Image description

১০ অক্টোবর, ২০২৫ থেকে কার্যকর ট্রাম্পের গাজা শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে, জাতিসংঘের ফিনান্সিয়াল ট্র্যাকিং সার্ভিস (এফটিএস) এবং সাম্প্রতিক সংবাদ প্রতিবেদন অনুযায়ী, তুরস্ক-কাতার-মিশর, এই  তিন দেশের সম্মিলিত প্রচেষ্টা গাজার যুদ্ধবিরতি রক্ষা এবং পুনর্গঠনে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করছে। তবে, ইসরায়েলের বাধা এবং যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন এই প্রচেষ্টায় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করছে।
গত এক সপ্তাহের গাজাকে কেন্দ্র করে মূলত তুরস্ক-কাতার-মিশর কি করেছে, এবং আরও কিছু প্রাসঙ্গিক আলোচনা:  
১) তুরস্ক এই মুহূর্তে গাজার জন্য সবচেয়ে বড় মানবিক সাহায্য প্রদানকারী দেশ যারা অন-দ্য-গ্রাউন্ড সাপোর্টে নেতৃত্ব দিচ্ছে। তুরস্ক মোট মানবিক সাহায্যের ২৬% প্রদান করছে, যা এফটিএস অনুযায়ী সর্বোচ্চ। যুদ্ধবিরতির পর তুরস্ক দৈনিক ৬০০ ট্রাক ত্রাণের ব্যবস্থা করেছে, যা মিশরের রাফাহ ক্রসিং দিয়ে গাজায় প্রবেশ করে। তবে, ইসরায়েলের বাধার কারণে অর্ধেকের বেশি ট্রাক সীমান্তে আটকে রয়েছে।
২) তুরস্ক গাজার আহতদের জন্য তুরস্কে চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করছে। যুদ্ধবিরতি শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত কয়েক ডজন রোগীকে তুরস্কের হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে, বিশেষ করে আঙ্কারা এবং ইস্তানবুলের হাসপাতালে। ২ টি ১০০ বেডের মোবাইল হাসপাতাল পাঠিয়েছে। যদিও এসব  এখনও গাজায় প্রবেশ করতে পারেনি। এগুলো মিশরের রাফাহ সীমান্তে অপেক্ষমাণ রয়েছে, কারণ ইসরায়েল এখনও এসব যাচাই করছে। 
৩) তুরস্ক ৫০০  টনের বেশি চিকিৎসা সরঞ্জাম (অক্সিজেন সিলিন্ডার, ভেন্টিলেটর, অ্যান্টিবায়োটিক, সার্জারি কিট এবং ইমার্জেন্সি মেডিকেল সাপ্লাই) পাঠিয়েছে। রাফাহ ক্রসিংয়ের থ্রুতে ইতিমধ্যে ২০০ টনেরও বেশি গাজায় প্রবেশ করেছে, যা তুর্কি রেড ক্রিসেন্ট এবং জাতিসংঘের সহায়তায় বিতরণ হয়েছে।
তাদের পাঠানো অক্সিজেন সরঞ্জাম এবং জরুরি ওষুধ (যেমন ট্রমা কিট) গাজা সিটি এবং উত্তর গাজায় পৌঁছেছে, যা প্রায় ৫০,০০০ আহত ফিলিস্তিনিকে সাহায্য করছে। ৫০ জনেরও বেশি তুর্কি চিকিৎসক এবং নার্স মিশরের সীমান্তে অবস্থান করে গাজার রোগীদের চিকিৎসা দিচ্ছে এবং স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীদের ট্রেনিং দিচ্ছে।
৪) তুরস্ক পানি শোধন ইউনিট এবং পানির ট্রাক পাঠিয়েছে, যা গাজার পানি সংকট মোকাবিলায় সহায়তা করছে। এই ট্রাকগুলো প্রাথমিকভাবে রাফাহ ক্রসিংয়ে অপেক্ষমাণ, তবে কিছু গাজায় প্রবেশ করেছে। পাঠিয়েছে এক বহর নির্মাণ যন্ত্রপাতি যেমন বুলডোজার, ক্রেন  ইত্যাদি। এগুলোও রাফায় অপেক্ষমাণ। 
৫) তুরস্ক পাঠিয়েছে স্কুল  সরঞ্জাম (বই, নোটবুক, স্টেশনারি) এবং শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য প্যাকেজ পাঠিয়েছে। তুর্কি এনজিও, যেমন ইএইচএইচ (ইনসানি ইয়ার্দিম ভাকফি), গাজায় খাদ্য বিতরণে সক্রিয় । তুরস্ক গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত স্কুল পুনর্নির্মাণের জন্য শিক্ষক এবং প্রশাসকদের ট্রেনিং, নির্মাণ কর্মীদের জন্য ট্রেনিং প্রোগ্রাম শুরু হয়েছে, যারা ধ্বংসস্তূপ অপসারণ (৫৫ মিলিয়ন টন ধ্বংসাবশেষ) এবং নতুন অবকাঠামো নির্মাণে কাজ করবে। তুর্কি ইঞ্জিনিয়াররা এই প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছে। 
