
যৌতুককে কেন্দ্র করে রিয়াকে পিটিয়ে গুরুতর আহত ও শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা করেন স্বামী হৃদয় হোসেন বিপু। একপর্যায়ে প্রাণটাই চলে যায় এই গৃহবধূর।অথচ চার বছর আগে ওরা প্রেম করে বিয়ে করেন। পারিবারিকভাবেই বিয়েটা হয়। বিয়ের পরই শুরু হয় যৌতুকের জন্য রিয়ার ওপর নির্যাতন।
শ্বশুরবাড়ি থেকে কয়েক দফায় যৌতুকের নামে টাকা আদায় করেন বিপু। পেশায় ট্রাকচালক বিপু যৌতুক হিসেবে আদায় করা টাকায় জুয়া খেলতেন। সঙ্গে চলত মাদক সেবন। আর টাকা চেয়ে না পেলেই নির্যাতন চালাতেন রিয়ার ওপর।
রিয়ার বাবা মিজানুর রহমান বলেন, ‘দাবি অনুযায়ী যৌতুকের টাকা দিতে না পারায় নির্যাতন চালিয়ে আমার মেয়েটাকে হত্যা করা হয়েছে। সম্প্রতি ট্রাক কেনার নামে বাবার বাড়ি থেকে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এনে দিতে রিয়াকে চাপ দেয় বিপু। এতে অপারগতা প্রকাশ করলে বিপু রিয়াকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে আহত করে এবং শ্বাসরোধে হত্যার চেষ্টা চালায়। আশপাশের মানুষ ঘরের দরজা ভেঙে মেয়েকে উদ্ধার করে হাসপাতালে আনে। দুদিন পর মেয়েটা মারা যায়।’
বাংলাদেশে অর্থের জন্য নারীর ওপর স্বামীর নির্যাতনের হার জাতিসংঘের মাপকাঠিতে খুব বেশি নয়। তবে আরও কয়েকটি মাপকাঠি যোগ করে দেশীয় মানদণ্ডে দেখা যায়, বিবাহিত নারীদের প্রায় অর্ধেকই জীবনে কখনও না কখনও স্বামীদের হাতে এই কারণে নির্যাতিত হয়েছেন। আর জীবৎকালে আর্থিক কারণে একবার হলেও স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেনÑ এমন নারীর সংখ্যা অনেক বেশি।
যৌতুকের কারণে প্রায়ই স্বামীর নির্যাতনের শিকার হন জামালপুরের বাসিন্দা হুমায়রা (ছদ্মনাম)। শুধু স্বামী নয়, শাশুড়ি এবং দেবরও যৌতুকের জন্য তাকে মারধর করেন। অথচ যৌতুক দেওয়ার মতো আর্থিক সামর্থ্য তার বাবা নেই। টানা নির্যাতন সইতে না পেরে একপর্যায়ে ন্যাশনাল হেল্পলাইন সেন্টারের শরণাপন্ন হন তিনি। পরে নির্বাহী কর্মকর্তা ও সদর থানার পুলিশ বিষয়টি পারিবারিকভাবে মীমাংসা করে দেন। তারপরও কখন আবার নির্যাতন শুরু হয়, সে শঙ্কায় থাকেন তিনি।
যৌতুক ছাড়াও অন্যবিধ অর্থ-সংশ্লিষ্ট সহিংসতার শিকার হচ্ছেন নারীরা। সাম্প্রতিক সময়ে এই সহিংসতা ভয়াবহভাবে বাড়ছে।
শরীয়তপুরের বাসিন্দা নূপুরের বিয়ে হয় একই জেলার লোকমানের সঙ্গে। বিয়ের পর থেকেই স্বামী তার ভরণপোষণের টাকা দিচ্ছেন না। নূপুর বলেন, ‘টাকা চাইলেই স্বামী গায়ে হাত তোলে। আমার কথা বাদই দিলাম। আমার সন্তানের খরচের টাকাও দেয় না।’
একই ঘটনা ঘটে সিরাজগঞ্জের বাসিন্দা তানিয়ার সঙ্গে। পাঁচ বছরের সংসারে প্রতিদিনই নির্যাতনের শিকার হন তিনি। বিয়ের পর থেকে হাতখরচ দিতে গড়িমসি করেন তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। ভেবেছিলেন সংসারে সন্তান এলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। কিন্তু সমস্যা আরও বাড়তে থাকে।
তিনি বলেন, ‘সংসারে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন মানসিক নির্যাতন করত। হাতখরচ দিত না। এখন সন্তানের স্কুলের খরচের টাকাও দেয় না। কখনও কখনও গায়েও হাত তুলত। উপায় না পেয়ে আইনি সহায়তা নিই।’
