ইসরায়েল গত বছর হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করেছে। ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসিন ফখরিজাদেহকে অভিনব কায়দায় খুন করেছে। এ বছর ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তাকে এক রাতে হত্যা করেছে। এসব ঘটনায় একটি নাম বারবার সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সেটি হচ্ছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কুখ্যাতি পাওয়া গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ। তবে নিজ দেশে তারা হামাসের হামলা আটকাতে পারেনি। বিতর্কিত এই গোয়েন্দা সংস্থাটিকে নিয়ে আজকের আয়োজন।
আর্জেন্টিনার একজন ধনী ব্যবসায়ী হঠাৎ সিরিয়ায় ব্যবসা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। নিজেকে তিনি সিরীয় বংশোদ্ভূত একজন লেবানিজ ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেন। বলেন, ফিরতে চান নিজের দেশে, শিকড়ের কাছে।
নাম তাঁর কামেল আমিন সাবেত। তিনি আর্জেন্টিনার রাজধানী বুয়েনস এইরেসে বাস করা ধনী সিরীয়দের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন, ১৯৬২ সালে তাঁদের হাত ধরেই ব্যবসা করতে চলে যান সিরিয়ায়।
নেটফ্লিক্সে ২০১৯ সালে মুক্তি পাওয়া ‘দ্য স্পাই’ সিরিজের গল্প এই কামেল আমিন চরিত্রকে ঘিরে। কামেল কাল্পনিক কোনো চরিত্র নয়, বরং চরম ধূর্ততা দেখিয়ে প্রতিপক্ষের অন্দরমহলে পৌঁছে যাওয়া মোসাদের এক ছদ্মবেশী এজেন্ট। তাঁর প্রকৃত নাম এলি কোহেন, মোসাদের এজেন্ট হিসেবে সারা বিশ্ব যাঁকে চেনে।
কামেল আমিন ছদ্ম নামে এলি কোহেন সিরিয়া সরকার এবং দেশটির সেনাবাহিনীর শীর্ষপর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন।

