যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পরও ফিলিস্তিনের গাজায় হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইলি বাহিনী। সর্বশেষ হামলায় অন্তত ৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এছাড়া প্রতিশ্রুত ত্রাণের মাত্র এক-চতুর্থাংশ গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে ইসরাইল। এরই মধ্যে আসন্ন শীত মোকাবিলায় ধ্বংসস্তূপের মাঝেই আশ্রয় নির্মাণের লড়াই করছেন বাস্তুহারা ফিলিস্তিনিরা। এদিকে দুই বছর পর আবারও স্কুলে ফিরতে শুরু করেছে গাজার শিশুরা। খবর আলজাজিরার।
যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও খান ইউনিসের আশপাশের এলাকায় হামলা ও ধ্বংসযজ্ঞ অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। শনিবারও টানা পঞ্চম দিনের মতো গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। এতে ৫ জন নিহত হয়েছেন। এছাড়া রোববারও ড্রোন হামলায় আরেক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি হামলায় অন্তত ২২৬ ফিলিস্তিনি নিহত ও ৫৯৪ জন আহত হয়েছেন। অনেক আহত ব্যক্তি পর্যাপ্ত ওষুধ ও চিকিৎসা না পাওয়ায় পরিস্থিতির আরও অবনতি হচ্ছে। হাসপাতালগুলো বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও সার্জিক্যাল সরঞ্জামের ঘাটতিতে কার্যত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
এদিকে গাজা কর্তৃপক্ষ বলছে, যুদ্ধবিরতির শর্ত ভেঙে ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত হামলায় হতাহতের সংখ্যা ও ত্রাণ প্রবেশে বাধা দেওয়ায় মানবিক সংকট ভয়াবহভাবে বাড়ছে। গাজা সরকার জানিয়েছে, ১০ থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত ৩ হাজার ২০৩টি বাণিজ্যিক ও ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে, অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে মাত্র ১৪৫টি ট্রাক প্রবেশের অনুমতি পেয়েছে, যা যুদ্ধবিরতির অংশ হিসাবে নির্ধারিত দৈনিক ৬০০ ট্রাকের মাত্র ২৪ শতাংশ। শনিবার এক বিবৃতিতে গাজার গণমাধ্যম দপ্তর জানায়, ইসরাইলি দখলদার বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ত্রাণ ও বাণিজ্যিক পণ্যবাহী ট্রাকগুলোকে বাধা দিচ্ছে। এর ফলে ২৪ লাখেরও বেশি মানুষের মানবিক সংকট ভয়াবহভাবে বেড়েছে। এই অবস্থায় গাজার পক্ষ থেকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পসহ যুদ্ধবিরতির মধ্যস্থতাকারী দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে-যাতে তারা ‘কোনো শর্ত বা বিধিনিষেধ ছাড়াই’ ত্রাণ প্রবেশের অনুমতি দেওয়ার জন্য ইসরাইলের ওপর চাপ প্রয়োগ করে। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র ফারহান হক বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে জানান, ইসরাইলি কর্তৃপক্ষের নির্দেশে ত্রাণের রুট পরিবর্তনের কারণে কার্যক্রম মারাত্মকভাবে সীমিত হয়ে পড়েছে।
