Image description

আসন্ন পবিত্র রমজানে চাল, ডাল, ছোলা, তেল, চিনি, খেজুর, বিদেশি কিছু ফল, পেঁয়াজ, গরুর মাংস, দুধ, ডিম, মুরগিসহ ১২ থেকে ১৫ ধরনের পণ্যের বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। বাড়তি চাহিদার সুযোগ নেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। প্রতিবছরই রোজার আগে সরবরাহের সংকট দেখিয়ে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে দেন তাঁরা। এবার রমজানে নিত্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা ঠেকাতে নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আমদানিতে শুল্কছাড়, বাজার মনিটরিং ও টিসিবির মাধ্যমে পণ্য বিক্রি আগেই ছিল। এখন এই ভর্তুকি মূল্যের পণ্য বিক্রি, বাজার মনিটরিং আরও বাড়ানোসহ বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা এসব পদক্ষেপে বাজার নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে আশা করলেও দুশ্চিন্তা কাটছে না ভোক্তার।

বাজার বিশ্লেষকেরা বলছেন, সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে, তা গতানুগতিক। এতে নতুনত্ব কিছু নেই। তা ছাড়া প্রয়োজনের তুলনায় ব্যবস্থা অপ্রতুল। এবার টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে তেল, চিনি, ডাল, ছোলাসহ রমজানের পণ্য পাবেন না প্রায় ৪৩ লাখ পরিবার। তাই সরকারিভাবে এসব পণ্যের জোগান বাড়াতে হবে। আর তদারকিতেও দুর্বলতা রয়েছে; যার কারণে ভোজ্যতেলের বাজার এখনো স্বাভাবিক হয়নি। তবে তদারকি জোরদার এবং কর্মসূচিগুলোর আওতা বাড়াতে পারলে এবার রমজানে বাজার স্বাভাবিক থাকবে বলে আশা করছেন তাঁরা।

সবকিছু ঠিক থাকলে আগামী ১ মার্চ থেকে রমজান মাস শুরু হবে। এবার রমজানে বাজার স্থির রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চাল, তেল, চিনি, খেজুর, পেঁয়াজ, আলু, ডিমসহ বেশ কিছু পণ্যের আমদানিতে শুল্কছাড় দিয়েছে। এতে আমদানি অনেকটাই বেড়েছে। বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ থাকায় আলু, পেঁয়াজ, ডিম, চিনি ও খেজুরের দাম বাড়েনি।

জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের বাজার তদারকির পাশাপাশি ঢাকা মহানগরীর বাজারগুলোতে নিত্যপণ্যের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে তিনটি দল গঠন করেছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। গত মঙ্গলবার থেকে এই টিম বাজার তদারকি শুরু করেছে। এ ছাড়া অধিদপ্তরের মাধ্যমে নিয়মিতভাবে ৬টি দল কাজ করলেও রমজানে কাজ করবে ১০টি দল।

জানতে চাইলে তদারকি টিমের দলনেতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উপসচিব জান্নাতুল ফেরদৌস আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা বুধবার সারা দিন বিভিন্ন বাজারে তদারকি করে ভোজ্যতেল ছাড়া বাকি সব পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক দেখেছি। এসব পণ্যের দাম আগের মতোই রয়েছে। ইতিমধ্যে মন্ত্রণালয়কে আমরা তেলের বিষয়ে রিপোর্ট করেছি। আশা করছি পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

জান্নাতুল ফেরদৌস বলেন, ‘ভোজ্যতেলের আমদানি পরিস্থিতি ভালো। সে হিসেবে আগামী রমজানে সমস্যা থাকবে না বলেই মনে করছি আমরা।’ নিত্যপণ্যের দাম ও সরবরাহ পরিস্থিতি আগামী রমজানে ভালো থাকবে বলে আশা করছেন বাণিজ্যসচিব (চলতি দায়িত্ব) আবদুর রহিম খানও।

গতকাল তদারকির বিষয়টি জানিয়ে তিনি বলেন, বাজারের সমস্যাগুলোর বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, আরও নেওয়া হবে। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পূর্ণাঙ্গ করা, হিমাগারের ভাড়াবৃদ্ধির সমস্যা নিরসন, সয়াবিন তেলের সংকট দূর করা, পাহাড়ি ও দুর্গম অঞ্চলে টিসিবির পণ্য পরিবহনে সুবিধা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হবে।

এদিকে রমজানে সাধারণ ভোক্তা ও নিম্ন আয়ের জনগোষ্ঠীর কথা বিবেচনায় রেখে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রতিদিন অন্তত ৬০ হাজার পিস ডিম, ৬ হাজার লিটার দুধ, ২ হাজার কেজি ব্রয়লার মুরগির মাংস এবং ২ থেকে আড়াই হাজার কেজি গরুর মাংস বিক্রির পরিকল্পনা নিয়েছে মন্ত্রণালয়। ঢাকা শহরে ২৫টি জায়গায় এসব পণ্য বিক্রি করা হবে।