সিরিয়ার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সঙ্গে নানা পার্টিতে কথিত কামেল আমিনকে নিয়মিত দেখা যেত, কর্মকর্তাদের মদ খাইয়ে অর্ধ-অচেতন করে তাঁদের কাছ থেকে রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য সংগ্রহ করতেন তিনি। তারপর রেডিও সংকেতের মাধ্যমে তা পাঠিয়ে দিতেন ইসরায়েলে।
এতটা ধূর্ততার সঙ্গে এলি কোহেন এসব কাজ করতেন, কেউ তাঁকে বিন্দুমাত্র সন্দেহ করেনি। উল্টো তিনি তরতর করে সিরিয়ার ক্ষমতার কেন্দ্রে উঠে যেতে থাকেন। এমনকি তিনি সিরিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রীর উপদেষ্টা নিযুক্ত হয়েছিলেন। সিরিয়ার সেনাবাহিনীকে নানা পরামর্শ দিতেন। সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে ছিল দহরম-মহরম, তবে শেষ রক্ষা হয়নি।
প্রায় তিন বছর তথ্য পাচার করার পর ১৯৬৫ সালে এলি কোহেন সিরিয়া কর্তৃপক্ষের হাতে ধরা পড়েন। সে দেশে বিচারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। ওই বছরের ১৮ মে দামেস্কের মারজাহ স্কয়ারে জনসমক্ষে এলি কোহেনকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তাঁর মরদেহ ছয় ঘণ্টা ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিল।
এলি কোহেনের ফাঁসি হলেও তাঁর পাঠানো তথ্যের জোরেই ১৯৬৭ সালে মাত্র ছয় দিনের যুদ্ধে সিরিয়াকে পরাজিত করেছিল ইসরায়েল। বিশেষ করে গোলান মালভূমিতে সিরিয়ার সেনাবাহিনীর অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার তথ্য দিয়েছিলেন কোহেন। কারণ, সেখানে তাঁর পরামর্শে সিরীয় সেনারা গাছ লাগিয়ে ওই গাছের ছায়ায় তাদের সেনাচৌকিগুলো বসিয়েছিল।
এতে ইসরায়েলের পক্ষে সিরীয় সেনাদের লক্ষ্য করে নির্দিষ্ট নিশানায় হামলা চালানো সহজ হয়ে গিয়েছিল। সিরিয়ার সঙ্গে ওই যুদ্ধ জিতে প্রথমবারের মতো বিশ্বকে নিজেদের সামরিক শক্তি দেখিয়েছিল ইসরায়েল।
ছয় বছর আগে মোসাদের এক এজেন্টকে ঘিরে তৈরি সিরিজের প্রসঙ্গ টেনে নতুন করে কথা কেন বলছি, বলার কারণ আছে।
কয়েক বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিপক্ষ দেশগুলোতে একের পর এক হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল। হত্যা করছে প্রতিপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ও শীর্ষস্থানীয় নেতাদের।
আমার শতাধিক পাসপোর্ট ছিল।
ইসরায়েল যেভাবে গত বছর হামাসের রাজনৈতিক শাখার প্রধান ইসমাইল হানিয়াকে হত্যা করেছে, ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসিন ফখরিজাদেহকে যে অভিনব কায়দায় হত্যা করা হয় কিংবা এ বছর ইসরায়েল যেভাবে ইরানের অভ্যন্তরে হামলা চালিয়ে দেশটির সেনাবাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ কর্মকর্তাকে এক রাতে হত্যা করে, তাতে একটি নাম বারবার সংবাদমাধ্যমে এসেছে। সেটি হলো, মোসাদ। বিশ্বে এই গোয়েন্দা সংস্থার কুখ্যাতিও নিছক কম নয়।
ইসরায়েলের তিনটি প্রধান গোয়েন্দা বাহিনীর একটি মোসাদ। ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রায় দেড় বছর পর ১৯৪৯ সালের ডিসেম্বরে আনুষ্ঠানিকভাবে মোসাদের যাত্রা শুরু হয়। মোসাদের কাজ বিদেশের হুমকি থেকে ইসরায়েলকে রক্ষা করা এবং ইসরায়েলের অস্তিত্ব নিরাপদ রাখা।
কিন্তু সূচনালগ্ন থেকেই মোসাদ যেভাবে কাজ করছে, তাতে বিশ্বের জন্য তারা এক রহস্যঘেরা বাহিনী। আর মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে ইসরায়েলি এই বাহিনী এক আতঙ্কের নামে পরিণত হয়েছে।
শত্রুর ওপর নজরদারি, তথ্য চুরি, বিশেষ করে বিদেশের মাটিতে ‘টার্গেট কিলিংয়ে’ইসরায়েলের সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র সম্ভবত মোসাদ।

মোসাদ কী, কোথা থেকে এল এবং কীভাবে কাজ করে
ইসরায়েলের প্রধান তিন গোয়েন্দা বাহিনী হলো মোসাদ, শিন বেত ও আমান। এর মধ্যে শিন বেত অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করে, গঠিত হয় ১৯৪৯ সালে। আমান হলো ইসরায়েলের সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা, যা প্রতিরক্ষা বাহিনীর অধীনে কাজ করে। এই সংস্থার মূল কাজ হলো তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে সামরিক কমান্ডকে গোয়েন্দা তথ্য সরবরাহ করা।
আর মোসাদের কাজ ইসরায়েলকে বাইরের হুমকি থেকে রক্ষা করা। মোসাদ তাদের কাজের জন্য সরাসরি দেশটির প্রধানমন্ত্রীর কাছে জবাবদিহি করতে হয়। মোসাদের বর্তমান প্রধান ডেভিড ‘দাদি’ বার্নিয়া। ইয়োসি কোহেন দায়িত্ব ছাড়ার পর ২০২১ সালের জুনে তিনি দায়িত্ব নেন। ইসরায়েলে প্রধানমন্ত্রীর পর মোসাদ প্রধানই দেশটির দ্বিতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি।

