
পালটা ২০ শতাংশ শুল্কের বিনিময়ে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নন ডিসক্লোজার বা অপ্রকাশিত যে চুক্তিটি হতে যাচ্ছে তা বাতিলের ক্ষমতা থাকবে পরবর্তী রাজনৈতিক সরকারের। দেশের স্বার্থবিরোধী মনে হলে চুক্তিটি পরিবর্তন, পরিমার্জন ও বাতিলের সুযোগ থাকছে।
স্থানীয় সময় শুক্রবার যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস মিনিস্টারকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান। এর আগের দিন অর্থাৎ বৃহস্পতিবার বাংলাদেশের ওপর পালটা শুল্ক ৩৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ আরোপ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। সাক্ষাৎকারটি প্রেস মিনিস্টার গোলাম মোর্তোজা তার নিজস্ব ফেসবুক পেজে তুলে ধরেছেন। পালটা শুল্ক নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য প্রতিনিধির দফতরের (ইউএসটিআর) সঙ্গে তিন দফা আলোচনায় বাংলাদেশের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন। সঙ্গে ছিলেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমান নিজেও।
পালটা শুল্ক কমাতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে একটি বাণিজ্য চুক্তি করতে হচ্ছে। যা নন ডিসক্লোজার বা অপ্রকাশিত হিসেবে পরিচিত। ফলে গোপনীতা থাকায় চুক্তিতে দেশের স্বার্থবিরোধী বা ভৌগোলিক সীমার নিরাপত্তার ইস্যু থাকতে পারে-এমন শঙ্কা তৈরি হয়েছে অনেকের মধ্যে। এর জবাবে ড. খলিলুর রহমান বলেন, মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি দফতর (ইউএসটিআর) সঙ্গে আলোচনার শুরুতে তিনটি বিষয় বলেছি। প্রথমত বর্তমান সরকার একটি অন্তর্বর্তী সরকার। এ সরকারের কোনো সংসদ নেই। জনগণের ভোটে সরকার নির্বাচিত নয়। ফলে আগামীতে নির্বাচিত সরকারকে বাইরে রাখতে চাই না। যে কারণে এ চুক্তি পরিমার্জন, পরিবর্তন, এমনকি চুক্তি বাতিল করতে পারে-এমন পথ রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রস্তাব দিয়েছি। দ্বিতীয়ত হচ্ছে আমাদের বহন করার শক্তির বাইরে অধিক কোনো দায় নেব না। শুধু চুক্তি করার জন্য দায় নেব, কিন্তু পরে পালন করতে পারব না। আর সেটি হলে চুক্তি বাতিল করতে হবে। সে কাজে আমরা যাব না। তৃতীয়ত হচ্ছে এই চুক্তিতে তৃতীয় কোনো দেশের নাম উল্লেখ থাকবে না।
তিনি আরও বলেন, দেশের স্বার্থ রক্ষা করে আমরা পুরো আলোচনা করেছি। আগামীতে নির্বাচিত সরকার কয়েক মাসের মধ্যে আসবে। তারা যদি মনে করে আমাদের স্বার্থে এ চুক্তি হয়নি, সেটি বাতিল করে দিতে পারবে। কারণ চুক্তির কার্যকারিতা চালু হতে কিছু সময় লাগবে।
গোপনীয়তা করে মানুষকে অন্ধকারে রেখে ২০ শতাংশ শুল্ক অর্জন করেছেন-এমন প্রশ্নের জবাবে খলিলুর রহমান বলেন, বিগত ১৫ বছরে যে ধরনের চুক্তি করেছে, সেখানে ৫ টাকার জিনিস ৫০ টাকায় কিনেছে। কীভাবে সেখানে জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়েছে? শুধু আজকে নয় সব সরকারের কাছে মানুষের স্বচ্ছতার দাবিটা সামনে থাকা দরকার।
তিনি বলেন, শুল্ক আলোচনায় সব দেশকে নন ডিসক্লোজার এগ্রিমেন্ট করতে হয়েছে। ফলে আলোচনার বিষয়গুলো চুক্তি সই করার আগ পর্যন্ত গোপনীয় রাখা হচ্ছে ট্রেডিশনাল প্র্যাকটিস। ধরুন আগামীতে গঙ্গা নদীর চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু করি তখন কিন্তু খসড়া চুক্তি জনগণের সামনে প্রকাশ করা হবে না। এ ধরনের নীতি নেই, এটি একটি কূটনৈতিক প্র্যাকটিস। তবে চুক্তির সব ভাষা পরিষ্কার করা হবে, স্বাক্ষরের জন্য প্রস্তুত করা হবে। তখন স্বচ্ছতার কারণে যুক্তরাষ্ট্র সরকারকে চুক্তিটি জনসম্মুখে প্রকাশের অনুরোধ করব।
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা আরও বলেন, পালটা শুল্ক কমার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে মধ্যপ্রাচ্যের একটি বন্ধুপ্রতীম দেশ। ইউএসটিআরের সঙ্গে তৃতীয় আলোচনায় অংশ নেওয়ার আগে আমি সে দেশে ১২ ঘণ্টা কাটিয়েছি। দেশটি যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চপর্যায়ে আমাদের জন্য বলেছে। যে কারণে ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনা শেষ হওয়ার আগেই আমরা একটি শুল্কহার পেয়ে গেলাম। এতে আমরা ধরে নিয়েছি ওই বন্ধুপ্রতীম দেশের সহযোগিতা কাজে লেগেছে।
