Image description
ব্যবহার হচ্ছে এনআইডি তৈরিসহ নানা অপরাধমূলক কাজে

ঠিকানা জটিলতায় ভুগছে দেশের অগণিত মানুষ। একই বাড়িতে পাঁচ ভাইবোনের ঠিকানা ভিন্ন রকমের। সরকারি অফিসগুলোতেই একই জায়গার একাধিক নাম ও বানান ব্যবহার করছে। এতে জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি), পাসপোর্ট, বিভিন্ন সার্টিফিকেট, জমি রেজিস্ট্রেশন, বিদেশে উচ্চশিক্ষাসহ নানান কাজে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। ভুল ঠিকানা ব্যবহারের সুযোগ নিয়ে অনেকে একাধিক এনআইডি তৈরিসহ নানা অপরাধেও লিপ্ত হচ্ছে।

আগারগাঁও বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিস হতে ই-পাসপোর্টের জন্য সম্প্রতি আবেদন করেন মোসা. রাশিদা বেগম। দাখিল করেছেন ৮২০৭৯৩০৪৫৭ নম্বরের এনআইডি। ডেটাবেস পর্যালোচনা করতে গিয়ে পাসপোর্ট অফিস তার আরেকটি এনআইডি পায়। যার নম্বর ৭৩০২৫৬৭১৪৯। এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানানোর অনুরোধ করে গত মাসে নির্বাচন কমিশনের এনআইডি শাখায় পত্র দেয় পাসপোর্ট অফিস।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা গেছে, সারা দেশে এমন দ্বৈত এনআইডি ধরা পড়েছে প্রায় ৫ লাখ। গাইবান্ধার সাদুল্যাপুরেই পাওয়া গেছে এমন ২৯টি এনআইডি। অনেকের ফিঙ্গার প্রিন্ট স্পষ্ট না হওয়ায় ক্রস ম্যাচিংয়ে ধরা পড়ে না। তখন ঠিকানা কিছুটা বদলে দ্বৈত ভোটার হন। অনেকে স্থানীয় নির্বাচন অফিসে ঘুষ দিয়ে অপ্রাপ্ত বয়স্ক কারও ফিঙ্গার প্রিন্ট বা পায়ের আঙুলের ছাপ ব্যবহার করে একাধিক এনআইডি করে। ব্যবহার করে ভুয়া ঠিকানা। পরবর্তী সময়ে এসব এনআইডি জাল ভোটসহ নানা প্রতারণায় ব্যবহার হয়। ভুয়া এনআইডি দিয়ে বিকাশ, নগদের মতো অ্যাকাউন্ট খুলে প্রতারণার ঘটনাও হরহামেশা ঘটছে। এনআইডির ঠিকানা অনুযায়ী ঘটনাস্থলে গিয়ে অপরাধীর হদিস পাচ্ছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের বিভাগ, জেলা, উপজেলা, ইউনিয়ন, পৌরসভা, সিটি করপোরেশন, মৌজা, গ্রাম, ওয়ার্ড, পোস্ট অফিস ও থানা নিয়ে একক ডেটাবেস না থাকায় ঠিকানা নিয়ে জটিলতা তৈরি হচ্ছে। এতে মানুষের ভোগান্তি যেমন বাড়ছে তেমনি অপরাধ-প্রতারণা বাড়ছে। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারি বাহিনীসহ বিভিন্ন দপ্তরে ঠিকানা যাচাইসংক্রান্ত জটিলতা বাড়ছে। শুধু একটি প্রকল্প নিয়ে সব ঠিকানা এক করে গেজেট নোটিফিকেশন ও সেন্ট্রাল অনলাইন ডেটাবেস করলে অনেক কাজ সহজ হয়ে যাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। পরিসংখ্যানকেন্দ্রিক অনেক প্রকল্পের ব্যয় কমে যাবে।