মোসাদ কীভাবে কাজ করে, এজেন্টরা কেমন—সে বিষয়ে বাকি বিশ্ব তেমন কিছু জানে না। এমনকি খোদ ইসরায়েলিদেরও মোসাদের কার্যক্রম নিয়ে তেমন কোনো ধারণা নেই।
২০১৫ সালে মোসাদের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন ইয়োসি কোহেন। ২০২১ সালে দায়িত্ব ছাড়ার পর তিনি ইসরায়েলের এক সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দেন। সেখানে তিনি মোসাদের কার্যক্রম নিয়ে কিছু লোমহর্ষ তথ্য তুলে ধরেছিলেন। সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, দায়িত্বে থাকার সময় তাঁর শতাধিক পাসপোর্ট ছিল।
অবশ্য ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরায়েল রাষ্ট্রের জন্মের আগে থেকেই ইহুদি গোয়েন্দারা ওই অঞ্চলে সক্রিয় ছিল। তাদের ইতিহাসের শুরু ১৯২৯ সালে। তখন ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে ব্রিটিশ শাসন চলছিল।
ওই সময় আরবদের সঙ্গে সংঘাত ও ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিরোধের কারণে ইহুদি বসতিগুলো হামলার ঝুঁকিতে থাকত। তা ঠেকাতে এবং ফিলিস্তিনে ইহুদিদের অবৈধ বসতির বিস্তার নিশ্চিত করতে গোয়েন্দা তৎপরতা জরুরি হয়ে পড়েছিল। প্রথম ইহুদি গোয়েন্দা সংস্থার নাম ছিল ‘শাই’।

মোসাদের সফল যত অভিযান
কুখ্যাতি পাওয়া মোসাদ তাদের দৃষ্টিকোণ থেকে বেশ কয়েকটি সফল অভিযান চালিয়েছে। বিভিন্ন দেশে এসব সাফল্যের গল্প নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। যদিও চলচ্চিত্রে সেসব অনেকটাই অতিরঞ্জিত করে দেখানো।
মোসাদের প্রথম যে অভিযানটি সারা বিশ্বে হইচই ফেলে দিয়েছিল, সেটি হলো নাৎসি কর্মকর্তা অ্যাডলফ আইখম্যানকে খুঁজে বের করা। মোসাদের এজেন্টরা ১৯৬০ সালে আর্জেন্টিনায় অ্যাডলফ আইখম্যানকে খুঁজে বের করে এবং সেখান থেকে তাঁকে অপহরণ করে গোপনে ইসরায়েলে নিয়ে যায়। নিজেকে লুকিয়ে রাখতে আইখম্যান বেশ কয়েকটি দেশ পরিবর্তন করেছিলেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অ্যাডলফ হিটলারের নাৎসি বাহিনী প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে, ইতিহাসে যা ‘হলোকাস্ট’ নামে পরিচিত। অ্যাডলফ আইখম্যান ‘হলোকাস্ট’-এর মূল স্থপতিদের একজন ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে ইহুদিদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ছিল।১৯৬২ সালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে তাঁর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।

