় সংগঠনগুলো সেভাবে সোচ্চার ছিল না। ফলে ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের এক ধরনের অনীহা তৈরি হয়েছে।

তবে ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের পর ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের যে দাবি উঠেছে, তাকে সাবেক ছাত্র নেতারা যৌক্তিক মনে করছেন না। তাঁরা মনে করেন, ছাত্ররাজনীতি না থাকলে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব গড়ে উঠবে না। তাই ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে, এখানেও সংস্কার প্রয়োজন কি না, এ বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। কিন্তু নিষিদ্ধ হলে রাজনৈতিক নেতৃত্বে শূন্যতা তৈরি হবে।

কালের কণ্ঠকে ছাত্রদল নেতারা বলেন, শিবির বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গোপন রাজনীতি করে। ফলে প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ করতে পারলে তাদের সুবিধা। আবার বৈষম্যবিরোধীরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রকাশ্য রাজনীতি করলেও ছাত্রদলের রাজনীতি মেনে নিতে পারছে না।

সম্প্রতি বৈষম্যবিরোধীর নেতৃত্বে থাকা ছাত্ররা একটি নতুন ছাত্রসংগঠন গঠন করার ঘোষণা দিয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের বেশ কয়েকজন সমন্বয়ক নতুন ছাত্রসংগঠনের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে জানান। তবে সম্ভাব্য ছাত্রসংগঠনের আত্মপ্রকাশের ঘোষণায় নতুন প্রশ্নও উঠেছে। এই ছাত্রসংগঠনটি উপদেষ্টা নাহিদ ইসলামের নেতৃত্বাধীন সম্ভাব্য রাজনৈতিক দলের কি নাএমন সন্দেহ দেখা যাচ্ছে কারো কারো মধ্যে।

ছাত্রদের পক্ষ থেকে সেই সন্দেহ নাকচ করা হলেও প্রশ্ন উঠছে যে একসময় যাঁরা নিজেরাই লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিলেন, এখন তাঁরাই কেন রাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন তৈরি করছেন।

ফলে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হলে কার ক্ষতি কার লাভ তা নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা হচ্ছে।

ছাত্রশিবির সভাপতি জাহিদুল ইসলাম বলেন, ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সেটি অনেক কিছুর ওপর নির্ভর করে। বিশেষত ছাত্ররাজনীতির একটি ইতিহাস আছে। জাতীয় পর্যায়ে অথবা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে একটি পলিসি ডিবেট হতে পারে। যেখানে ছাত্ররাজনীতি কেমন হবে, কেমন হওয়া উচিত এসংক্রান্ত মতামত প্রতিটি ছাত্রসংগঠন উপস্থাপন করবে। সে আলোচনার পর একটি কমিশন হতে পারে, যা ছাত্ররাজনীতির প্র্যাকটিক্যাল জায়গায় চূড়ান্ত রূপরেখা তৈরি করবে। জাতীয়ভাবেও প্রতিটি ছাত্রসংগঠন থেকে কয়েকজন করে নিয়ে ছাত্ররাজনীতি সংস্কার কমিটি হতে পারে।

ছাত্রদল সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন বলেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি অগণতান্ত্রিক ও অসাংবিধানিক। গোপন তৎপরতায় অভ্যস্ত ছাত্রশিবির সাধারণ শিক্ষার্থী নামে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করার জন্য মব তৈরি করছে। সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষকে গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না কালের কণ্ঠকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি থাকবে না, এটা যৌক্তিক হতে পারে না। ছাত্রলীগ খারাপ করে গেছে, তাদের জন্য অন্য সবার শাস্তি হবে কেন? তাই কোনোভাবেই ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ হতে পারে না।

সাধারণ শিক্ষার্থীরা যা বলছেন

ঢাবির ডিজাস্টার সায়েন্স ও ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্স বিভাগের শিক্ষার্থী নাইম সামাদ বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, সাধারণ শিক্ষার্থীরা উদ্বেগের পাশাপাশি একটা হতাশার জায়গায় যাচ্ছে। কুয়েটের ঘটনা সামনে ভালো কিছুর ইঙ্গিত করছে না। ৫ আগস্টের পর যেখানে সবাই একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের কথা ভেবেছিল, ক্যাম্পাসগুলোতে সেটি বজায় রাখার জন্য কোনোক্রমেই একাডেমিক এবং হল এলাকায় রাজনীতি থাকা উচিত নয়। সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে সব দলের প্রতি অনুরোধ, জুলাই মাসে সবাই যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা রক্ষা করতে না পারলে নতুন প্রজন্মের হতাশা বাড়তেই থাকবে।

ঢাবির জাপানিজ স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষার্থী নেওয়াজ শরীফ আরমান বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক সংগঠনের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ স্পষ্ট। এভাবে চললে বিরোধ মাঠ পর্যায়ে গড়াতে সময় লাগবে না। রাজনৈতিক সংগঠনগুলো দেখে আশা করা যাচ্ছে না যে ক্যাম্পাসে সুষ্ঠু ধারার রাজনীতি ফিরবে।

ঢাবির গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী তৈয়বুর রহমান সিফাত বলেন, ৫ আগস্টের পর অন্য অনেক সাধারণ ছাত্রের মতো আমিও স্বপ্ন দেখেছিলাম, এর সংস্কার হবে। কিন্তু আজ পর্যন্ত এর ছিটেফোঁটাও দেখলাম না। দীর্ঘ ছয় মাসেও ছাত্ররা নির্বাচিত প্রতিনিধি পায়নি। সে জন্য ক্যাম্পাসগুলোতে আবারও আধিপত্য বিস্তারের রাজনীতি শুরু হয়েছে। অবশ্যই ছাত্র সংসদ চালু করতে হবে এবং রাজনীতির যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে।

ঢাবির আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী জিহাদুল ইসলাম বলেন,  ক্যাম্পাসগুলোতে মাঠ দখল নিয়ে, বিশেষ করে শিবির ও ছাত্রদলের একটি মুখোমুখি অবস্থান দেখতে পাচ্ছি। ফলে নব্বইয়ের দশকের ক্যাম্পাসকেন্দ্রিক সংঘাত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।