‘আমার বা বিএনপির জন্যে রাজনীতি ডিফিকাল্ট হয়নি’— নতুন নেত্রী খালেদা জিয়া
প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকারগ্রহণ: কাজী জাওয়াদ
নব্বইয়ের দশক ছিল খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উত্থানের দশক। সেনাশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে রাজপথে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনই তাঁকে এনে দিয়েছিল ‘আপোষহীন নেত্রী’র তকমা। তাঁর ক্যারিশমাটিক নেতৃত্বের বলেই ৯১’র নির্বাচনে বিএনপি জয়লাভ করে।
৮৪ সালে বিচিত্রাকে দেওয়া এই সাক্ষাৎকারটি বেগম জিয়ার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকের সাক্ষাৎকার। এর মাত্র ৩ মাস আগে তিনি বিএনপির দলনেতা মনোনীত হন। এই সাক্ষাৎকারে বেগম জিয়া বেশ স্পষ্টভাবেই তাঁর ও বিএনপির তৎকালীন রাজনৈতিক মিশন ও ভিশন তুলে ধরেন।
শুরুতে প্রতিবেদক তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি— বিশেষত বিএনপির দলীয় পরিস্থিতির একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন; পাশাপাশি খালেদা জিয়ার তৎকালীন রাজনৈতিক ভূমিকার গুরুত্ব তুলে ধরেন। এরপর মূল সাক্ষাৎকারে বেগম জিয়া প্রধানত ৭ দল ও ১৫ দলের যুগপৎ আন্দোলন, ৫ দফা, উপজেলা নির্বাচন বর্জন, গণতন্ত্রকে টেকসই করার উপায়, সংসদ নির্বাচন, দলের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলেন।
‘আখড়া’র পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি আর্কাইভ থেকে তুলে এনে ট্রান্সক্রাইব ও সম্পাদনা করেছে আখড়া টিম।]
‘আই শ্যাল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট’— জিয়া
সামরিক আইন জারি হবার পর প্রায় দু’বছরে নেতাহীন বিএনপি কয়েক দফায় ভেঙেছে। ভাঙন ছিল নিষ্ক্রিয়তার কারণে নেতৃবর্গের আকাঙ্ক্ষার বিপরীত অবস্থানের জন্যে। এটা ছিল খুব স্বাভাবিক। বিএনপি’র জন্ম হয়েছিল ক্ষমতার সঙ্গে সংযুক্ত থেকে, মুক্তাঙ্গনে নিজেদের মানিয়ে নিতে অনেকেই পারেননি। কিন্তু ২৮ নবেম্বরের পর বিএনপি’র ‘বেগম সাহেব’ খালেদা জিয়া দলনেতা হিসেবে গ্রাহ্য হয়েছেন। প্রায় অরাজনৈতিক চরিত্রের বিএনপি নতুন প্রেক্ষিত পেয়েছে, কারিশমার রাজনৈতিক প্রতিযোগিতায়, ব্যক্তিকেন্দ্রীক রাজনৈতিক কর্মকান্ডে নতুন নেতা পেয়েছে।
বিপরীতধর্মী রাজনৈতিক এবং অনেক ক্ষেত্রে অরাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া বিএনপিতে। তাঁর মৃত্যুর পর বিচারপতি আবদুস সাত্তার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। নির্বাচনের কয়েক মাসের মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরে দলীয় কোন্দলের, মন্ত্রিপরিষদের কতিপয় সদস্যের অযোগ্যতা, অসততার অভিযোগে সাত্তার সরকারকে সরিয়ে বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণ করে। সামরিক শাসন থেকে গণতন্ত্রে উত্তরণের জন্যে সরকার পরিস্থিতি তৈরি করবে বলে আভাস দেয়া হয়।
তিরাশি সালেই ফেব্রুয়ারী মাসে ছাত্রদের আন্দোলন খুব তীব্র হয়ে দেখা দেয়। ছাত্ররা সরকারের প্রস্তাবিত শিক্ষানীতির বিরুদ্ধে তাদের আন্দোলন গড়ে তোলে। ১৪ ফেব্রুয়ারী মিছিল করে শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজপথে বেরিয়ে এলে ছাত্রদের ওপর গুলি চালানো হয়। কিন্তু এর প্রতিক্রিয়া ছাত্রদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। তখন রাজনীতিকরা ব্যক্তিগত এবং দলগতভাবে দ্বিধান্বিত। কারণ বড় সব ক’টি দলের মধ্যে ছিল অস্থিরতা, দলীয় কোন্দল। ছাত্রদের সার্বিক চেষ্টায়ও ফেব্রুয়ারীর আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠেনি। দীর্ঘদিনের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এবং ঢাকাসহ অন্যান্য শহরের স্কুল কলেজগুলো বন্ধ করে দেয়া হয় বলে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুললে এই আন্দোলন ভিন্নখাতে মোড় নেয়। ছাত্রদের সীমাবদ্ধ দাবী ছাড়িয়ে তাতে রাজনৈতিক দাবী যুক্ত হয়।
এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোয় ভাঙনের জোয়ার লাগে। এগুলো মূলতঃ সরকারের সঙ্গে সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। যার জন্যে আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’র মত বড় দলও জোটে যোগ দেয়। রাজনৈতিক দলগুলো জোটবদ্ধ হয় মূলতঃ তিনটি শিবিরে। শিবিরেও ভাঙন দেখা দেয় পরবর্তীতে সংলাপকে কেন্দ্র করে। এদিকে রাজনীতি আবার হয়েছে ঘরোয়া, সংলাপেও বসে দলগুলো, এখন সামনে এসেছে নির্বাচন।
১ নবেম্বর হরতাল এবং ২৮ নবেম্বর ‘ঘেরাও’ কর্মসূচীকে কেন্দ্র করে বিরোধী দলের কর্মকাণ্ড শুরু হলেও রাজনৈতিক অবস্থা এখনো তরল বলেই মনে হয়— দু’অবস্থানেরই। কিন্তু এখন বেগম জিয়া প্রত্যক্ষ অবস্থানে রয়েছেন। বিরোধী দল তাকে গ্রহণ করেছে প্রধান নেতা হিসেবে, বিদেশী পত্র-পত্রিকায় সরকার বিরোধী চরিত্র হিসেবে তিনিই এসেছেন প্রধানরূপে।
২৮ নবেম্বরের পর বেগম খালেদা জিয়া গৃহে অন্তরীণ হন। আর এ সময় রাজনৈতিক মহলে নানা রকম গুজব ছড়ানো হয়। তার মধ্যে একটি হলো তিনি জখম হয়েছেন। আর রাজনৈতিক গুজব হলো তিনি নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্টে যোগ দিতে যাচ্ছেন। সরকার গঠনে বেগম জিয়া ও শেখ হাসিনার ভূমিকা থাকবে। এরই মধ্যে ২০ ডিসেম্বর প্রচারিত হয় হরতালের আহ্বান। পরে প্রত্যাহার করা হয় সে হরতাল। গুজবটা সত্য বলে জনমনে সন্দেহ দানা বাঁধে। সে হরতাল পিছিয়ে দেয়া হয় ৪ জানুয়ারীতে। ইতিমধ্যে নতুন গঠিত জনদল বিস্তৃত করানোর উদ্যোগ নেয়া হয়। সমাপ্ত হয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন। সারা দেশে তরুণের নতুন নেতৃত্বের অভ্যুদয় ঘটে।
৪ জানুয়ারী হরতাল ব্যাপকভাবে পালিত হলো না। কারণ গুজবে কিছু ফল ফলছে, জনমনে সন্দেহ ভিত্তি স্থাপন করতে শুরু করেছে। আর সরকার সংলাপের আহ্বান জানালে তাতে অনেক ধরনের রাজনীতিক ব্যক্তিরা আগ্রহী হয়ে উঠলেন। জনগণের মধ্যে অস্তিত্ব নেই এমন সব নেতারাও জনগণের হয়ে কথা কইলেন সরকারের সঙ্গে। বিভিন্ন পর্যায়ে সংলাপ শেষ হলো। দেখা গেল অধিকাংশ রাজনীতিক মূল রাজনৈতিক স্রোতের বিপরীতে মধ্যপন্থার সুপারিশ করেছেন। প্রেসিডেন্ট এবং সংসদ নির্বাচন একই দিনে হবে।
সরকার পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হলো ৭ দল ও ১৫ দল ইচ্ছে করলে সংলাপ করতে পারেন— দরজা খোলাই আছে। এরমধ্যে সরকার উপজেলা নির্বাচনের সময়সূচী ঘোষণা করে আবার পিছিয়ে দিল। পৌরসভা নির্বাচনে সরকার সমর্থক বলে পরিচিত নেতারা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। স্বতন্ত্র এবং বিরোধী দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। এর আগে জানুয়ারীতে উপজেলা নির্বাচন প্রতিহত করা এবং সবার আগে সংসদ নির্বাচনের দাবীতে ১ মার্চ হরতাল আহ্বান করে আবার আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হয়। খালেদা জিয়াকে কেন্দ্র করে প্রচারিত গুজব কেটে যেতে শুরু করে। ইতিমধ্যে ১৫ দলের অন্যতম শরিক জাসদের সভাপতি মেজর (অবঃ) এম, এ, জলিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে আসায় ক্ষোভ প্রকাশ করে সাক্ষাৎকার দেন বিচিত্রায়। আর ফেব্রুয়ারীতে জাসদ ভেঙে তিন টুকরো হয়ে যায়। জাসদের পদত্যাগ প্রার্থী সাধারণ সম্পাদক আ, স, ম, আবদুর রব ঘোষনা করেছেন যুগ্ম সম্পাদক ৫ দফা দাবীর প্রেক্ষিতে ১৫ দলের কাছে জাসদের আদর্শ বিকিয়ে দিয়েছেন। অবশ্য মাত্র ক’মাস আগে তিনিই ৫ দফা দাবীর প্রনেতা হিসেবে স্বাক্ষর করন। জাসদ ছাড়তে চেয়েছিলেন বলে ১ নবেম্বর হরতালের কর্মসূচীকে সমর্থন জানান তাঁর বাস্তুহারা সমিতির নামে। নিজে ফার্মগেটে দাঁড়িয়ে পিকেটিং করেন। সেই আ, স, ম, আবদুর রব আন্দোলনের নতুন কর্মসূচীতে বেঁকে বসলেন। এবং উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। উপজেলা নির্বাচনকে স্থায়ী বিষয় বলেই মনে করেন। এবং বললেন যারা উপজেলা নির্বাচন করবে না তাঁদের রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হবে।