১৯৭৬ সালে উগান্ডায় এন্টাবি অভিযানকে ইসরায়েলের সবচেয়ে সফল সামরিক অভিযান বলা হয়, পশ্চিমা বিশ্ব ওই অভিযানে তাদের সমর্থন দিয়েছিল।
ঘটনাটি ছিল উড়োজাহাজ ছিনতাই নিয়ে। তেল আবিব থেকে এথেন্স হয়ে প্যারিসগামী এয়ার ফ্রান্সের একটি উড়োজাহাজ ছিনতাই করে ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন’-এর দুই সদস্য এবং তাদের দুই জার্মান সহযোগী। তারা প্রথমে উড়োজাহাজের ২৪৮ যাত্রীকে জিম্মি করে।
মিসর দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলকে ‘গাজায় বড় কিছু ঘটছে’ বলে একাধিকবার সতর্ক করেছিল। কিন্তু ইসরায়েল গুরুত্ব দেয়নি।
পরে উড়োজাহাজ ছিনতাইকারীরা শতাধিক ইহুদি যাত্রীকে জিম্মি রেখে বাকিদের মুক্তি দেয়। সে সময় উগান্ডা সরকার ফিলিস্তিনি ছিনতাইকারীদের দাবির পক্ষে সমর্থন জানিয়েছিল এবং তাদের নিরাপত্তায় এন্টাবি বিমানবন্দরে সেনা পাঠিয়েছিল।
ইহুদি জিম্মিদের উদ্ধার করতে অভিযানে নামে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী। মোসাদ এজেন্টদের সহায়তায় সেনারা সফলভাবে ইহুদি জিম্মিদের মুক্ত করে আনে। ওই অভিযানে ইসরায়েলের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর বড় ভাই ইয়োনাতান নেতানিয়াহু নিহত হন। তিনি ইসরায়েলের পক্ষে অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।
১৯৮০ সালে নকল ডাইভিং রিসোর্টের আড়ালে শত্রুদেশ সুদানের ভেতর দিয়ে গোপনে ইথিওপিয়া থেকে প্রায় সাত হাজার ইথিওপীয় ইহুদিকে ইসরায়েলে নিয়ে এসেছিল মোসাদ। তারা এ অভিযানের নাম দিয়েছিল ‘অপারেশন ব্রাদার্স’। প্রায় পাঁচ বছর ধরে তারা এ কাজ করেছে। এ ঘটনা নিয়ে পরে ‘রেড সি ডাইভিং’ নামে নেটফ্লিক্সে একটি সিরিজ মুক্তি পায়।
১৯৭২ সালে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ মিউনিখ অলিম্পিকে অংশ নেওয়া ১১ ইসরায়েলি খেলোয়াড়কে অপহরণ করে। তাঁদের দুজনকে হত্যা এবং নয়জনকে জিম্মি করা হয়। পশ্চিম জার্মান পুলিশ তাঁদের উদ্ধারে ব্যর্থ হয়। পরে ওই নয়জনকেও হত্যা করা হয়।
ওই ঘটনার প্রতিশোধ নিতে মোসাদ খুঁজে খুঁজে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ দলে থাকা সবাইকে হত্যা করে।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর দলের এক সদস্য মাহমুদ হামশারিকে হত্যা করতে মোসাদের এজেন্টরা তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে ফোনে বিস্ফোরক লাগিয়ে আসে। ফোন বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত হয়ে পরে মারা যান হামশারি।
১৯৯৬ সালে এ রকমই একটি অভিযানে হামাসের বোমা প্রস্তুতকারক ইয়াহিয়া আয়াশকে হত্যা করে মোসাদ। তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল একটা মটোরোলা আলফা মোবাইল ফোনে বিস্ফোরক ঢুকিয়ে। ৫০ গ্রাম বিস্ফোরক রাখা হয়েছিল ওই মোবাইলে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে লেবাননের সশস্ত্র বাহিনী হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধেও একই কৌশল খাটায় ইসরায়েল। ১৭ ও ১৮ সেপ্টেম্বর পরপর দুই দিন হিজবুল্লাহর সদস্যদের কাছে থাকা কয়েক হাজার পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরিত হয়। দুটোই তারহীন যোগাযোগের যন্ত্র। ওই ঘটনায় ৩৯ জন নিহত এবং প্রায় ৩ হাজার মানুষ আহত হন।
ওই বছরের ডিসেম্বরে সূত্রের বরাত দিয়ে টাইমস অব ইসরায়েল বলেছিল, মন্ত্রিসভার একটি বৈঠকে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু প্রথমবারের মতো স্বীকার করেন, তাঁর লোকজনই লেবাননে পেজার ও ওয়াকিটকিতে বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। হাঙ্গেরিতে তৈরি যন্ত্রগুলো লেবাননে পৌঁছানোর আগেই মোসাদের এজেন্টরা সেগুলোতে বিস্ফোরক ভরে দেয়।
পেজার ও ওয়াকিটকি বিস্ফোরণের মাত্র ১০ দিনের মাথায় লেবাননের রাজধানী বৈরুতে এক রাতে তুমুল হামলা চালিয়ে হিজবুল্লাহ প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে হত্যা করে ইসরায়েল। মোসাদের গোয়েন্দারাই নাসরুল্লাহর অবস্থানের সঠিক তথ্য দিয়েছিল।