জাতীয় হেল্পলাইন সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, বিগত ২০২৪ সালে হেল্পলাইন ১০৯ নম্বরে ৯ লাখ ৩৯ হাজার ৭০০টি ফোন কল আসে। এর মধ্যে ৪ লাখ ৬০ হাজার ৩৫৮টিই ছিল অর্থ-সংশ্লিষ্ট সহিংসতা সম্পর্কিত। বাকি কলগুলোর মধ্যে ৬১ হাজার ৫৯৫টি শারীরিক হেনস্থা সম্পর্কিত, ২১টি অপহরণের ঘটনায় সহায়তা কামনা, ৮৯৮টি যৌন হেনস্থা সম্পর্কিত, ৮৬৫টি বাল্যবিবাহ সম্পর্কিত, ৬টি অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় সাহায্য কামনা, ৩৮ হাজার ৫৪৭টি মানসিক নির্যাতন সম্পর্কিত, চারটি পাচার সম্পর্কিত, পাঁচটি অ্যাসিড দগ্ধের ঘটনা এবং ৩ লাখ ৭৭ হাজার ৪০১টি অন্যান্য অভিযোগ সম্পর্কিত। অর্থাৎ সবচেয়ে বেশি কল আসে অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার নারীদের কাছ থেকে। দিনে গড়ে এ-সম্পর্কিত কল এসেছে ১ হাজার ২৬১টি।
মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘অর্থ-সংশ্লিষ্ট যেকোনো কারণে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের সবটাই অর্থনৈতিক সহিংসতা। পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ অনুযায়ী মানসিক নির্যাতনও সহিংসতা। অনেককেই কাউন্সেলিং করাতে হয়। যৌতুকের কারণে নির্যাতন, খোরপোষ না দেওয়া, ভরণপোষণের টাকা না দেওয়াও অর্থনৈতিক সহিংসতা। নারীকে তার ন্যায্য হিস্যা না দেওয়াটাই নির্যাতন।’
তিনি বলেন, অর্থ-সংক্রান্ত নারী নির্যাতনের ঘটনায় প্রচুর ফোন আসে। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে কিছু ঘটনার সমাধান হয়। আবার কিছু ঘটনা আইনি পদক্ষেপের পর্যায়ে যায়। আদালতে গড়ায়। আবার যেসব সমস্যার আমরা সমাধান করে দিই সেখানে পুনরায় নির্যাতনের ঘটনা ঘটে। অনেক ক্ষেত্রেই সমাধান করা যায়। তবে আইনি পর্যায়ে চলে যাওয়ার ঘটনাগুলোর সমাধান আর আমাদের হাতে থাকে না। সেগুলোর সমাধান আইনিভাবেই হয়। অনেকেই আবার ট্রমার মধ্যে থাকে; নির্যাতনের শিকার হয়েও তা বাবার বাড়িতে বলতে পারে না। তাদের ক্ষেত্রে আমরা কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা করি।’
রেহাই নেই উপার্জনক্ষম নারীরও
ভরণপোষণের টাকা না পেয়ে নিজেই কাজের সন্ধানে নামেন নুরুন নাহার। তারপরও নিজের আয়ের টাকার ভাগ স্বামীকে না দিলেই শুরু হতো অত্যাচার। বাসাবাড়িতে ঝির কাজ করে অল্প কিছু টাকা জমিয়েছিলেন তিনি। সেই টাকাও হাতিয়ে নেন স্বামী। তিনি বলেন, ‘রক্ত-মাংস পানি কইরা টাকা জমাইছিলাম। লাখখানেক টাকা নিয়া গেছে।’
শিক্ষিত নারীরাও এই নির্যাতিতার তালিকা থেকে বাদ যাননি। বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন পারুল বেগম। স্বামীর আর্থিক অবস্থা খুব ভালো না থাকায় শ্বশুরবাড়ি ও বাবার বাড়ির অনেকটা খরচই তাকে দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘টাকা আমি দিচ্ছি, কিন্তু আমার প্রয়োজনে টাকা পাচ্ছি না। আবার আমি বাবার বাড়িতে কত টাকা দিচ্ছি, সেই হিসাব স্বামী জানতে চায়। এসব নিয়ে প্রায়ই সে আমাকে মানসিক নির্যাতন করে।’
বাদ যায়নি জুলাই অভ্যুত্থানে ক্ষতিগ্রস্ত নারীরাও
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বজন হারিয়ে অনেক পরিবার আর্থিক সংকটে পড়েছে। মিরপুর ২ নম্বরে একমাত্র সন্তান নিয়ে স্বামী শাহাদাৎ হোসেনের সঙ্গে থাকতেন সোনিয়া আক্তার। ৫ আগস্ট গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন স্বামী। অনন্যোপায় হয়ে শ্বশুরবাড়িতে চলে যান। তবে কয়েকদিনের মধ্যেই বলে দেওয়া হয় সোনিয়া ও তার সন্তানের দায়িত্ব তারা নিতে পারবেন না।