আ, স, ম, আবদূর রবের একথা মেনে নিলে বলতে হয় ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঝুঁকি নিয়েছেন বেগম খালেদা জিয়া। জাসদ (চি) অবশ্য ১৫ দলের সঙ্গে থেকে দলগতভাবে উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার বাসনাও ব্যক্ত করে খোলা চিঠি দিয়েছেন। ১৫ দল তাঁর খোলা চিঠিকে প্রত্যাখ্যান করেছে।
সরকারের সমর্থক কিংবা সরকারী দল বলে পরিচিত জনদলের মধ্যে উপদলীয় কোন্দল নিয়ে প্রকাশ্যে মারামারি ততদিনে শুরু হয়ে গিয়েছে। চট্টগ্রামে প্রচন্ড মারামারির ফলে আশপাশের এলাকার জনজীবন পর্যন্ত বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো। জনদলের মারামারি এবং উপদলীয় চক্রান্তের ফলে কোণঠাসা হয়ে যাওয়া ১৮ দফার নেতারা গঠন করে বসলেন ‘ইউনাইটেড ন্যাশনালিস্ট পার্টি’। ১৮ দফার নেতারা পৃথক অস্তিত্বের দাবী ক’রে বসলেন। জনদলের মধ্যেও অসন্তোষ চরমে। কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে রাজনৈতিক কার্যক্রমের প্রশ্ন তুমুল হট্টগোল হয়। পরে সে বৈঠক আর হতে পারেনি।
দেশের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বেগম খালেদা জিয়া উপজেলা নির্বাচন প্রতিহত করার কর্মসূচী নিয়েছেন। ঘুরে বেড়াচ্ছেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল। এ পরিস্থিতিতে আবার কি আন্দোলনের নেত্রী হবেন তিনি? অথবা স্থানীয় বিএনপি নেতাদের দ্বারা প্রত্যাখ্যাত!
প্রকাশ্য রাজনীতিতে বেগম জিয়া আসেন বিএনপি’র ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে। প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর পর নির্বাচনে কে প্রার্থী হবেন এ নিয়ে বিএনপি দ্বন্দ্বে পড়ে। দুটো মত প্রাধান্যে আসে। একদল নেতা অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারকেই মনোনয়ন দেয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। অন্য আরেক দল বলতে থাকেন দলের নেতৃত্ব নির্ধারিত হোক গণতান্ত্রিকভাবে। তার পরেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থীপদে মনোনয়ন দেয়া হবে। সেই সময়ে বিচারপতি আবদুস সাত্তার ছাড়া বিএনপিতে এমন কেউ ছিলেন না যাকে বিতর্কের উর্ধ্বে রেখে সে নির্বাচনে মনোনয়ন দেয়া যেত। কিন্তু তবু মেজর জেনারেল (অবঃ) নূরুল ইসলাম এবং ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদের নেতৃত্বে বিএনপি’র বিরাট সংখ্যক সংসদ সদস্য দলে গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্যে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। এরা পরিচিত হন ‘বিদ্রোহী গ্রুপ’ হিসেবে। বাজেট অধিবেশন থেকে বিভিন্ন বিষয়ে সংসদে তাঁদের বিরূপ ভূমিকা সাত্তার সরকারের পতনের জন্যে যথেষ্ট ছিল।
বিচারপতি আবদুস সাত্তারকে মনোনয়ন দান এবং তাঁকেই দলের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করার জন্যে যারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিলেন তাদের মধ্যে শামসুল হুদা চৌধুরী এবং ডাঃ আবদুল মতিন চৌধুরী অন্যতম। দল ও সরকার পরিচালনায় তাঁরা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বিদ্রোহী গ্রুপের আক্রমণের তীব্রতা ছিল এদের ওপরেই বেশি। ডাঃ আবদুল মতিন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে যুবমন্ত্রীর বাড়িতে খুনের আসামী গ্রেফতার করা হয়। বিএনপি সরকারের পতনের এটিও একটি অন্যতম কারণ। বেগম খালেদা জিয়া দলের ভাইস চেয়ারম্যানের পদ গ্রহণ করেন। দলের পক্ষ থেকে বেগম জিয়াকে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও নির্বাচন করার অনুরোধ জানানো হয়। তখনকার ব্যক্তিগত কারণে তিনি তা গ্রহণ করেননি।
বিএনপির বিদ্রোহী গ্রুপ ক্ষমতাসীন অংশের তীব্র সমালোচনা এবং বিরোধিতায় লিপ্ত হলেও শেষ পর্যন্ত তারা পরিণত বিরোধীর ভূমিকা পালন করেন। বিএনপির রাজনীতিক এবং সাংগঠনিক ক্ষেত্রে এ দিকটি উল্লেখযোগ্য। কারণ বিদ্রোহী গ্রুপের নেতারা সাধারণতঃ ক্ষমতার বাটোয়ারায় সন্তুষ্ট থাকেন। কিন্তু এ গ্রুপের নেতারা তা করেননি। এমনকি পার্টিতে ভাঙ্গন এলে, তাঁরা বিএনপির পতন ঘটাতে পারতেন। তাও করেননি।