৬) তুরস্ক ৮১ জন দুর্যোগ ত্রাণকর্মী পাঠিয়েছে মিশরের সীমান্তে, যারা ইসরায়েলের অনুমতি পেলে গাজায় প্রবেশ করে মৃতদেহ উদ্ধার (ইসরায়েলি জিম্মিদেরসহ) এবং প্রাথমিক পুনর্গঠন কাজ শুরু করবে।
৭) তুরস্ক মাল্টিন্যাশনাল বাহিনীতে নিজেদের সৈন্য, লজিস্টিক সাপোর্ট, এবং নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ মোতায়েনের প্রস্তাব দিয়েছে, যা যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ এবং পুনর্নির্মাণে নিরাপত্তা প্রদান করবে।  উদ্দেশ্য হলো গাজায় দীর্ঘমেয়াদী উপস্থিতি নিশ্চিত করা এবং ইসরায়েলের ‘মাউ দ্য লন’ কৌশল (পর্যায়ক্রমিক আক্রমণ) রোধ করা। 
তবে, ইসরায়েল এই প্রস্তাবকে ‘রেড লাইন’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে। ট্রাম্প তুরস্কের মধ্যস্থতাকে সমর্থন করলেও ইসরায়েলের বিরোধিতার কারণে সামরিক মোতায়েন এখনও অনিশ্চিত।
৮) তুর্কি সেনার গাজায় প্রবেশ হলে হামাসের জন্য লাভ হবে, কারণ এটি তাদের নিরাপত্তা এবং আঞ্চলিক প্রভাব বাড়াবে। তবে, হামাস অস্ত্র ছাড়বে না, কারণ তারা নিরস্ত্রীকরণকে শান্তি পরিকল্পনার শর্ত হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছে।
৯) ইসরায়েল তুর্কি সেনার গাজায় প্রবেশকে বিরোধিতা করছে, কারণ তারা মনে করে তুরস্ক হামাসকে সামরিক এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করবে। ইসরায়েল মনে করে তুরস্কের ‘নিও-অটোমান’ উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সামর্থ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের প্রভাব কমিয়ে দেবে। তুরস্কের হামাস-সমর্থন এবং অটোমান শাসনের ইতিহাস (১৫১৬-১৯১৭) ইসরায়েলের জন্য উদ্বেগের কারণ।
১০) কাতার গাজার পুনর্নির্মাণে বড় আর্থিক অবদান এবং মধ্যস্থতায় নেতৃত্ব দিচ্ছে। তাদের প্রচেষ্টা গাজার শাসনব্যবস্থা এবং যুদ্ধবিরতি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ।
কাতার রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে অক্টোবর ২০২৫ থেকে ২৮ মিলিয়ন ডলারের বেশি সাহায্য দিয়েছে। এতে খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম, আশ্রয় এবং পানি সরবরাহ অন্তর্ভুক্ত। তারা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ৭০ বিলিয়ন ডলারের পুনর্নির্মাণ পরিকল্পনায় সবচেয়ে বড় অংশীদার। তারা হাসপাতাল, স্কুল এবং অবকাঠামো পুনর্নির্মাণে বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, বিশেষ করে গাজা সিটি এবং উত্তর গাজায়।
১১) কাতার গাজার অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য জ্বালানি, বিদ্যুৎ এবং পানি সরবরাহ প্রকল্পে বিনিয়োগ করছে। তারা জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে নভেম্বর সম্মেলনে অর্থায়ন পরিকল্পনা চূড়ান্ত করবে।
১২) কাতার হামাস নেতাদের দোহায় আশ্রয় দিয়ে শান্তি-সম্পর্কিত আলোচনা এবং ট্রেনিং প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। এতে দ্বিপাক্ষিক (তুরস্ক-কাতার), ত্রিপাক্ষিক (তুরস্ক-কাতার-হামাস) এবং বহুপাক্ষিক বৈঠক অন্তর্ভুক্ত।
কাতার তুরস্কের সঙ্গে যৌথভাবে যুদ্ধবিরতি গ্যারান্টর হিসেবে কাজ করছে।
