
শিল্প শ্রেণির গ্রাহকদের গ্যাসের নতুন সংযোগ নিতে নতুন দাম দিতে হবে, যা আগের গ্রাহকদের তুলনায় বেশি। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাবে এমনটিই উল্লেখ করেছে পেট্রোবাংলা। পেট্রোবাংলার এমন বৈষম্যমূলক প্রস্তাব আমলে নিয়েছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। আগামী ২৬ ফেব্রুয়ারি এ নিয়ে গণশুনানি অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে, পেট্রোবাংলার এই ধরনের প্রস্তাব শিল্প শ্রেণিতে গ্রাহক পর্যায়ে বৈষম্য তৈরি করবে বলে মনে করছেন জ্বালানি খাত বিশেষজ্ঞরা। এতে শিল্পে বিনিয়োগ কমবে ও অস্থিরতা তৈরি হবে। প্রতিযোগিতামূলক বাজার নষ্ট হবে। এই বৈষম্যমূলক প্রস্তাবের বিপরীতে গণশুনানি স্থগিত করতে সম্প্রতি বিইআরসিকে চিঠি দিয়েছে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। যদিও বিইআরসি থেকে বলা হচ্ছে, গণশুনানিতে প্রস্তাবটি খারিজ করার সুযোগ রয়েছে।
বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেন, পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলো যেহেতু প্রস্তাব দিয়েছে, তাই আমরা আমলে নিয়েছি। গণশুনানিতে সব পক্ষের যুক্তি তর্ক শুনতে পারবো। তখন সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে।
শিল্পে গ্যাসের দাম বাড়াতে পেট্রোবাংলার প্রস্তাবে নতুন শিল্পে গ্যাসের দাম ১৫২ শতাংশ বৃদ্ধির কথা বলা হয়েছে। নতুন ও বিদ্যমান শিল্পেও ঘনমিটার প্রতি ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা করার আবেদন করেছে পেট্রোবাংলা ও বিতরণ কোম্পানিগুলো। এর বিপরীতে নতুন শিল্পে ঘনমিটার প্রতি ৪০ টাকা এবং ক্যাপটিভ বিদ্যুতে ৪২ টাকা করা হতে পারে। বর্তমানে দাম রয়েছে যথাক্রমে ৩০ ও ৩১ টাকা ৭৫ পয়সা।
প্রস্তাবে বলা হয়, ঘনমিটার প্রতি এলএনজির বর্তমান আমদানি মূল্য পড়ছে ৬৫ টাকা ৭০ পয়সা। ভ্যাট-ট্যাক্সসহ দাঁড়ায় ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা। ফলে এ খাতকে টিকিয়ে রাখতে গ্যাসের প্রাইস গ্যাপ কমাতে হবে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১০১ কার্গো এলএনজি আমদানি করলে চলতি অর্থবছরে পেট্রোবাংলার ঘাটতি হবে প্রায় ১৬ হাজার ১৬১ কোটি ৭১ লাখ টাকা। আর ১১৫ কার্গো আমদানি করলে ঘাটতি ২২ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার তথ্য অনুযায়ী, (নভেম্বর ২০২৩ হতে অক্টোবর ২০২৪) এক বছরে ২০৫ মিলিয়ন ঘনমিটার গ্যাস ব্যবহার করেছেন গ্রাহকরা। পেট্রোবাংলার প্রস্তাব বাস্তবায়ন হলে ৪৫ টাকা হারে বাড়তি আয় দাঁড়াবে ৯২২ কোটি টাকা।
পেট্রোবাংলার প্রতিশ্রুত গ্রাহকদের (ইতোমধ্যে অনুমোদিত) অর্ধেক বিল বিদ্যমান দরে, অর্ধেক ৭৫ টাকা ৭২ পয়সা টাকা হার নির্ধারণের প্রস্তাব করা হয়। আর প্রতিশ্রুত লোড শিল্পে ৩১০ মিলিয়ন ঘনমিটার ও ক্যাপটিভে ২৯০ মিলিয়ন ঘনমিটার। মোট ৬০০ মিলিয়নের মধ্যে ৩০০ মিলিয়ন বিল বর্ধিত দর হলে আয় করবে ১ হাজার ৩৫০ কোটি টাকা। এতে করে উভয় অংশ থেকে ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকার মতো বাড়তি আয় করবে পেট্রোবাংলা। যেখানে তাদের ঘাটতি ১৬ হাজার থেকে ২২ হাজার কোটি টাকা।
জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ড. ইজাজ হোসেন কালবেলাকে বলেন, এটা নিশ্চিত শুরুতে বৈষম্য তৈরি হবে, তবে ভবিষ্যতে শ্রেণি অনুযায়ী একই দাম নির্ধারণ করতে হবে। কেন সরকার এটা করছে, সেই বিষয়টিও দেখতে হবে। বর্তমানে অনেক শিল্পকারখানায় বেশি দামে সিএনজি ও এলপিজি ব্যবহার হচ্ছে। শিল্পকারখানার মালিকদের প্রতি আমার পরামর্শ জ্বালানির দক্ষ ব্যবহার করতে হবে। এতে খরচ একটু বেশি হলেও কারখানার মালিকরাই লাভবান হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, আমদানি করা এলএনজি আগের দামে বিক্রি করলে লোকসান হয়। আবার গ্রাহকের কাছ থেকে এলএনজির দাম নিতে যে প্রস্তাব করেছে, তাতে করে শিল্প গ্রাহকদের মধ্যে বৈষম্য তৈরি হয়। বিইআরসির উচিত ছিল, এ প্রস্তাব খারিজ করে দেয়া।