সোনিয়া বলেন, এখন আমি চলব কীভাবে। বিভিন্ন জায়গা থেকে আর্থিক সহায়তা এলেও আমি বা আমার সন্তানের জন্য কোনো টাকা দেয়নি শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এমনকি জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে তারা যে টাকা পেয়েছে, তা-ও আমাকে দেওয়া হয়নি। আমি যোগাযোগ করলে তাদের পাই না। ওই টাকা পাওয়ার পর থেকে তারা আমার সঙ্গে কোনোরকম যোগাযোগ রাখেনি।’
আন্দোলন চলাকালে স্বামীহারা আরেক নারী সোনিয়াও একই সমস্যায় পড়েছেন। তিনি বলেন, ‘জুলাই ফাউন্ডেশন থেকে পাওয়া ৫ লাখ টাকার মধ্য থেকে ৩ লাখ আমার ভাসুর নিয়েছেন। বাকি ২ লাখ আমাকে দিয়েছে। আরও যা টাকা পেয়েছে, তার কিছুই আমাকে দেওয়া হয়নি। এখন তারা আমার নামে মিথ্যা মামলা দিচ্ছে, যেন আমি কিছু করতে না পারি। আগে সব ঠিক ছিল। স্বামী মারা যাওয়ার পর টাকা-পয়সার বিষয়টা আসার পর থেকে আমার ওপর মানসিক নির্যাতন শুরু হয়েছে।’
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ডা. ফওজিয়া মোসলেম বলেন, নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার হওয়ার বেশিরভাগ ঘটনাই অর্থ-সংক্রান্ত। এটি একটি সামাজিক সমস্যা, যা নারীর আর্থিক স্বাধীনতা ও অধিকারকে বাধাগ্রস্ত করে। আইনি প্রক্রিয়ায়ও তাদেরকে অনেক হেনস্থার শিকার হতে হয়। সেজন্য অনেক নারীই নির্যাতনের শিকার হয়েও আইনি পথে আসেন না। এ সমস্যা একজন নারীর কেবল ব্যক্তিগত জীবনেই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে না, পুরো আর্থ-সামাজিক উন্নয়নেও প্রভাব ফেলে।’
বাংলাদেশের বাস্তবতায় জীবনে অন্তত একবার হলেও স্বামীর মাধ্যমে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেনÑ এমন নারীর সংখ্যা ৭৩ শতাংশ।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৫ সালে নারী নির্যাতনের ওপর খানাভিত্তিক যে জরিপ চালায়, তাতে এমন ভয়ংকর চিত্র উঠে আসে। বিবিএসের এটা দ্বিতীয় ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন সার্ভে। প্রথমটি হয়েছিল ২০১১ সালে। করোনা প্রাদুর্ভাবের সময়ের জন্য পরবর্তী জরিপটি করতে বিলম্ব হয়েছে।
জরিপে আরও দেখা যায়, ৩৯ শতাংশ নারী অভিযোগ করার প্রয়োজন বোধ করেন না। লোকলজ্জা, সামাজিক মর্যাদা, পরিবারের সম্মানহানির ভয়ে প্রায় ২৭ শতাংশ নারী অভিযোগ জানাতে চান না।
এর মধ্যে দেশের প্রেক্ষাপটে অর্থনৈতিক নির্যাতনের ব্যাপ্তি বোঝার জন্য গবেষকরা জরিপের দেশীয় মানদণ্ডে কয়েকটি সূচক যোগ করেছেন। সেগুলো হচ্ছেÑ স্ত্রীকে নিয়মিত হাতখরচ না দেওয়া, যৌতুক দাবি করা এবং বাবার বাড়ি থেকে টাকা বা জিনিসপত্র আনতে চাপ দেওয়া। এছাড়া জরিপটি নারীর নিজ আয়ে নিয়ন্ত্রণ না থাকা এবং দেনমোহর না পাওয়ার চিত্রও দেখেছে। তবে সেটা অর্থনৈতিক নির্যাতনের হিসাবে নেওয়া হয়নি।
বিবিএসের জরিপ বলছে, এক-তৃতীয়াংশের কাছাকাছি নারীর বিয়ে হয় যৌতুক দেওয়ার শর্তে। আবার প্রায় ১০ শতাংশ নারীকে স্বামীরা বাবার বাড়ি থেকে টাকা-পয়সা, জিনিসপত্র আনতে চাপ দিয়েছেন। মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, স্বামী বিয়ের সময় স্ত্রীকে নির্ধারিত অঙ্কের টাকা বা সম্পদ দেনমোহর হিসেবে দিতে বাধ্য। জরিপে দেখা যায়, বিবাহিত নারীদের মাত্র ১২ শতাংশ দেনমোহরের পুরো অর্থ বুঝে পেয়েছেন। আর ২৩ শতাংশের মতো আংশিক মোহরানা পেয়েছেন। জরিপভুক্ত বিবাহিত নারীদের ৮৫ শতাংশ বলেছেন যে নিজ আয়ের ওপর তাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।