শনিবার ইসরাইলের যুদ্ধবিমান, ট্যাংক ও কামান দক্ষিণ গাজার খান ইউনিস এলাকায় গোলাবর্ষণ করে। উত্তর গাজার জাবালিয়া শরণার্থী ক্যাম্পের পূর্বে বেশ কিছু আবাসিক ভবনও ধ্বংস করেছে। যুদ্ধবিরতির পর ত্রাণের পরিমাণ কিছুটা বাড়লেও গাজার মানুষ এখনো খাদ্য, পানি, ওষুধসহ জরুরি জিনিসের তীব্র সংকটে ভুগছে। অনেক পরিবার এখনো আশ্রয়হীন। তাদের বাড়িঘর ইসরাইলের দুই বছরের ধারাবাহিক হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে। এদিকে শীত আসছে। তাই বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিরা মাথা গোঁজার ঠাঁই নির্মাণে আরেক সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েছেন। স্থানীয়রা প্রথাগত পদ্ধতি ব্যবহার করেই মাটির সঙ্গে ধ্বংসস্তূপের ইটের খোয়া মিশিয়ে ছোট আশ্রয়ের স্থান নির্মাণ করছেন।
অনেকের মতো পাঁচ সন্তানের জনক খালিদ আল-দাহদৌহও গৃহহীন পরিবারের জন্য ছোট আশ্রয় নির্মাণে স্থানীয় পদ্ধতি অবলম্বন করছেন। ধ্বংসস্তূপ থেকে উদ্ধার করা ইট এবং কাদা মিশিয়ে তিনি কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই নির্মাণ করছেন। তিনি বলেন, শীতকাল আসছে বলে আমরা মাথা গোঁজার ঠাঁই নির্মাণের চেষ্টা করছি। আমরা মাত্র কয়েক সারি ইট গাঁথতে পেরেছি-আমাদের কাছে তাঁবু বা অন্য আর কিছুই নেই। তাই, আমরা কাদা দিয়ে একটি কাঠামো তৈরি করেছি। কারণ আমাদের কাছে কোনো সিমেন্ট নেই। এটি আমাদেরকে ঠান্ডা, পোকামাকড় এবং বৃষ্টি থেকে রক্ষা করবে। আল-দাহদৌহের চেষ্টা দেখে তার আত্মীয় সাইফ আল-বায়েকও একটি আশ্রয় তৈরি করার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু উপকরণের অভাবের কারণে সেটি শেষ করতে পারেননি।
গাজায় নির্মাণ সামগ্রী প্রবেশের ওপরও ইসরাইলের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। তাই আনুষঙ্গিক উপকরণের অভাবে পুনর্গঠন প্রক্রিয়াও বিলম্বিত হচ্ছে।
ইসরাইলি নেতারা বলছে, হামাস যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করেছে, কারণ তারা সব মৃত ইসরাইলি বন্দির লাশ ফেরত দেয়নি। হামাসের দাবি, গাজার ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ও ইসরাইলের বাধার কারণে মৃতদেহ উদ্ধারের কাজ জটিল হয়ে পড়েছে। শুক্রবার রাতে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটি জানিয়েছে, তারা হামাসের কাছ থেকে পাওয়া তিনজনের লাশ ইসরাইলে হস্তান্তর করেছে। কিন্তু ইসরাইলি গণমাধ্যম জানায়, পরীক্ষায় দেখা গেছে এই মরদেহগুলো অবশিষ্ট ১১ জন মৃত ইসরাইলি বন্দির মধ্যে কারও নয়।
ধীরে ধীরে শ্রেণিকক্ষে ফিরছে গাজার শিশুরা : এদিকে যুদ্ধবিরতি শুরুর পর গাজায় কিছু স্কুল ফের খুলে দিয়েছে জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)। ধীরে ধীরে শ্রেণিকক্ষে ফিরছে শিশুরা। ইউএনআরডব্লিউএর প্রধান ফিলিপ লাজারিনি মঙ্গলবার ‘এক্স’-এ জানান, ইতোমধ্যে ২৫ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ‘সংস্থার অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্রে’ যোগ দিয়েছে। আরও ৩ লাখ শিক্ষার্থী অনলাইনে ক্লাস করবে। গাজার মধ্যাঞ্চলের নুসেইরাত এলাকার পশ্চিমে আল হাসাইনা স্কুলে শনিবার ক্লাস শুরু হয়েছে। তবে পর্যাপ্ত শ্রেণিকক্ষ না থাকায় পাঠদানেও সীমাবদ্ধতা রয়েছে। ২ বছর পর স্কুলে ফিরতে পেরে শিশুরা বেশ উচ্ছ্বসিত। এক শিক্ষার্থীর আত্মীয় জেনিন আবু জারাদ বলেন, ৭ অক্টোবরের পর থেকে আমাদের বাচ্চারা স্কুলে যেতে পারেনি। এই সময়টায় তারা শুধু পানি আনত, খাবার জোগাড় করত, আর রাস্তায় খেলত। তবে গত সপ্তাহ-দশ দিন আগে থেকে স্কুলগুলো ধীরে ধীরে খুলতে শুরু করেছে, এটাই স্বস্তির।