তিনি এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, শুল্ক কমানোর পেছনে আমরা কৃতিত্ব নিতে আসিনি। বর্তমান সরকার আর ৬ থেকে ৭ মাস আছে। আমরা চলে যাব। এখানে ক্রেডিট নেওয়ার লক্ষ্য নেই। আমাদের প্রতিযোগী দেশগুলো ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়াসহ সবাই শুল্ক কমাতে নেগোশিয়েট করছে। সেটি না করলে বাংলাদেশ ৩৫ শতাংশ শুল্কেই আটকে থাকত। তিনি আরও বলেন, শুল্ক হার এখন পর্যন্ত ভারত পায়নি। কানাডা নেগোশিয়েট করতে পারেনি বলে শুল্কে বড় ধাক্কা খেয়েছে। আমরা অন্তত পক্ষে কাজটি এমন চূড়ান্তপর্যায়ে আনতে পেরেছি যে কারণে ২০ শতাংশ শুল্ক দিয়েছে। যা প্রতিযোগী দেশগুলো সীমানার মধ্যে রয়েছে।
শুল্ক ইস্যুতে আলোচনায় যোগ্য ব্যক্তিরা ছিলেন না-এমন প্রশ্নের জবাবে ড. খলিলুর রহমান বলেন, সংস্কৃতিতে একটি কথা আছে। ফলেই পরিচয়, আপনি ফল দেখলে বুঝবেন কাজটা ঠিক হয়েছে কি না। আমরা ফলটি এনেছি। সেটি আবার প্রতিযোগীদের সীমানার মধ্য থেকে। যে চুক্তি হয়েছে সেটি যে শুধু শুল্ক চুক্তি নয়, এর সম্পর্কে সম্ভবত সম্মুখ ধারণা ছিল না অনেকের। আমেরিকান পণ্যের ক্ষেত্রে শুধু ডিউটিগুলো সমন্বয় করে নিচ্ছি-এমন যদি হতো তাহলে কাজটি দেড় বা দুবেলাতেই করে ফেলতে পারতাম। এখানে চারটি বিষয় প্রতিটি দেশকে করতে হয়েছে। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়। প্রথমত যুক্তরাষ্ট্রের পণ্যের শুল্কের হার সমন্বয়, দ্বিতীয় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমানো, তৃতীয়ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে কিছু তাৎক্ষণিকভাবে কেনাকাটা করা, যাতে বাণিজ্য ঘাটতি কমে যায়। আর শেষটি হচ্ছে-যে আইনে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প শুল্ক আরোপ করেছেন, সেটি হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক ইর্মাজেন্সি পাওয়ারস অ্যাক্ট। সেখানে বলা আছে, যদি রাষ্ট্রপতি মনে করেন, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক বা জাতীয় নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব কারণে বিদেশি পণ্য আমেরিকার বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সেটি তিনি পারবেন। ওই আইনে কিন্তু জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি উল্লেখ আছে। তবে আমরা চেয়েছি যেন কোনো ভূ-রাজনৈতিক ফাঁদে পড়ে না যাই। সে কারণে সচেতন থেকেছি। ফলে শুল্ক আলোচনার পাশাপাশি জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছি। শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নয়, প্রতিটি দেশের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলর এখানে আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। আমি এখানে এসে কোরিয়ান নিরাপত্তা কাউন্সিলরকে বসে থাকতে দেখেছি।
আলোচনায় লবিষ্ট নিয়োগ না করার পেছনে ড. খলিলুর রহমান বলেন, ইইউ, জাপান কোরিয়ান ও মেক্সিকো এদের সঙ্গে আমেরিকার বহু বছরের সম্পর্ক শুধু অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক নয়, সামরিক এর জন্যও। তারা খুব সহজে এই চুক্তি করতে পারেনি। কানাডা ও ভারত চুক্তি করতে পারেনি। তাদের লবিষ্ট কম ছিল না। এখানে আলোচনা লবিষ্ট দিয়ে হয় না।
শুল্ক ইস্যু নিয়ে ইউএসটিআরের সঙ্গে আলোচনা হওয়ার পর সেগুলো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কাছে যায়। তিনি সম্মত হলে নির্ধারিত ট্যারিফ হারগুলো অন্যান্য দেশগুলো পায়। এ জন্য হোয়াইট হাউজে এক্সেস থাকতে হবে। শেষ মুহূর্তে এসে লবিষ্ট ফার্ম নিয়োগ করলে সে এক্সেস পাবে না। আমাদের লবিষ্টের কোনো প্রয়োজন ছিল না। কারণ আমরা আগামীতে আমেরিকান পণ্য কিনতে চাচ্ছি। সেগুলো হচ্ছে-সেদেশের কৃষিপণ্য বিশেষ করে গম, তুলা ও সয়াবিন। এখানে কৃষি খাতের যে লবিং তা অত্যন্ত শক্তিশালী। তারা আমাদের জন্য অনেক জায়গায় বলেছেন, এর চেয়ে শক্তিশালী লবিং আর কী হতে পারে। আমরাই একমাত্র দেশ প্রথমে এসেই যুক্তরাষ্ট্রকে বলেছি-আমরা বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে ফেলব। এতে তারা সন্তুষ্ট হয়েছে।