এর আগে ২০১০ সালে দুবাইয়ের একটি হোটেলে হামাসের জ্যেষ্ঠ সামরিক নেতা মাহমুদ আল-মাভুহকে শ্বাসরোধে হত্যার ঘটনাও মধ্যপ্রাচ্যে আলোড়ন তুলেছিল। প্রথম দিকে স্বাভাবিক মৃত্যু মনে করা হলেও পরে সিসিটিভি ফুটেজে দেখে দুবাই পুলিশ হত্যাকারীদের শনাক্ত করতে সক্ষম হয়। হত্যাকারীরা মোসাদের এজেন্ট বলে ধারণা করা হয়।
দুবাই ইসরায়েলের এই অনুপ্রবেশে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল, দেখা দিয়েছিল কূটনৈতিক উত্তেজনা। হত্যাকারীদের বেশির ভাগই ভুয়া পাসপোর্ট ব্যবহার করেছিলেন।
গত বছরের ৩০ জুলাই মধ্যরাতের পর ইরানের রাজধানী তেহরানে একটি অতিথিশালায় হামলা চালিয়ে তৎকালীন হামাস প্রধান ইব্রাহিম হানিয়াকে হত্যা করে ইসরায়েল। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তেহরান গিয়েছিলেন হানিয়া।
হানিয়া যেখানে ছিলেন, সেটি ছিল দেশটির ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ডের (আইআরজিসি) অতিথিশালা। সেখানে আইআরজিসির দুই নিরাপত্তা কর্মকর্তাই বোমা পেতে রেখেছিলেন। পেজেশকিয়ানের শপথ অনুষ্ঠান শেষে হানিয়া ওই অতিথিশালায় ওঠেন। তিনি কোন কক্ষে উঠেছেন, সেটা নানা সূত্রে নিশ্চিত হয়ে বিদেশ থেকে ওই দুই কর্মকর্তা বোমার বিস্ফোরণ ঘটান। পরে অন্য দুটি কক্ষ তল্লাশি করে বোমা পাওয়া যায়।

সে সময় আইআরজিসি নিশ্চিত করেছিল, হানিয়াকে হত্যার জন্য মোসাদই আইআরজিসির সুরক্ষা ইউনিট আনসার আল-মাহদির কর্মকর্তাদের ভাড়া করেছিল।
এর আগে মে মাসে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় ইরানের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি মারা গেলে তাঁর দাফন কাজে যোগ দিতে তেহরান গিয়েছিলেন হানিয়া। তখনো তাঁকে হত্যার চেষ্টা করেছিল মোসাদ।

মোসাদের ব্যর্থতা
মোসাদের ঝুলিতে অনেক সফল অভিযান যেমন আছে, তেমনই ব্যর্থতার গল্পও নেহাত কম নয়।
শুধু মোসাদ নয়, বরং ইসরায়েলের সব গোয়েন্দা বাহিনীর জন্য ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজা থেকে হামাসের হামলা আটকাতে না পারা। সেদিন হামাস ও গাজার আরও কয়েকটি সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে ইসরায়েলের দক্ষিণাঞ্চলে ঢুকে হামলা চালিয়েছিল। সেদিন হামলায় প্রায় ১ হাজার ২০০ মানুষ নিহত হন, বন্দী করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয় ২৫২ জনকে।
ওই হামলার পর মিসর দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলকে ‘গাজায় বড় কিছু ঘটছে’ বলে একাধিকবার সতর্ক করেছিল। কিন্তু ইসরায়েল গুরুত্ব দেয়নি। যদিও নেতানিয়াহু মিসরের এই দাবি অস্বীকার করেছিলেন।

এ ছাড়া মোসাদের ব্যর্থ অভিযানের তালিকায় রয়েছে হামাসের একসময়ের রাজনৈতিক শাখার প্রধান খালেদ মেশালকে হত্যার চেষ্টা। ১৯৯৭ সালে খালেদ মেশালকে জর্ডানে বিষ প্রয়োগে হত্যার চেষ্টা করেছিল মোসাদ। কিন্তু এজেন্টরা ধরা পড়ে যায়।
এ ঘটনায় জর্ডান-ইসরায়েলের মধ্যে বড় ধরনের কূটনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছিল। পরে মোসাদের তৎকালীন প্রধান দানি ইয়াতম হামাস নেতা খালেদ মেশালের জন্য ‘অ্যান্টিডোট’ নিয়ে জর্ডানে যেতে বাধ্য হন। এ ঘটনার জেরে পরের বছর মোসাদ প্রধানের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ান দানি ইয়াতম।
১৯৫৪ সালে মিসরে মার্কিন ও ব্রিটিশ স্থাপনায় বোমা হামলার চেষ্টা করেছিল ইসরায়েল। উদ্দেশ্য ছিল সুয়েজ খাল পাহারায় ব্রিটিশ সেনাদের নিযুক্ত রাখতে যুক্তরাজ্যকে চাপ দেওয়া। মিসর ইসরায়েলি গোয়েন্দাদের ওই চক্রান্ত বানচাল করে দেয়। তখন এ ব্যর্থতার দায় অনেকটাই মোসাদকে নিতে হয়েছিল।