এই বিষয়ে জানতে ক্যাবের জ্বালানি উপদেষ্টা ড. শামসুল আলমের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি মিটিংয়ে থাকায় কথা বলা সম্ভব হয়নি।
শিল্প খাতে প্রতি ইউনিট গ্যাসের দাম ৭০ টাকা করলে একটার পর একটা কারখানা বন্ধ হবে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি শওকত আজিজ রাসেল। গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেন তিনি।
শওকত আজিজ বলেন, গ্যাসের দাম ৭০ টাকা নতুন বিনিয়োগকারী বিনিয়োগ করবে না। বর্তমানে এক কিউবিক মিটার গ্যাসের দাম ৩০ টাকা। ঢাকা আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল ও গার্মেন্ট মেশিনারি এক্সিবিশন (ডিটিজি) উপলক্ষে এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। আগামী ২০ থেকে ২৩ ফেব্রুয়ারি ডিটিজির ১৯তম সংস্করণ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি, বসুন্ধরা (আইসিসিবি), ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের (বিইআরসি) চেয়ারম্যান মো. জালাল আহমেদ বলেছেন, পেট্রোবাংলা ও গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোর পক্ষে গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধির যে প্রস্তাবনাই দেওয়া হোক গ্রাহকের কথা বিবেচনায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। সরকারের আর্থিক অবস্থা ও গ্রাহকের অধিকার রক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় রাখা হবে।
গতকাল জ্বালানি খাতের সাংবাদিকদের সংগঠন ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ (এফইআরবি)-এর সদস্যদের সঙ্গে কর্মশালা শেষে সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। বিইআরসি কার্যালয়ে কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয়।
এ সময় ছিলেন কমিশনের সদস্য আব্দুর রাজ্জাক (অর্থ, প্রশাসন ও আইন), মিজানুর রহমান (গ্যাস), ড. সৈয়দা সুলতানা রাজিয়া (পেট্রোলিয়াম) এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ শাহিদ সারওয়ার (অব.) সদস্য (বিদ্যুৎ)। কর্মশালায় দুটি বিষয়ে সামগ্রিক উপস্থাপনা করেন কমিশনের পরিচালক (পেট্রোলিয়াম) ড. দিদারুল আলম ও উপপরিচালক (ট্যারিফ) কামরুজ্জামান।
গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ব্যবস্থাপনা কমিশনের হাতে ফিরবে কি না—এমন প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, গ্যাস উন্নয়ন তহবিলের অর্থ ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব এক সময় কমিশনের হাতেই ছিল। পরবর্তী সময়ে সেটা মন্ত্রণালয় তাদের অধীনে নিয়ে যায়। এটা কমিশনে ফিরবে কি না সেটি সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করে। বিইআরসি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছে কি না—এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, যারা মূলত আইনপ্রণেতা তারা কমিশনকে কীভাবে দেখতে চায় সেটার ওপর অনেক কিছু নির্ভর করে। তবে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে করতে হয়।
আরেক প্রশ্নের জবাবে চেয়ারম্যান বলেন, সত্যিকার অর্থে কমিশন এখনো শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠেনি। চেষ্টা করছি কমিশনকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে। এ সময় এফইআরবির সদস্যরা ছাড়াও ছিলেন সংগঠনের চেয়ারম্যান শামীম জাহাঙ্গীর ও নির্বাহী পরিচালক সেরাজুল ইসলাম।