![Image description](https://content.bdtoday.net/files/img/202502/e5cb218db8147a72c0bc9185322ce279.jpg)
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার শিকলবাহা খালে একসময় ছিল পানির অবাধ প্রবাহ। চলত বড় বড় সাম্পান, বজরা, ময়ূরপঙ্খি, পালতোলা পানসি, সওদাগরি নৌকা। তবে এখন এসব শুধুই স্মৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দখল-দূষণে জৌলুশ হারিয়েছে খালটি। খালের আশপাশে গড়ে ওঠা গরুর খামারের গোবর-মূত্রসহ বিভিন্ন বর্জ্য অবাধে মিশছে পানিতে। বর্তমানে খালটি গোবরের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে।
এদিকে শুধু শিকলবাহা খালই নয়, বিষাক্ত বর্জ্যে হুমকিতে পড়েছে কর্ণফুলী নদীও। বিভিন্ন খাল হয়ে উপজেলার ১ হাজার ২০০ খামারের বর্জ্য গিয়ে মিশছে কর্ণফুলীতে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার শিকলবাহা মাজার গেট এলাকা থেকে শুরু হয়ে আলী হোসেন মার্কেট পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার এলাকায় খালের দুই পাশে গড়ে উঠেছে গরুর খামার। এসব খামারের কয়েক হাজার গরুর গোবর আর মূত্র সরাসরি ফেলা হয় শিকলবাহা খালে। এতে খালটি এখন নোংরা ডোবা ও গোবরের ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। খালে ফেলা বর্জ্য থেকে তীব্র দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিও।
সরেজমিনে দেখা যায়, খালের দুই পাশে গড়ে ওঠা গরুর খামারের বর্জ্য পাইপ-ড্রেনের মাধ্যমে সরাসরি খালে ফেলা হচ্ছে। স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধ আবুল কাশেম বলেন, উপজেলার চারদিকঘেরা কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে মিলিত ছিল শিকলবাহা খালটি। নব্বই দশকের দিকে নৌপথে পণ্য আনা-নেওয়া করা হতো এটি দিয়ে। নৌপথে ছিল বাণিজ্যিক যোগাযোগও। কিন্তু ভূমিদস্যু ও প্রভাবশালীদের দখল-দূষণে এখন সংকটাপন্ন উপজেলার খালগুলো। শিকলবাহা খালের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ।
আব্বাস আলী নামের এক বৃদ্ধ বলেন, ‘ছোটকালে আমরা এই খাল থেকে মাছ ধরেছি, গোসলসহ ব্যবহারের জন্য ঘরে পানিও নিয়ে গেছি। কিন্তু এক যুগ ধরে ভয়াবহ দূষণের কারণে এটি এখন আর খাল নেই, গোবরের খালে পরিণত হয়েছে।’ তবে এ বিষয়ে কোনো খামারি কথা বলতে রাজি হননি।
প্রাণিসম্পদ কার্যালয়ের তথ্যমতে, কর্ণফুলী উপজেলায় ১ হাজার ২০০টি খামার রয়েছে। এসব খামারের বড় একটা অংশ কর্ণফুলী নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খালের পাড় কিংবা আশপাশে গড়ে উঠেছে।
স্থানীয় কৃষকদের অভিযোগ, খামারের বর্জ্যে ভরাট হয়ে গেছে শিকলবাহা খাল। কৃষকেরা আগে তাঁদের চাষাবাদে খালের পানি ব্যবহার করতেন, এখন তা সম্ভব হচ্ছে না। তাঁদের দাবি, বর্জ্যে দূষিত হয়ে খাল-বিল ও জলাশয়গুলো বিষের খনিতে পরিণত করেছে। এতে চরলক্ষ্যা ও শিকলবাহা ইউনিয়নের কৃষকদের বৃষ্টির পানির ওপর নির্ভর করেই চাষাবাদ করতে হয়।
জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত কর্ণফুলীর খামারি হারুন চৌধুরী বলেন, বিগত সরকারের আমলে খালটি খনন করা হয়েছিল। খালের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিত কালভার্ট নির্মাণসহ ঠিকাদার যেসব বাঁধ দিয়েছিল, সেগুলো এখনো রয়ে গেছে, যে কারণে কর্ণফুলী নদী থেকে পানি ঢুকছে না খালে। এ ছাড়া মইজ্জ্যারটেক এলাকায় পশুর বাজারের বর্জ্য ফেলাসহ খালের বিভিন্ন স্থান দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বিভিন্ন স্থাপনা। অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করে খালটি খননে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) আওতাধীন শিকলবাহা খালটি এই জনপদকে বন্যার পানি থেকে রক্ষা করে। এ ছাড়া বিভিন্ন এলাকার হাজার হাজার কৃষক সেচের জন্য এই খালের পানিই ব্যবহার করতেন। কিন্তু দূষণে মৃতপ্রায় এই খাল এখন কৃষকদের কোনো কাজে আসছে না। দুই বছর আগে ২ কোটি ৪ লাখ ১৫ হাজার টাকা ব্যয়ে খালটি পুনঃখনন করে পাউবো। মেসার্স গরিবে নেওয়াজ এন্টারপ্রাইজ নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান খননকাজ বাস্তবায়ন করে। তবে এ নিয়ে স্থানীয়দের অভিযোগ, অপরিকল্পিত খননে কোটি
টাকা খরচ করেও রক্ষা হয়নি খালটি। সে সময় খালের প্রায় ৯ কিলোমিটার অংশে খননকাজে অনিয়মের অভিযোগও তুলেছিলেন স্থানীয়রা।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শওকত ইবনে শাহিদ বলেন, পাউবোর ডেল্টাপ্ল্যানের আওতায় খালটি পুনর্জীবিত ও চাষাবাদে কৃষকদের উপকারের উদ্দেশে খনন করা হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে এটি আগের অবস্থায় রূপ নিয়েছে। খালটি রক্ষায় পরিবেশ অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘খালটি রক্ষায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’
প্রসঙ্গত, ২০২২ সালের ৯ মে শিকলবাহা খালকে দূষণমুক্ত করা ও ডেইরি ফার্ম থেকে সৃষ্ট বর্জ্য জৈব সার হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা নিয়ে একটি বিশেষ সভা চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। করা হয় একটি কমিটিও। তবে খাল দূষণমুক্ত করতে নানা পরিকল্পনা নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি।
চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তোলা গরুর খামারের বর্জ্য গিয়ে মিশছে শিকলবাহা খালে। এতে খালটি ভরে গেছে গোবর আর গোমূত্রে। নেই আগের সেই অবাধ পানিপ্রবাহ। ছবিটি সম্প্রতি উপজেলার শিকলবাহা ইউনিয়নের চরফরিদ এলাকা থেকে তোলা। আজকের পত্রিকা