নতুন সরকার ক্ষমতার আসার পর রাজনৈতিক অঙ্গনে যে কথাটি সবচেয়ে বেশি চালু ছিল তা হলো বিএনপি কবে বিলুপ্ত হবে? এও বলা হতো এ সরকার আওয়ামী লীগের সমর্থনে ক্ষমতায় এসেছে। কারণ বিএনপিকে ক্ষমতা থেকে ভোটে পরাজিত করার জন্যে আওয়ামী লীগকে আরো অনেক বছর অপেক্ষা করতে হতো। এমন অবস্থায় যারা একসময় বিএনপির চালিকাশক্তি ছিলেন তারা অভিযোগ করতে শুরু করলেন বিচারপতি সাত্তারের অযোগ্যতা ও ব্যর্থতার। প্রাক্তন মন্ত্রী শামসুল হুদা চৌধুরী এবং ডাঃ মতিন তাদের আমলের সব দোষ বিচারপতি সাত্তারের উপর চাপিয়ে দিয়ে এবং সামরিক শাসন প্রতিহত করতে ব্যর্থতার অভিযোগ এনে পার্টির আদর্শ এবং জিয়ার অসমাপ্ত কাজ শেষ করবেন একথা বলে দল ভাঙলেন। বেশ কয়েকজন সংসদ সদস্য এবং প্রাক্তন মন্ত্রীর সমারোহে দল ভাঙ্গলেও জিয়ার জনপ্রিয়তা তারা নিজেদের খাতে নিতে পারলেন না। না পারার কারণ বেগম জিয়া এই দলটিকে সমর্থন দিলেন না। এদিকে ১৮ দফা চালু হয়ে গেছে। সরকারের সঙ্গে এই দলটির আঁতাত দ্রুত হলো না। যার ফলে এ দলেও ঘটলো দলছুট।
এদিকে মূল বিএনপিতে স্থগিত করে রাখা পুরনো ন্যাপের সমর্থকদের সংঘবদ্ধ করার একটি অতি ক্ষীণ ঢেউ উঠে বিলীন হয়ে যায়।
খালেদা জিয়া এলেন দল যখন চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার পথে। বিদ্রোহী গ্রুপের নেতাদের কেউ কেউ দেশের বাইরে। গুজব শোনা যাচ্ছে কেউ কেউ বর্তমান সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টার কাজ করছেন। দলের বসে থাকা নেতাদের সঙ্গে বেগম জিয়ার যোগাযোগ শুরু হলো। ঈদুল ফিতর এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা পাঠিয়ে তিনি প্রকাশ্যে এলেন। ১৫ দল তখন আন্দোলনের পায়তারা শুরু করেছে। এই জোটের সঙ্গে যোগাযোগ হলো বিএনপির। বিএনপি গঠন করলো নতুন জোট ৭ দল। এক পর্যায়ে অবশ্য খন্দকার মোশতাক আহমদের ১০ দলীয় ঐক্যজোটের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার কথাও শোনা গিয়েছিল। ৭ দলীয় জোট গঠিত হওয়ার পর ১৫ দলের সঙ্গে যুথবদ্ধ কর্মসূচী গ্রহণ শুরু হলো। এসব কর্মসূচী জনপ্রিয়তা অর্জন শুরু করে।
২৮ নবেম্বরের পর জনদলের ব্যাপক কার্যক্রম গ্রহণে মনে হতে থাকে যে বিরোধী দলের আন্দোলন শেষ পর্যন্ত মিইয়ে পড়লো। বিশেষ করে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন হয়ে যাওয়ার পর উপজেলা নির্বাচনের সময়সূচী ঘোষণা করায় এ ধারণা দৃঢ় হতে থাকে। অনেকে মনে করেন নির্বাচনের ঢেউয়ে আন্দোলন দাঁড়াতে পারবে না। কারণ নির্বাচনে স্থানীয় স্বার্থ কাজ করবে। তা সত্ত্বেও নতুন কর্মসূচী নেয়া হলো নির্বাচন প্রতিহত করার। পর্যবেক্ষকরা মনে করেন উপজেলা নির্বাচনে অংশগ্রহণেচ্ছু রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীরা এ সিদ্ধান্ত মানবে না। দলীয়ভাবে না হলেও স্বতন্ত্রভাবে তারা নির্বাচনে অংশ নেবেন। তাতে আসলে রাজনৈতিক কর্মীরা নির্বাচনে জড়িয়ে পড়বেন। আর দল ভাঙবে।
জানুয়ারীর শেষে আন্দোলনের কর্মসূচী ঘোষনা করেই ৭ দল ও ১৫ দলের নেতারা ছড়িয়ে পড়েন জেলা উপজেলায়। পৌরসভা নির্বাচনের ফলাফল ৪ জানুয়ারী হরতাল সফল হওয়া কিংবা না করার ক্ষতিকে পুষিয়ে দিয়েছে। খালেদা জিয়া এবং দুই জোটের অন্যান্য নেতারা অবস্থা সম্পর্কে ইতিবাচক বক্তব্য রাখছেন। ২০ ফেব্রুয়ারী ঢাকার মুগদাপাড়ায় এক সভায় বেগম জিয়া ঘোষণা করেছেন ধৈর্যধারণের দিন শেষ।
২৪ তারিখের খবরের কাগজে উপজেলা নির্বাচনের মনোনয়নপত্র দাখিল সম্পর্কে নানা ধরনের সংবাদ এসেছে। নির্বাচন বানাচল করতে পারলে বিরোধীদল আন্দোলনে এগিয়ে থাকবে বলে মনে করছে দলীয় নেতারা। এটাতে ব্যর্থ হলে তাদের সমগ্র মনোযোগ থাকবে ১ মার্চকে কেন্দ্র করে। এ আন্দোলনেও খালেদা জিয়া এগিয়ে আসবেন প্রধান নেতা হিসেবে।