মোসাদের মূল ‘টার্গেট’ ইরান
এ বছরের জুনে যুদ্ধে জড়িয়েছিল ইসরায়েল ও ইরান, ১২ দিন ধরে ওই যুদ্ধ চলেছিল। ১৩ জুন ভোরের আলো ফোটার আগে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ ইরানে মুহুর্মুহু হামলা শুরু করে।
সেদিনের সেই হামলায় যাঁরা নিহত হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে ছিলেন ইরানের সামরিক বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরি, রেভল্যুশনারি গার্ড কোরের প্রধান মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি, তেহরানে অবস্থিত ইসলামিক আজাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ও পদার্থবিজ্ঞানী মোহাম্মদ মেহদি তেহরাঞ্চিসহ আরও বেশ কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানী ও উচ্চপদস্থ অনন্ত ২০ সামরিক কর্মকর্তা।

হামলার পর কয়েকটি ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ করা হয়। একটি ঝাপসা ভিডিওতে দেখা যায়, নাইট-ভিশন চশমা পরা মোসাদ সদস্যরা মরুভূমির মতো জায়গায় বসে সামরিক সরঞ্জাম ও অস্ত্র স্থাপন করছেন। ইরানের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার জন্য সেসব বসানো হয়, যাতে ইসরায়েলি যুদ্ধবিমানগুলো নিরবচ্ছিন্নভাবে হামলা চালাতে পারে।
সে সময় একজন জ্যেষ্ঠ ইসরায়েলি নিরাপত্তা কর্মকর্তা বলেছিলেন, ইসরায়েলের বহুস্তরবিশিষ্ট ওই হামলায় নেতৃত্ব দেয় মোসাদ।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যমগুলোতে ইরানে সামরিক অভিযান নিয়ে খবরে বলা হয়, ইসরায়েলের হামলায় ইরানের প্রতিরক্ষা অবকাঠামোর বড় অংশ ধ্বংস হয়ে গেছে, বেশ কয়েকজন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। এসবের নেপথ্যে রয়েছে ইসরায়েলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ।
মোসাদ দাবি করেছিল, তারা ইরানের নিরাপত্তা কাঠামোর বড় একটি অংশে অনুপ্রবেশ করতে পেরেছে।
গত ১৭ জুন অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক বাহিনীর ১০ কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছিল। মোসাদের সাবেক গবেষণা পরিচালক সিমা শাইন এপিকে বলেছিলেন, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে নিশানা করার জন্য মোসাদ বহু বছর ধরে যে পরিকল্পনা করে আসছিল, এ হামলা ছিল তারই চূড়ান্ত রূপ।’
মোসাদের এজেন্টরাই ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র গোপনে ইরানে ঢোকান এবং দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে দেন। যুদ্ধের পর মোসাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ইরানে ব্যাপক ধরপাকড় চলে, কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
এর আগে ২০২০ সালে ইরানের শীর্ষ পরমাণুবিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহকে তেহরানের কাছে চলন্ত গাড়িতে গুলি করে হত্যা করা হয়। ওই সময় ইরান নিশ্চিত করে, হত্যাকাণ্ডে দূরনিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছিল।
ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম বলেছিল, এক টন ওজনের একটি বন্দুক খণ্ড খণ্ড করে ইরানে পাচার করে মোসাদ। বন্দুকটি ছোট ট্রাকের পেছনে বসানো হয়। চলন্ত অবস্থায় সেটি থেকে ফাখরিজাদেহর গাড়িতে গুলি করে এ বিজ্ঞানীকে হত্যা করার পর ট্রাকটিও বিস্ফোরণ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়।

