Image description

একটি দেশের উন্নয়ন ও সার্বভৌমত্বের সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজস্ব। ইতিহাসের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে নানা কাহিনি। কোনো শাসক নিজেদের সম্পদের ভান্ডার বড় করার জন্য প্রজাদের ওপর চাপিয়ে দিত করের বোঝা, আবার অনেক প্রজাপ্রেমী শাসক ছিলেন যারা সহনীয় মাত্রায় করারোপ করতেন। ভারতীয় উপমহাদেশে ১৭৮৬ সালে প্রথম বোর্ড অব রেভিনিউ গঠন করে ব্রিটিশরা। স্যার জন শোরকে ১৭৮৭ সালে বোর্ড অব রেভিনিউর প্রথম প্রেসিডেন্ট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।

অন্যদিকে ১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহজনিত ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য ১৮৬০ সালে ভারতে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়কর ব্যবস্থা প্রবর্তন করে ব্রিটিশ সরকার। পরবর্তীতে ১৮৮৬ সালে পৃথক ও পূর্ণাঙ্গ ইনকাম ট্যাক্স অ্যাক্ট প্রবর্তিত হয়। যার ধারাবাহিকতায় ১৯৮৪ সালের ইনকাম ট্যাক্স অর্ডিনেন্স চালু হয়, যা আয়কর আইন হিসেবে বাংলাদেশে চালু আছে।

যুগের প্রয়োজনে পরিবর্তন হয়েছে রাজস্ব ব্যবস্থার। অনেক সময় শ্রেণি বৈষম্যের কারণেও করারোপ করা হতো। তার মধ্যে একটি হলো স্তন কর, ১৮০৩ সাল পর্যন্ত ভারতের কেরালাসহ কিছু অঙ্গরাজ্যে হিন্দুদের এই কর দিতে হতো। যার আরেকটি নাম মুলাক্কারাম। তখন নিয়ম ছিল ব্রাহ্মণ ব্যতীত অন্য কোনো হিন্দু নারী তার স্তনকে ঢেকে রাখতে পারবে না। শুধু ব্রাহ্মণ শ্রেণির হিন্দু নারীরা তাদের স্তনকে এক টুকরো সাদা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতে পারত। বাকি হিন্দু শ্রেণির নারীদের প্রকাশ্যে স্তন উন্মুক্ত করে রাখতে হতো। তবে যদি কোনো নারী তার স্তনকে কাপড় দ্বারা আবৃত করতে চাইত, তবে তাকে স্তনের সাইজের ওপর নির্ভর করে ট্যাক্স বা কর দিতে হতো। অর্থাৎ যার স্তন বড় তাকে বেশি, যার ছোট তাকে কম কর দিতে হতো। 

আবার রাশিয়ায় ছিল হাস্যকর একটি কর। ১৭০৫ সালে রাশিয়ার সম্রাট প্রথম পিটার দাড়ির ওপর করারোপ করেন। তিনি এক বিশেষ টোকেনের ব্যবস্থা করেন। সেই রুপার টোকেনের একপাশে ছিল একটি ঈগলের ছবি। অন্যপাশে দাড়িওয়ালা একজন মানুষের মুখের নিচের ছবি। টোকেনে লেখা থাকত, ‘দাড়ির ওপর ট্যাক্স নেওয়া হলো ও দাড়ি হলো এক প্রকারের বোঝা।’

দাড়ির ওপর কর নেওয়ার বিরল এ ইতিহাসের খোঁজ মেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) উদ্যোগে আয়োজিত রাজস্ব মিউজিয়ামে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো রাজস্ব সম্মেলনের পাশেই এ মিউজিয়ামের আয়োজন করা হয়েছে।

৫ ও ৬ ফেব্রæয়ারি আয়োজিত এ রাজস্ব সম্মেলন ঘুরে দর্শনার্থীরা জানতে পেরেছে আয়কর, কাস্টম ও ভ্যাটের নানা ইতিহাস। মিউজিয়ামে রয়েছে ১৯৭১ থেকে ২০১০ সালের বাজেট বক্তব্য। ১৯৭৬, ১৯৯৬ ও ২০০৯-এর অর্থ আইন, ১৯৮৪ সালের আয়কর অধ্যাদেশ। এ ছাড়া স্থান পেয়েছে ১৯৬১ সালের ট্রেজারি চালান, ১৯৫১ সালের কাস্টম হাউসের দাখিল অব এন্ট্রির মতো মূল্যবান দলিলপত্র।

বিভিন্ন সময়ে খেলনা গাড়ি, জুতার হিলে করে স্বর্ণ আনার নিরন্তর প্রচেষ্টা রুখে দেয় বাংলাদেশ কাস্টম। এসব পণ্যও মিউজিয়ামে প্রদর্শন হচ্ছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৯৭৭ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমে আটক করা লুইস এক্সভি ঘড়ি ও রেডিও, ক্যাসেট টেপ, চাঁদের পাথর ও ধূলিকণা পৃথিবীতে আনার প্রথম কাস্টম ঘোষণাপত্র, ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম কাস্টমে জুতার হিলের মধ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের দায়ে আটক করা জুতা, রামবুটান, নেসক্যাফে কফি ও ঐতিহাসিক বিভিন্ন মূর্তি। মিউজিয়ামে আরও স্থান পেয়েছে শিল্পীর তুলিতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য জাহাজ, মোগল আমলের খাজনা আদায়, প্রাচীন রোম বন্দর ২৯০০ খ্রিস্ট-পূর্বাব্দের তাম্রযুগের বিভিন্ন মুদ্রা ও নানা ঐতিহাসিক ঘটনার ছবি।

এ ছাড়াও এম নুরুল কাদেরের নিজ হাতে লেখা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বরাদ্দকৃত ব্যয়ের হিসাব বিবরণী, ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান আমলের কাস্টমস ম্যানুয়াল।

জাদুঘর ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্য সচিব ও যুগ্ম কমিশনার তরিকুল ইসলাম বলেন, এনবিআরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরতেই আমাদের এই প্রচেষ্টা। ভবিষ্যতে আমাদের নতুন রাজস্ব ভবনে স্থায়ী একটি মিউজিয়ামে রূপ দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। আমাদের মিউজিয়াম পরিদর্শন করলে আয়কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগ সম্পর্কে সহজ ও সুন্দর একটি ধারণা পাবে দর্শনার্থীরা। একই সঙ্গে আমরাও আমাদের ইতিহাস ও কর্মকাণ্ড তুলে ধরতে পারলাম। 

তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী আমাদের এই মিউজিয়াম পরিদর্শন করে উদ্দীপনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি আমাদের এই মিউজিয়ামকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার পরামর্শ দিয়েছেন।