১৩) মিশর গাজার সীমান্ত ব্যবস্থাপনা এবং লজিস্টিক সাপোর্টে নেতৃত্ব দিচ্ছে, যদিও তাদের অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। রেড ক্রিসেন্টের মাধ্যমে ২৩ মিলিয়ন ডলারের সাহায্য দিয়েছে, যার মধ্যে খাদ্য, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং আশ্রয় সামগ্রী রয়েছে। রাফাহ ক্রসিং খুলে ত্রাণ প্রবেশের পথ সুগম করেছে, যদিও ইসরায়েলের বাধার কারণে বিলম্ব হচ্ছে। গাজার রোগীদের মিশরীয় হাসপাতালে চিকিৎসা দিচ্ছে। প্তারা রাফাহ ক্রসিংয়ে সৈন্য মোতায়েন করে ত্রাণ বিতরণ এবং যুদ্ধবিরতি পর্যবেক্ষণ করছে।
১৪) অন্যান্য দেশও বেশ কিছু সাহায্য, ত্রাণ, এবং অর্থ দিচ্ছে। যেমন আমেরিকা, UAE, সৌদি আরব ইত্যাদি। তবে উপরের তিন দেশের চাইতে কম। 
১৫) দ্বিতীয় দফার কিছু প্রথমিক পরিকল্পনা আর কাজ শুরু হয়ে গেছে। আমেরিকা ইসরায়েল-নিয়ন্ত্রিত রাফাহ পুনর্নির্মাণে পাইলট প্রকল্প শুরু করেছে যেখানে আবাসন এবং কর্মসংস্থান প্রকল্পে আমেরিকা অর্থায়ন করবে। তারা হামাস-নিয়ন্ত্রিত  উত্তর গাজায় সাহায্য বা পুনর্নির্মাণ করবে না, যতক্ষণ না হামাস নিরস্ত্রীকরণে রাজি হয়। আমি মনে করি আমেরিকা গাজা পুনর্গঠনে সরাসরি জড়িত না হলেই ফিলিস্তিনিদের জন্য ভালো ছিলো। 
তুরস্ক এবং কাতার গাজা সিটি এবং উত্তর গাজায পুনর্নির্মাণে মনোযোগ দিচ্ছে, যেখানে ধ্বংসের মাত্রা সবচেয়ে বেশি।
১৬) তুরস্ক এবং কাতারের জোট ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং সিরিয়াস। তারা দোহায় বৈঠক (২১-২২ অক্টোবর) করে যুদ্ধবিরতি রক্ষা, দুই-রাষ্ট্র সমাধান এবং গাজার শাসনব্যবস্থায় সমন্বয় করছে। তাদের হামাস-সমর্থন এবং কূটনৈতিক প্রভাব ইসরায়েলি পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে ভারসাম্য রক্ষা করছে। তুরস্কের সামরিক প্রস্তাব এবং কাতারের আর্থিক সমর্থন তাদের জোটকে শক্তিশালী করেছে, যা ফিলিস্তিনিদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার সম্ভাবনা তৈরি করছে।
১৭) কূটনৈতিকভাবে এই মুহূর্তে হামাস তুরস্ক এবং কাতারের উপর সবচেয়ে বেশি ভরসা করে, কারণ তারা ধারাবাহিকভাবে ফিলিস্তিনি কারণ সমর্থন করে আছে এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়েছে। তারা মিশরকে কিছুটা বিশ্বাস করলেও  তাদের ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তি চুক্তির কারণে হামাস সতর্ক ভাবে মিসরের সাথে ডিল করছে বলে আমার বিশ্বাস। 
১৮) যদি তুরস্কের সামরিক বাহিনী, কাতারের আর্থিক সমর্থন এবং মিশরের লজিস্টিক সহায়তা গাজায় স্থায়ী উপস্থিতি গড়ে তুলতে পারে, তবে ফিলিস্তিনিদের নিরাপত্তা বহুগুণে বাড়বে।
১৯) সৌদি আরব তাদের অর্থায়নের জন্য হামাসের নিরস্ত্রীকরণকে শর্ত হিসাবে দেওয়ায় হামাসের উপর সৌদিদের প্রভাব কম । কিন্তু তুরস্ক-কাতার সেই শর্ত বেঁধে দেয়নি। এতে হামাসের উপর তুরস্ক আর কাতারের প্রভাব বেড়েছে। 
২০) তুরস্ক-কাটরা-মিশর যুদ্ধ থামাতে যত ব্যস্ত, ইসরায়েলের চরমপন্থী মন্ত্রীরা ফের যুদ্ধ শুরু করতে তত ব্যস্ত। কেনেসেটে গতকাল ওয়েস্ট ব্যাংক দখলের দুটো বিলের প্রাথমিক ভোট অনুমোদন করেছে।  যদিও ওয়েস্ট ব্যাংক দখল এখনও  ট্রাম্পের কাছে রেড লাইন। ট্রাম্প আরব দেশগুলোর কাছে কথা দিয়েছে যে ইজরায়েল তার সময়কালে ওয়েস্ট ব্যাংক দখলে নিবে না।