খালেদা জিয়া মনে করেন, দলের সংগঠক ও কর্মীদের সোৎসাহ সমর্থনেই নির্বাচন প্রতিহত করার কর্মসূচী গৃহীত হয়েছে। একে তিনি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন বলে মনে করছেন। ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার পাকিস্তানে সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে বেনজীর ভুট্টোকে আন্দোলন করতে বলেছেন খালেদা জিয়াকে অনুসরণ করে। খালেদা জিয়ার আন্দোলন বা রাজনীতি আসলে কি? এ বিষয়ে বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ এখানে দেয়া হলো।
প্রশ্ন: সংলাপ একটি গণতন্ত্রসম্মত পথ। আপনারা এ পথ বর্জন করবেন কেন?
উত্তর: জাতীয় দাবী ৫ দফার ভিত্তিতে জনতার আন্দোলনের মুখে বাধ্য হয়ে সরকার সংলাপের প্রস্তাব করেছিলেন। এ আন্দোলনে অনেক অমূল্য জীবন নষ্ট হয়েছে, অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীর উপর নির্যাতন করা হয়েছে, হুলিয়া গ্রেফতারী
পরোয়ানা মাথায় নিয়েও যখন রাজনৈতিক নেতা, কর্মীরা এবং জনতা আন্দোলন থেকে পিছপা হননি এবং আন্দোলন বানচাল করা যায়নি তখন বাধ্য হয়ে সরকার সংলাপের ঘোষণা দিয়েছিলেন, তাদের একটা কৌশল হিসেবে। সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণে, রাজনৈতিক কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা কারে, সংবাদপত্রের উপর কড়া সেন্সরশীপ জারী রেখে এ সংলাপের আহ্বান ছিল মূলতঃ কালক্ষেপণ করার জন্য। জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য। সংলাপের উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই আমরা পূর্বশর্ত দিয়েছিলাম। সরকার তা মেনে নেননি। এজন্যই আমরা সংলাপে অংশ গ্রহণ করিনি।
প্রশ্ন: গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত থাকার পরও গণতান্ত্রিক সরকারের পতন ঘটে। বিএনপি এমনি পতনের পর এসেছিল। এমন অবস্থায় গণতন্ত্র স্থায়ী করার পথ কি?
উত্তর: হ্যাঁ, অতীতে এ ঘটনা ঘটেছে, তবে কোন গণতান্ত্রিক শক্তির দ্বারা নয়। পুরোপুরি অগণতান্ত্রিকভাবে— বন্দুকের নলের মুখে।
কোন গণতান্ত্রিক সরকারকে সরিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় আসেনি। গণতন্ত্রকে স্থায়ী করার একমাত্র পথ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্নে চলতে দেয়া।
প্রশ্ন: বিএনপি ক্ষমতায় থেকেও গণতন্ত্র স্থায়ী করতে পারেনি। এ বিষয়ে আপনার বক্তব্য কি?
উত্তর: বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন অবস্থায় একদলীয় শাসন ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছিল, ব্যক্তি ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছিল, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিল, সর্বস্তরে গণতন্ত্রকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য কার্যকর ভূমিকা পালন করেছিল। কিন্তু সে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নির্বিঘ্নে চলতে দেয়া হয়নি।
প্রশ্ন: গণতন্ত্রের জন্যে আন্দোলনের ফলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সম্ভাবনা পিছিয়ে যাচ্ছে। এটা কি গণতন্ত্রের জন্যে ক্ষতিকর হচ্ছে না?
উত্তর: গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই সর্বাগ্রে সংসদ নির্বাচনের দাবি করা হয়েছে এবং জনতার আন্দোলনও সেই নির্বাচনের জন্যই। সরকার সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী নয় বলেই সংসদ নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেছেন সকলের শেষে। অর্থাৎ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা পিছিয়ে দিয়েছেন। সরকারের এই সিদ্ধান্তই গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে সংসদ নির্বাচনের দাবীতে জনতার আন্দোলন (গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর) নয়।
প্রশ্ন: আন্দোলনের কর্মসূচীতে আপনারা উপজেলা নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। এতে কি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে গ্রামাঞ্চলের সংগঠকদের বিরোধ সৃষ্টি হবে না?