এদিকে ঠিকানা জটিলতায় নানামুখী হয়রানি পোহাচ্ছেন অনেকে। ভুক্তভোগীরা বলছেন, এখন প্রতিটা কাজে ইংরেজি বানান দরকার পড়ছে। স্কুলে ভর্তিতে জন্মনিবন্ধন লাগছে। পাসপোর্ট করতে লাগছে এনআইডি বা জন্মনিবন্ধন। সব জায়গায় ইংরেজি বানান লাগে। অথচ এনআইডিতে ইংরেজি বানান নেই। আবার কোনো এলাকার নামের সঠিক বানান কোনটি তা ঠিক করতে পারছে না সংশ্লিস্ট দপ্তরগুলো। স্থানীয় সরকার ইউনিটগুলোর কর্মচারীরা নিজের মর্জিমাফিক লিখে দিচ্ছে। পরবর্তী সময়ে নানান কাজে জটিলতায় পড়তে হচ্ছে। অনেক সময় ফরম পূরণ করে দিলেও কম্পিউটারে তথ্য ইনপুট দেওয়ার সময় সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মীরা ভুল করছেন। পরে সেটা সংশোধনে হয়রানি পোহাতে হচ্ছে। অথচ অনলাইনে ফরম পূরণের ব্যবস্থা ও সেখানে কেন্দ্রীয় ডেটাবেস থেকে ঠিকানাগুলো (বিভাগ, জেলা, থানা, গ্রাম ইত্যাদি) যদি স্বয়ংক্রিয়ভাবে এলে ভুলের সুযোগ থাকত না।

জানা গেছে, নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার একটি ইউনিয়ন মুছাপুর। কোথাও লেখা হচ্ছে মুসাপুর। ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেওয়া চারিত্রিক সনদপত্রে কোথাও লেখা Musapur, কোথাও Muccapur। উপজেলার ওয়েবসাইটে ইউনিয়নের নাম মুছাপুর, ইউনিয়নের ওয়েবসাইটে মুসাপুর। মোংলা পোর্ট পৌরসভার একটি গ্রামের নাম কোথাও লেখা হচ্ছে শেলাবুনিয়া, কোথাও শেহলাবুনিয়া, কোথাও শেহালাবুনিয়া। ভূমি অফিসগুলো লিখছে সেলাবুনিয়া বা সেহলাবুনিয়া (দন্ত্য দিয়ে)। ইংরেজি বানান ব্যবহার করা হয়েছে Shelabunia, Shahalabunia, Shehalabunia। অনলাইনে পাসপোর্টের আবেদন পূরণ করতে গেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পোস্ট অফিসের নামের বানান আসছে Sheolabunia|। 

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে আগারগাঁও পাসপোর্ট অফিসের এক কর্মকর্তা বলেন, আমরা পোস্ট অফিসের ডেটাবেস ব্যবহার করি। সেখানে যেভাবে দেওয়া আছে, পাসপোর্ট ফরমে তেমনটাই আসে। আর দ্বৈত এনআইডি পেলে পাসপোর্ট আটকে দেওয়া হয়।

বানান জটিলতা নিয়ে বিভিন্ন পৌরসভা, ইউনিয়ন পরিষদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বললে তাঁরা জানান, দেশের বেশির ভাগ মানুষের ঠিকানায় হযবরল অবস্থা। ঠিকানা নিয়ে একক ডেটাবেস থাকলে ত্রাণ বিতরণ, নাগরিকের অর্থনৈতিক অবস্থা যাচাই, মামলার তথ্য- সব সহজে শনাক্ত করা সম্ভব। পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজন হয় না। জন্মনিবন্ধন, এনআইডি, পাসপোর্ট, ভূমি সেবা, সরকারি বিভিন্ন সেবা প্রাপ্তি, আসামি শনাক্তকরণ, নাগরিকত্ব যাচাই, সনদ প্রদান ইত্যাদি সহজ হতো। এনআইডি নম্বর দিলে শুধু ছবি এলেও বাড়িভাড়া, হোটেলভাড়া ইত্যাদিতে পরিচয় যাচাই সহজ হতো। বিয়ের ক্ষেত্রে পাত্রের চরিত্র যাচাইয়ে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে গোয়েন্দাগিরি করতে হতো না। কেউ পরিচয় গোপন করে একাধিক বিয়েও করতে পারত না। বিদেশভ্রমণ, উচ্চশিক্ষা, জমিনিবন্ধন, চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে ঠিকানা জটিলতায় পড়তে হতো না। কমত অপরাধ।