এ ছাড়া রমজানে প্রতি কেজি ড্রেসড ব্রয়লার মুরগির মাংস ২৫০ টাকা, প্রতি লিটার পাস্তুরিত দুধ ৮০ টাকা, প্রতি ডজন ডিম ১১৪ টাকা ও প্রতি কেজি গরুর মাংস ৬৫০ টাকা দরে বিক্রি করা হবে। এসব পণ্য বিক্রির জন্য বস্তি এলাকার পাশাপাশি জুলাই অভ্যুত্থানের সময় যেসব জায়গায় সাধারণ মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ বেশি ছিল, সেসব জায়গাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে বলে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার গত সোমবার সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে জানান।

এদিকে ২০২৪ সালের ১ নভেম্বর থেকে আট বিভাগের ৬১টি জেলার ৩৬৪ উপজেলায় ৩৭৭টি পয়েন্টে সুলভ মূল্যে ডিম বিক্রির কার্যক্রম চলছে, যা রমজানেও চলবে বলে জানান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।

খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে আগামী মার্চ ও এপ্রিল মাসে ৩ লাখ টন চাল বিতরণ করা হবে বলে জানিয়েছেন খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার। প্রতি কেজি ১৫ টাকা দরে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে ৫০ লাখ পরিবারকে। পাশাপাশি ঈদের সময় ১ কোটি পরিবারকে বিনা মূল্যে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে।

পবিত্র রমজান মাসে খাদ্যপণ্য সুলভ মূল্যে এবং বিনা মূল্যে বিতরণ কার্যক্রম সুশৃঙ্খলভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জানান খাদ্য উপদেষ্টা আলী ইমাম মজুমদার।

খাদ্য উপদেষ্টা বলেন, রোজার মাসে প্রায় ৭ লাখ টন খাদ্যপণ্য বিতরণ করা হবে। এ ছাড়া টিসিবির মাধ্যমে আরও ৫০ হাজার টন করে দুই মাসে ১ লাখ টন চাল বিতরণ করা হবে। ওএমএসের মাধ্যমে ৫০ হাজার টন করে বিতরণ করা হবে আরও ১ লাখ টন চাল। ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ১২২টি কেন্দ্র এবং ৭০টি ট্রাক থাকবে, যা ম্যাজিস্ট্রেটদের সঙ্গে নিয়ে তদারক করবে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

তবে এ ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকেরা। এ ছাড়া যথাযথ কার্যকর মনিটরিংয়েরও ঘাটতি রয়েছে বলে জানান তাঁরা। এ ছাড়া চাহিদার তুলনায় সরকারের ভর্তুকি মূল্যের পণ্য বিক্রি খুবই অপ্রতুল বলেও মনে করছেন অনেকে। তাঁরা বলছেন, সরকার মূল জায়গায় তেমন কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। আগের সরকারের চেয়ে নতুন কোনো পদক্ষেপ নেই। আবার ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রির যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই কম। এগুলো সবই শহরকেন্দ্রিক। পদক্ষেপগুলো কার্যকর করতে ভর্তুকি মূল্যের পণ্য বিক্রির আওতা আরও বাড়াতে হবে।

জানতে চাইলে কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সহসভাপতি এস এম নাজের হোসেন বলেন, ‘রোজায় যেসব পণ্যের চাহিদা বাড়ে, এ বছর সেসব পণ্যের পর্যাপ্ত মজুত রয়েছে। এমনকি ভোজ্যতেলের মজুতও পর্যাপ্ত। কিন্তু সমস্যা হলো কার্যকর মনিটরিংয়ের ঘাটতি। রোজার সময় ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়িয়ে বাজার অস্থির করে তোলে। আমরা আশা করেছিলাম বর্তমান আগের সরকারের দুর্বল দিকগুলো নজরে রেখে এবার বাড়তি কিছু পদক্ষেপ নেবে। কিন্তু গতানুগতিকের বাইরে যেতে পারেনি তারাও।’

নাজের হোসেন বলেন, তেলের বাজারে সমস্যাগুলো সমাধান হয়নি। বাণিজ্য উপদেষ্টা বারবার বলছে এক সপ্তাহের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু ঠিক করার পদক্ষেপ দেখছি না। ব্যবসায়ীরা যখন চাইবেন, এই সমস্যা শেষ হবে। কিন্তু ততক্ষণে তাঁদের বাড়তি মুনাফা করা হয়ে যাবে।

গত বছর রোজার সময় ১ কোটি পরিবার টিসিবির কার্ডের মাধ্যমে পণ্য কিনতে পারলেও এবার পাচ্ছে ৫৭ লাখ কার্ডধারী। বাকি ৪৩ লাখ কার্ড বাতিল করা হয়েছে। তবে এবার ঢাকা ও চট্টগ্রাম শহরে ৭০টি ট্রাকের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৪ হাজার মানুষের জন্য পণ্য বিক্রি করছে টিসিবি।