উত্তর: দলের সর্বস্তরের সংগঠক ও কর্মীদের সোৎসাহ সমর্থনেই উপজেলা নির্বাচন প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। কাজেই দলীয় আদর্শ ও সিদ্ধান্তের প্রতি আস্থাবান কোন সংগঠকই দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে যেতে পারে না।
প্রশ্ন: উপজেলা নির্বাচন একটি স্থানীয় সরকার নির্বাচন। এর সঙ্গে সংসদ নির্বাচন কিংবা সংবিধানকে জড়িত করছেন কেন?
উত্তর: উপজেলা একটি নতুন ব্যবস্থা ও প্রশাসনের ক্ষেত্রে একটি মৌলিক পরিবর্তন। জাতীয় সংবিধানে এমন স্থানীয় সরকারের কোন বিধান নেই। আমরা মনে করি যে, এমন মৌলিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের এবং নতুন কোন স্থানীয় সরকারের কাঠামো ও তার ক্ষমতা নির্ধারণের অধিকার রয়েছে শুধুমাত্র সার্বভৌম সংসদের, কোন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নয়।
প্রশ্ন: আপনাদের সিদ্ধান্ত: নির্বাচন বর্জন। তাহলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন বর্জন করতে বলেননি কেন? ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলে আন্দোলনের গতিবেগ কি কমে যায়নি?
উত্তর: নির্বাচন বর্জনের জন্যে আমাদের আন্দোলন নয়। জাতীয় দাবী ও দফার ভিত্তিতে আমরা বরঞ্চ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আশু নির্বাচন দাবী করেছি। আমরা মনে করি, গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য সর্বাগ্রে জাতীয় সংসদ-এর নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রয়োজন। সরকার ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার লক্ষে সেই জাতীয় দাবীকে অগ্রাহ্য করে চলেছেন।
ইউনিয়ন পরিষদ ও পৌরসভার মত স্থানীয় সংস্থা আগে থেকেই ছিল। এবং এই সংস্থাসমূহের নির্বাচন কখনই দলীয় রাজনীতির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়নি। এই নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ স্থানীয় সংস্থায় তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। নির্বাচনের মাধ্যমে রাষ্ট্র পরিচালনায়, সর্বোচ্চ পর্যায়েও জনগণ তাদের সেই অধিকার প্রয়োগ করে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। ৫ দফা দাবীভিত্তিক আমাদের আন্দোলন তাদের সেই আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলেই স্থানীয় সংস্থার নির্বাচন আন্দোলনের গতিবেগ কমিয়ে দেয়নি বরং বাড়িয়েছে।
প্রশ্ন: ২৮ নবেম্বরের কর্মসূচীর পর ২০ ডিসেম্বর হরতাল স্থগিত রাখা বা ৪ জানুয়ারী হরতালের ব্যর্থতাকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করেছেন?
উত্তর: সামরিক শাসনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও প্রকাশ্য রাজনীতির গণতান্ত্রিক অধিকার অর্জনের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন এবং জাতীয় দাবী ৫ দফার পক্ষে জনতার বিপুল সমর্থনের পর সরকার রাজনৈতিক অধিকার পুনরায় কেড়ে নেয়ার জন্য ২৮ নবেম্বর নিয়মতান্ত্রিক অবস্থান ধর্মঘটকে অন্য খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা করেছিল। সুপরিকল্পিতভাবে কিছু ঘটনা ঘটিয়ে আন্দোলনকারী কর্মীদের বুকের রক্ত ঝরিয়েছে। অসংখ্য নেতা কর্মীকে গ্রেফতার করেছে। সংবাদপত্রের উপর কঠোর বিধি-নিষেধ জারী করে দেশ-বিদেশের জনগণকে একতরফা বক্তব্য শুনতে বাধ্য করেছে।
২০ ডিসেম্বরের হরতাল স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছিল কৌশলগত কারণে। সরকারকে সংলাপের পূর্বশর্তগুলো মেনে নেয়ার জন্য কিছু সময় দেয়াও ছিল তার অন্যতম কারণ। কিন্তু সরকার বিরোধী দলসমূহের এই উদারতার মূল্যায়নে ব্যর্থ হওয়ায় ৪ জানুয়ারী দেশব্যাপী হরতালের কর্মসূচী গৃহীত হয়। ৪ঠা জানুয়ারীর হরতাল ব্যর্থ করার জন্য পরিচালিত সরকারী কর্মকাণ্ডের অন্যতম ছিল সংবাদপত্রের উপর কঠোর বিধি-নিষেধ, সকল সরকারী প্রতিষ্ঠানের সমুদয় ক্ষমতার প্রয়োগ, পেটোয়াবাহিনীগুলো দিয়ে ভীতি ও সন্ত্রাসের সৃষ্টি এবং হরতালের আহ্বান সম্পর্কে সরকারী প্রচার মাধ্যমসমূহে ভিত্তিহীন মিথ্যা প্রচার। এত কিছুর পরেও দেশের যেসব এলাকায় হরতালের কর্মসূচী পৌঁছেছে সে-সব এলাকায় সফল এবং বাকি এলাকাসমূহে আংশিক হরতাল পালিত হয়েছে।
প্রশ্ন: প্রশ্ন আপনি বিভিন্ন উপজেলায় সফর করছেন দলের লোকদের আন্দোলনের অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করার জন্য। সবাইকে কি সঙ্গে পাবেন?
