ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে লাশ ফেলার মাস্টারমাইন্ড পলাতক পুলিশ কর্মকর্তারা দেশে ও দেশের বাইরে থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিরুদ্ধে নানামুখী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। একই সাথে এ সব পুলিশ কর্মকর্তারা আড়ালে থেকে নানাভাবে পুলিশ বাহিনীকে দুর্বল করতে ষড়যন্ত্র করছে। বর্তমান সরকারের ছয় মাস হলেও ছাত্র-জনতার হত্যার সাথে জড়িত পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের জোর উদ্যোগ না থাকায় এরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। এদের অন্যতম সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, সাবেক ডিআইজি সিটিটিসি প্রধান আসাদুজ্জামান, সাবেক অতিরিক্ত ডিআইজি বিপ্লব কুমার সরকার ও প্রলয় কুমার জোয়ারদারসহ অনেকেই।
পলাতক থেকে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তাদের উস্কে দেয়ার চেষ্টা করছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা। অভিযোগ রয়েছে, নেপথ্যে থেকে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই মোটা অংকের টাকা খরচ করে প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বঞ্চিত ও ত্যাগী পুলিশ কর্মকর্তাদের নিয়ে সাজানো গল্প তৈরি করছেন পুলিশের মনোবল দুর্বল করতে। এদের উদ্দেশ্য পুলিশ বাহিনীর পেশাদার ও ত্যাগি কর্মকর্তারা ভেঙ্গে পড়লে বর্তমান সরকার দুর্বল হয়ে পড়বে। দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিতেও প্রভাব পড়বে।
সূত্র জানায়, বহুলআলোচিত সাবেক আইজিপি বেনজীর আহম্মেদের টেলিফোনের একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। ওই বক্তব্যে বেনজীর আহম্মেদ বলছেন, যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিলো, তারা তো অনেকবার ক্ষমতায় ছিলো, আওয়ামী লীগের এন্টি ফোর্স ফোর্সেস এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় ছিলো, তখন তারা অনেক এন্টি আওয়ামী ফোর্সেস পুলিশে ঢুকিয়েছে। সেগুলো সামনে নিয়ে এসেছে। তারা তো অনেক রয়েছে। জেনারেললি পুলিশের তারা খুব হাইলি ডিমোরালাইজড। সংক্ষুব্ধ এই সরকারের ওপর। বিকজ এদেরকে হত্যা করেই এরা ক্ষমতায় এসেছে। ৪২৭টি ফাঁড়ি ও থানা এ্যাটাক করা হয়েছে। অস্ত্রপাতি লুট করা হয়েছে। পুলিশ কনস্টেবলকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে। এগুলোতো তারা সহজভাবে মেনে নেয়নি। লোয়ার র্যাংক কনস্টেবল থেকে ইন্সপেক্টর একটি বিশাল অংশ খুবই আজ্ঞাবহ। এরাই গ্রেফতার করছে।
৫ তারিখের পরে একটি বিশাল অফিসার গ্রুপ এরা কর্মস্থল ত্যাগ করেছে। যারা আর আসেনি। আর তিন-চারশ’ অফিসারকে ডিউটি থেকে তুলে নিয়ে অকার্যকর করে রেখেছে। একটি বিশাল গ্রুপকে চাকরি থেকে বের করে দিয়েছে। রিটায়ার্টদের চাকরিতে নিয়ে এসেছে। আমিও চেষ্টা করছি যারা চাকরিতে আছে তাদের নিয়ে একটি প্যাশন করার জন্য। দেখা যাক, যদি করতে পারি ইনশাআল্লাহ আরো সুবিধা পাওয়া যাবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পুলিশ সদর দফতর ও ডিএমপিসহ ঢাকাস্থ বিভিন্ন ইউনিটে কর্মরত জাতীয়তাবাদ ও ইসলামপন্থীদের গত ১৬ বছরে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সময় ব্যাপকভাবে বঞ্চিত করা হয়েছে। পুলিশে আওয়ামী সিন্ডিকেটের সহযোগীরা গত বছরের ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ের সুবিধা ভাগিয়ে নিয়ে গোপনে তাদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের মাধ্যমে বর্তমান সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রমের তথ্য ফাঁস ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছেন। এদের চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে আগামীতে এরা আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করছেন।
আইজিপি বাহারুল আলম ইনকিলাবকে বলেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে হত্যাকা-ের সাথে জড়িত পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। এরই মধ্যে ৩৪ জন পুলিশকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে আমরা কাজ করছি।
ছাত্র-জনতার হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তারা পলাতক অবস্থায় সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। তারা দেশে ও দেশের বাইরে থেকে নানাভাবে সক্রিয় রয়েছে এমন প্রশ্নের জবাবে আইজিপি বাহারুল আলম বলেন, পলাতক পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। যারা দেশের বাইরে রয়েছেন সেসব পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেফতারে ইন্টারপোলের সাহায্য নেয়া হচ্ছে।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানোর সাথে জড়িত ও হুকুমদাতা পুলিশ কর্মকর্তারা এখনো অধরা। হত্যা মামলার আসামি হয়েও রহস্যজনক কারণে ৯৪ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করা হচ্ছে না। অথচ এসব পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে শত শত। যে সব পুলিশ কর্মকর্তারা সততা ও নিষ্ঠার সাথে ভঙ্গুর পুলিশ বাহিনীকে পুনঃগঠনে রাত দিন কাজ করছেন তাদের বিরুদ্ধে চলছে নানামুখী ষড়যন্ত্র।পুলিশ সদর দফতরের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, বিগত সময়ে যে সব পুলিশ কর্মকর্তা অবৈধ ক্ষমতা ব্যবহার করে শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন, তারাই এখন নেপথ্যে থেকে পুলিশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করছেন। নেপথ্যে থেকে অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের অনেকেই মোটা অংকের টাকা খরচ করছে পুলিশের মনোবল দুর্বল করতে। পুলিশের পলাতক শীর্ষ কর্মকর্তাদের গ্রেফতার ও বিচার এবং তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার দাবি যখন জোরালো হচ্ছে তখন ওইসব পলাতক কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অপকর্মের ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা সারাদেশের পুলিশ সদস্যদেরকে বিভ্রান্ত করছে। ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এই গণ-অভ্যুত্থানের পর দেশের জনশৃঙ্খলার কাজে নিয়োজিত না হয়ে বিগত ফ্যাসিবাদী সরকারের দোসর পলাতক পুলিশ কর্মকর্তাদের দ্রুত গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনা হোক এটাই জনগণের প্রত্যাশা।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন, একতরফা ও মধ্যরাতের নির্বাচনে কাজ করা এবং তৎকালীন সময়ের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন কর্মকর্তারা রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ পদে। এসব কর্মকর্তাদের কাজকর্ম অনেকটাই আওয়ামী ধরনের। এ বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দফতরের নীতি নির্ধারকরা অন্ধ। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করায় মাঠপর্যায়ের পুলিশে চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে না। স্থবির হয়ে পড়েছে পুলিশ সদর দফতরসহ পুলিশের বড় বড় ইউনিটের মনিটরিংয়ে।