Image description
অর্থনীতিতে শ্লথগতি

বিনিয়োগসহ অর্থনীতিতে স্থবির অবস্থা বিরাজ করছে। খারাপ হচ্ছে অর্থনীতির সূচকগুলো। ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিস্থিতি নিয়ে বহুমুখী সংকটের কথা বলছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা। অভ্যন্তরীণ ও বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক ধারা চলছে। অর্থ সংকটের কারণে ব্যাংকগুলো টাকা দিতে পারছে না গ্রাহকদের। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে বেশিরভাগ ব্যাংক। আবার মাত্রাতিরিক্ত সুদহারের কারণে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। এ পরিস্থিতিতে গোটা অর্থনীতিতে বিরাজ করছে শ্লথগতি।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের মেয়াদে ২৮ লাখ টাকা বিদেশে পাচার করা হয়েছে। ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা নিয়ে পাচার করা হয়। এছাড়া ঋণখেলাপিদের হাতে আটকে আছে পৌনে তিন লাখ কোটি টাকা। বিপুল অঙ্কের খেলাপির টাকা আদায় করতে পরছে না ব্যাংকগুলো। যে কারণে অধিকাংশ ব্যাংক আর্থিক সংকটের মুখে পড়েছে। ফলে এই সময়ে কিছু ভালো শিল্প উদ্যোক্তার ঋণের চাহিদাও তারা মেটাতে পারছে না।

এ পরিস্থিতিতে চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ টাকার সরবরাহ ও অভ্যন্তরীণ ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল সেখান থেকে সরে আসছে অন্তর্বর্তী সরকার। ঋণ ও টাকা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

এসব ঘটনা দেশের অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ নিজেই। জানতে চাইলে তিনি যুগান্তরকে বলেন, সামষ্টিক অর্থনীতিতে অনেক চাপ আছে। এখন অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখাই বড় চ্যালেঞ্জ। এটি না হলে অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক ব্যবসা-বাণিজ্য এবং মানুষের জীবনধারণ কোনোটাই স্বাভাবিক থাকছে না। তিনি বলেন, বিনিয়োগ বাড়াতে সরকার উদ্যোগ নিয়েছে। যখন দেশি বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন থাকেন তখন বিদেশিরাও আসেন না। তবে প্রধান ইস্যু হলো সুদের হারটা একটু বেশি। ব্যবসায় ইন্টারেস্ট রেট একমাত্র ব্যয় নয়। সরকার দুর্নীতি বন্ধে জোর দিচ্ছে। এতে ব্যবসার খরচ কমে আসবে। তিনি আরও বলেন, কোথাও অর্থ নেই, সব ব্যাংক থেকেই ওরা টাকা নিয়ে গেছে।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ব্যাংকের টাকা লুটপাট ও পাচারের অভিযোগে বেশকিছু শিল্পোদ্যোক্তা পলাতক। ফলে অনেকের কলকারখানা বন্ধ। কারণ এসব শিল্পপ্রতিষ্ঠান সরকারি টাকায় চলত। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে পরিচালনা করা হতো। আবার সম্ভাবনাময় অনেক শিল্পকারখানাও অর্থাভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। এছাড়া ব্যাংকের টাকা খেয়ে ফেলায় দেশের ৬০ ব্যাংকের মধ্যে ৪৮টি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে। ফলে ব্যাংকগুলো আগের মতো ঋণ ইস্যু করতে পারছে না।

সাধারণত অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো থাকলে বাজারে টাকার চাহিদা থাকে। ওই চাহিদা অনুযায়ী নগদ অর্থ সরবরাহ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে বাজারে টাকা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ৯ দশমিক ২ শতাংশ ধরা হলেও এখন কমিয়ে ৮ দশমিক ৪ শতাংশে আনা হচ্ছে।

অর্থ বিভাগ চলতি অর্থবছরে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা ১১ দশমিক ৭ শতাংশ নির্ধারণ করলেও তা কমিয়ে ১১ দশমিক ৬ শতাংশ করেছে। দেশে মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল এক লাখ ৬০ হাজার ৯০০ কোটি টাকা।

অর্থ বিভাগ মধ্যমেয়াদি সামষ্টিক অর্থনৈতিক কাঠামোতে মুদ্রা ও আর্থিক খাতে এসব সূচকের সংশোধন এনেছে। যা সম্প্রতি অনুমোদন দিয়েছেন অর্থ উপদেষ্টা। তবে আগামীতে বেসরকারি খাতের পরিস্থিতি ভালো হতে পারে এমন প্রত্যাশা থেকে বেসরকারি ঋণ প্রবাহের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়িয়েছে। যেখানে ৯ শতাংশ ছিল সেটা বাড়িয়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ করা হয়েছে।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর অর্থ আগামীতে বিনিয়োগ কমবে। আর বিনিয়োগ কমলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। ফলে দারিদ্র্য বিমোচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। শুধু তাই নয়, জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তাও অর্জন হবে না।

এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি যুগান্তরকে জানান, বিভিন্ন কারণে এখন অর্থের চাহিদা কমেছে। বিনিয়োগ হচ্ছে না, উৎপাদন কম, যার ফলে বেসরকারি খাত স্থবির হয়ে আছে। অর্থনীতির চালক বেসরকারি খাত স্থবির হলে গোটা অর্থনীতির খাতই স্থবির হয়ে পড়ে। যা এখন হয়েছে। এই অবস্থায় মুদ্রার চাহিদা কিভাবে বাড়বে। এদিকে রাজস্ব আহরণ কম থাকায় সরকার নিজের ব্যয় মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে। তার মতে বাজারে নগদ মুদ্রা সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েছে বাস্তবতার সঙ্গে মিল রাখার জন্যই।

অর্থ বিভাগের সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হচ্ছে, এতে কতটা চাপ পড়ছে সেটা বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। এখন বেসরকারি খাতে গতি আনতে পারলে বাজারে বাড়বে নগদ টাকা এবং ব্যাংক ঋণের চাহিদা। সে লক্ষ্যে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা একটি বৈঠক করেছেন ব্যাংকের প্রধানদের সঙ্গে। ওই বৈঠকে অর্থ উপদেষ্টা কিভাবে বেসরকারি খাতে ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি বাড়ানো যায় সে ব্যাপারে নির্দেশনা দিয়েছেন।

জানতে চাইলে বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম যুগান্তরকে জানান, বিনিয়োগের জন্য নতুন করে চিন্তার সুযোগ নেই, বেঁচে থাকার জন্য এই মুহূর্তে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। আমরা এখন আইসিইউতে আছি। আইসিইউতে থেকে স্বাভাবিক কার্যক্রমের চিন্তা করা যায় না। পাশাপাশি ঋণের সুদহারও বেশি। ব্যাংকে নানা ধরনের সংকট চলছে। এত সংকট মোকাবিলা করে বিনিয়োগ করার মানসিকতা ব্যবসায়ীদের নেই। ফলে বিনিয়োগ কমেছে এবং ঋণের চাহিদাও কমছে। তিনি আরও বলেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আইসিইউতে আছে, এরপর লাইফ সাপোর্টে যেয়ে বন্ধ হয়ে যাবে।

বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার বিষয়টি উঠে আসে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে। সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগে (এফডিআই) বড় ধরনের পতন হয়েছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-সেপ্টেম্বর এই ৩ মাসে গত অর্থবছরের একই প্রান্তিকের তুলনায় নিট বিদেশি বিনিয়োগ কমেছে প্রায় ৭১ শতাংশ, যা গত ১১ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে মূলধনী যন্ত্রাংশ আমদানি কমেছে ২৬ শতাংশ।