উত্তর: যাঁরা আমাদের দলের লোক— তাঁদের নিশ্চয়ই দলীয় সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে পাশে পাবো। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল সফরকালে জনগণকেও জাতীয় দাবী ৫ দফার পক্ষে সোচ্চার দেখেছি। আন্দোলনে তাঁরাও সাথে থাকবেন বলে মনে করি।
প্রশ্ন: আপনি উপজেলা নির্বাচন স্থগিত রাখার পক্ষে না তা প্রতিহত করার পক্ষে?
উত্তর: আমি আগেই বলেছি যে, উপজেলা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেবে জনগণের নির্বাচিত সার্বভৌম সংসদ। সংসদ কর্তৃক এ ব্যাপারে কোন সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার আগে উপজেলা নির্বাচন হবে জাতীয় সংবিধান বহির্ভূত একটি কার্যক্রম।
প্রশ্ন: সব দাবী বা পূর্বশর্ত মেনে নিলে সংলাপে অংশ নেবেন বলে ঘোষণা করেছিলেন। এগুলো মেনে নেয়ার পর তার কি কোন প্রয়োজন থাকতো?
উত্তর: জাতীয় দাবী ৫ দফার ভিত্তিতে সংলাপের সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টির জন্যই আমরা পূর্বশর্ত দিয়েছিলাম। পূর্বশর্তগুলো মেনে নেয়া হলে ৫ দফার ভিত্তিতে আলোচনা হতে পারতো।
প্রশ্ন: মেজর জলিল বলেছেন, প্রেসিডেন্ট জিয়া শহীদ না হলে আপনি রাজনীতিতে আসতেন না। আপনার মন্তব্য কি?
উত্তর: মহান রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান শহীদ না হলেও তাঁর স্বপ্ন সুখী ও স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার সংগ্রামে আমি কখন কিভাবে অংশগ্রহণ করতাম এটা মেজর জলিল সাহেবের জানার কথা নয়। তবে কিছু পথভ্রষ্ট ব্যক্তির ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রে কোটি কোটি দুঃখী মানুষের প্রিয়নেতা এবং মুসলিম ও তৃতীয় বিশ্বের অন্যতম মুখপাত্র শহীদ জিয়ার নির্মম হত্যাকান্ডের পর তাঁর স্বপ্ন ও কর্মসূচী বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের ও দেশবাসীর কল্যাণের জন্যই একজন সচেতন দেশকর্মী হিসেবে আমি রাজনীতিতে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত হয়েছি।
প্রশ্ন: আপনি কাকে বা কোন দলকে আপনার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করেন?
উত্তর: কোন ব্যক্তি বা দল আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী নয়। আমি যে রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাস করি তার আশু ও সফল বাস্তবায়নই আমার লক্ষ্য। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নে যে ব্যক্তি বা যে দল বাধার সৃষ্টি করবে সে ব্যক্তি বা সেই দল আমাদের রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী এবং আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে রাজনৈতিক।
প্রশ্ন: জেনারেল এরশাদের সঙ্গে কি ১ নবেম্বরের পর আপনার কোন সাক্ষাৎ বা আলোচনা হয়েছে? ২৮ নবেম্বরের পর আপনি কিংবা জেনারেল এরশাদ কখনও একে অন্যের সঙ্গে দেখা করেছেন? করলে আপনারা কি কি বিষয়ে আলোচনা করেছেন?
উত্তর: ১ নবেম্বর ও ২৮ নবেম্বরের পর জেনারেল এরশাদ আমার বাসায় আসেন। ৭ দলের পক্ষ থেকে আমি তাকে সংলাপের পূর্বশর্তের কথা বলেছি।
প্রশ্ন: জেনারেল এরশাদ কোন রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠন করলে আপনার দলের তাতে যোগদানের সম্ভাবনা কতখানি?
উত্তর: বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল এবং ৫ দফার ভিত্তিতে ৭ দলীয় ঐক্যজোটের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনসহ বৃহত্তম জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসী। এই প্রেক্ষিতে অন্য কোন রাজনৈতিক ফ্রন্টে যোগদানের প্রশ্ন অবান্তর।
প্রশ্ন: নতুন কোন রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠিত হলে ৭ দলের ঐক্য কি অটুট থাকবে বলে আপনি বিশ্বাস করেন?
উত্তর: ৫-দফা দাবী বর্তমানে জাতীয় দাবীতে পরিণত হয়েছে এবং ৭ দলের শরিক দলগুলো জাতির নিকট অঙ্গীকারবদ্ধ। সেজন্য ঐক্য অটুট না থাকার যুক্তিসঙ্গত কোন কারণ দেখি না।
প্রশ্ন: অনেকে মনে করেন এখন দেশে কোন আন্দোলন দেশের স্থিতিশীলতা ব্যাহত করবে। আপনার মন্তব্য কি?