গত দুই দশকে ইরানের বেশ কয়েকজন পরমাণুবিজ্ঞানীকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এসব হত্যাকাণ্ডের পেছনেও মোসাদের বড় ভূমিকা রয়েছে।
মোসাদ নিয়ে ইসরায়েলের কেন এত অতিরঞ্জিত প্রচার
মোসাদ ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা। মোসাদের এজেন্টরা গোপনে, ছদ্মবেশে কাজ করে। এমনকি তাদের পরিবার ও ঘনিষ্ঠজনেরাও তাদের আসল কাজ সম্পর্কে কোনো দিন জানতে পারে না। যেমনটা জানতেন না এলি কোহেনের স্ত্রী নাদিয়া কোহেন। নাদিয়া জানতেন তাঁর স্বামী একজন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা।

তবে ইসরায়েল কেন মোসাদের এত গুণগান করে। প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে যেকোনো সাফল্যকে তারা তাদের গোয়েন্দাদের, বিশেষ করে মোসাদের কৃতিত্ব হিসেবে প্রচার করে।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন, গোয়েন্দাদের অস্ত্রভান্ডারের একটি অত্যন্ত কার্যকর অস্ত্র হলো প্রচার।
প্রতিপক্ষ দেশের নিরাপত্তা অবকাঠামোর কত গভীরে অনুপ্রবেশ করেছে এবং তা ধ্বংস করে দেওয়ার ক্ষমতা কতখানি—তা প্রকাশ করে যেকোনো দেশের মনোবল নষ্ট করে দেওয়া যায়। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও এর থেকে সুবিধা নেওয়া যায়।
একবার আল-জাজিরাকে লুক্সেমবার্গের এক প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক এ বিষয়ে বলেছিলেন, ‘এটি আসলে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ।’
এর ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন ওই প্রতিরক্ষা বিশ্লেষক। তিনি বলেছিলেন, ‘ধরুন আমি বারবার বললাম, আমি আপনার বাড়ির ভেতর ঢুকেছি। আর আপনি বারবার তা অস্বীকার করে গেলেন। এরপর আমি আপনার বাড়িতে ঢোকার প্রমাণ হাজির করলাম। তখন আপনার মুখের অবস্থা কেমন হবে? আপনাকে দুর্বল দেখাবে।’
এই বিশ্লেষক বলেন, ঠিক এ কারণে ইসরায়েল বারবার ইরানে অনুপ্রবেশ করা নিয়ে গর্বভরে প্রচার করে। তারা চায় ইরান তা অস্বীকার করুক এবং তারপর তারা প্রমাণ হাজির করবে।
অনেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সিআইএ বা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির মতো মোসাদকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়ংকর গোয়েন্দা সংস্থার একটি বলে মনে করে।
অনুপ্রবেশ ও নৃশংসতার দিক দিয়ে মোসাদ এজেন্টরা তাদের সঙ্গে সমানে সমান পাল্লা দেয়। গোপনে হত্যা, বিদেশি ভূখণ্ডে নাশকতা, সার্বভৌম রাষ্ট্রে অনুপ্রবেশ করে মোসাদ তীব্র কূটনৈতিক সংকট তৈরি করে। কখনো কখনো তাদের কাণ্ড যুদ্ধ বাধিয়ে দেওয়ার মতো উত্তেজনার কারণ হয়ে যায়। এর শিকার হয় নিরীহ মানুষ।
যেমন ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ সংগঠনের অপারেশন প্রধান আলী হাসান সালামেহ মনে করেন, নরওয়ের লিলেহ্যামার শহরে মরক্কোর ওয়েটার আহমেদ বুশিখিকে হত্যা করেছিল মোসাদ। ওই ঘটনার পর মোসাদের কয়েকজন এজেন্টকে বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। তেহরানে ইব্রাহিম হানিয়াকে হত্যার পরও যুদ্ধ উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছিল।
ইসরায়েল মোসাদকে ব্যবহার করে মধ্যপ্রাচ্যে একটি আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে রাখতে চায়। ত্রাস ছড়ানো আর বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করাই মোসাদের মূল কৌশল। আর এই কৌশল তাদের ভাবমূর্তিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে রেখেছে। দিয়েছে কুখ্যাতি।
তথ্যসূত্র: (বিবিসি, আল-জাজিরা, দ্য ওয়াশিংটন, দ্য ইসরায়েল টাইমস)
      
                
                