উত্তর: একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা এবং তার অব্যাহত অনুশীলনের মাধ্যমেই দেশের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা যায়। দেশে আজ গণতন্ত্র নেই এবং আমরা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্যই নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করছি। দেশে দীর্ঘদিন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনুপস্থিতিতেই স্থিতিশীলতা ব্যাহত হতে পারে। কাজেই আমাদের আন্দোলন দেশের স্থিতিশীলতা ব্যাহত করবে না বরং তা নিশ্চিত করবে।
প্রশ্ন: ৭ দল ১৫ দলের আন্দোলন সরকারের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে পরিসমাপ্ত হতে বাধ্য। আপনার মন্তব্য কি?
উত্তর: ৭ দল ও ১৫ দলের ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন চলেছে জাতীয় দাবী ৫-দফা আদায়ের জন্য। দাবীগুলোর ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য প্রমাণিত হয়েছে। জনসমর্থনধন্য ৫-দফা দাবী সরকার মেনে নিলে কোন আলোচনারই দরকার হয় না।
প্রশ্ন: রাজনীতি উন্মুক্ত হলে বিএনপি কি অখণ্ড থাকবে?
উত্তর: শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে গড়া বিএনপিকে খণ্ডিত বলে চিহ্নিত করার চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু তা মোটেও সফল হয়নি। উন্মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশে জন্ম লাভকারী বিএনপি উন্মুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশে অধিকতর শক্তিশালী হবে।
প্রশ্ন: আপনারা দাবী করছেন সরকার সংলাপের নামে কালক্ষেপণ করেছে। আপনারাও কি একইভাবে আন্দোলনে নামছি নামবো করে কালক্ষেপণ করছেন না?
উত্তর: ৫ দফার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যমত প্রতিষ্ঠিত এবং তাঁর পক্ষে গণরায় ঘোষিত হওয়ার পরেও তা না মেনে সরকার সংলাপের মাধ্যমে কালক্ষেপ করছেন। বিরোধী দলগুলি সামরিক আইনের কঠোর বিধি-নিষেধ অমান্য করে আন্দোলনের সূত্রপাত ও সীমাহীন জুলুম নিপীড়নের মধ্যেও ধাপে ধাপে তা একটি সুষ্ঠু পরিসমাপ্তির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ক্ষমতাসীন সরকারের ষড়যন্ত্রমূলক কৌশল ও উস্কানির মুখে যত দ্রুত গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন জাতীয় রূপ নিয়েছে অতীতে কোন সামরিক সরকারের বিরুদ্ধেই এত অল্প সময়ে তা সম্ভব হয়নি। কাজেই আমরা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে কালক্ষেপ করছি এটা সত্য নয়।
প্রশ্ন: ৫ দফায় কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের দাবী নেই। তারা কি আপনাদের আন্দোলনে শরিক হবে বলে মনে করেন?
উত্তর: জাতীয় দাবী ৫ দফা এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-জনতার মৌলিক অধিকারসমূহ পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবী। তাঁদের সকলের অন্য যে কোন দাবী আদায়ের জন্যই প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পরিবেশ ও নির্বাচিত সরকার। আর সেই দাবী আদায়ের জন্য পরিচালিত ৫ দফার সংগ্রামে তাঁরা প্রত্যক্ষভাবে শুধু অংশগ্রহণই করেননি— জীবনও দিয়েছেন অকাতরে এবং নির্যাতন সহ্য করছেন প্রতিনিয়ত।
প্রশ্ন: রাজনীতির দুই প্রধান মেরু ৭ দল ও ১৫ দল মৌলিকভাবে পরস্পর বিরোধী। যুগপৎ আন্দোলনের কর্মসূচীর পর এ দুই জোটের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কি হবে?
উত্তর: মূলতঃ গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার জনই ৭ দল ও ১৫ দলের এই ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম। দলগত আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের সকলেরই নিজস্ব কর্মসূচী রয়েছে।
প্রশ্ন: প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেছিলেন, ‘আই শ্যাল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট।’ আপনার জন্যে তা কতখানি প্রযোজ্য?
উত্তর: শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কৃষকের জীর্ণ কুটির থেকে শ্রমিকের বস্তিতে ঘুরে ঘুরে জনগণের সুখ দুঃখের সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত করে ঐসব বিলাসী রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলের জন্য রাজনীতি সত্যিই ‘ডিফিকাল্ট’ করেছেন— যারা শুধুমাত্র পত্র-পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে রাজনীতি করেন; জনগণের সাথে যাদের কোন প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই; যাদের রাজনীতি এদেশের জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এবং যারা রাজনীতিকে শুধু ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থে ব্যবহার করেছেন।
আমার বা বিএনপি’র জন্য রাজনীতি মোটেও ‘ডিফিকাল্ট’ হয়নি। কারণ আমরা জনগণের জন্য এবং জনগনের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রেখে তাদেরই আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য রাজনীতি করি।
সূত্র: সাপ্তাহিক বিচিত্রা, ১২ বর্ষ, ৪০ সংখ্যা, ২ মার্চ ১৯৮৪, ১৮ ফাল্গুন ১৩৯০