Image description

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে একসঙ্গে নানা অঙ্ক কষছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জুলাই সনদের ভিত্তি ও পিআর পদ্ধতিতে আগামী ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে নির্বাচনী জোটের চেষ্টায় আরও কিছু ছোট দলকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে জামায়াত।

জামায়াতের একাধিক কেন্দ্রীয় নেতা জানিয়েছেন, ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নির্বাচনে মনোনয়ন দেয় না জামায়াত— এমন সমালোচনা আছে। তবে, ডাকসু ও জাকসুতে ইনক্লুসিভ প্যানেল দিয়ে শিবির পেয়েছে ভূমিধস বিজয়। সেই জায়গা থেকে আগামী নির্বাচনেও প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে কিছু জায়গায় পরিবর্তনের চিন্তা-ভাবনা চলছে। যেখানে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও আদিবাসীদের মধ্য থেকে দেওয়া হতে পারে মনোনয়ন।

 

গত ৭ অক্টোবর দলটির সর্বশেষ নির্বাহী পরিষদের বৈঠকে অংশ নেওয়া এক জ্যেষ্ঠ নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, জোটের পরিকল্পনায় আলাপ-আলোচনা চলছে। দ্বিতীয় দফায় ১১ দিনের কর্মসূচিও ঘোষণা করা হয়েছে। যেখানে সমমনা দলগুলোও কর্মসূচি দিয়েছে। জোট গঠন প্রচেষ্টা সফল হলে নিজেদের বাছাই করা প্রার্থীদের মধ্য থেকে জোটের শরিকদের জন্য ছাড় দেবে জামায়াত।

সংস্কার আলোচনা, জোটের আলাপ আর যুগপৎ আন্দোলনের মধ্যেও জোরেশোরে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে ছয়টি দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনও যেমন করছে জামায়াত, তেমনি পিআর দাবি আদায় না হলে নির্বাচনে অংশ নেবে কি না– ভেবে দেখার হুঁশিয়ারি দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে দলটি

ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি এবং বর্তমানে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য পদমর্যাদার নেতা বলেন, নির্বাচনের মাঠে নেই আওয়ামী লীগ। বিএনপিকে টেক্কা দিতে এবার ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থী করতে পারে জামায়াত। এলাকায় গ্রহণযোগ্য, জাতীয়ভাবে পরিচিত কাউকে প্রার্থী করতে পারলে মন্দ কী! দলীয় সর্বোচ্চ ফোরামের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, আগ্রহ ও যোগ্যতা থাকলে বিবেচনা করা হবে।

dhakapost
পাঁচ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলো নিয়ে নির্বাচনী জোটের চেষ্টায় আরও কিছু ছোট দলকে যুক্ত করার চেষ্টা করছে জামায়াত / ছবি- ঢাকা পোস্ট

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, তৃণমূলের ভোটে ২৯৮টি আসনে প্রার্থী বাছাই করেছে জামায়াতে ইসলামী। যদিও দুটি আসনে চেইন অব কমান্ডের ঐতিহ্য ভেঙে প্রার্থী নিয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষের বিষয়টি আলোচনায় এসেছে।

গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে স্বৈরাচার তকমা পাওয়া আওয়ামী লীগের পতন ঘটে। দীর্ঘ সময় জোটসঙ্গী ও পরবর্তীতে যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী জামায়াতে ইসলামী এখন বিএনপির মিত্র থেকে নির্বাচনী ময়দানে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাঁড়িয়েছে। সংস্কার প্রশ্নে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনা এবং যুক্তি-তর্কেও কয়েকটি বিষয়ে বিএনপির বিপরীতে অবস্থান নিয়েছে জামায়াত। এই বিপরীত অবস্থানে থাকতে ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি ও এবি পার্টির খুব কাছাকাছি সমর্থন পাচ্ছে জামায়াতে ইসলামী।

আগামী জাতীয় নির্বাচনে সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু; অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে সবার জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) নিশ্চিত; ফ্যাসিস্ট সরকারের সব জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতির বিচার দৃশ্যমান করা এবং স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার মতো পাঁচটি দাবিতে গত ১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ২৬ সেপ্টেম্বরের মধ্যে তিনদিনের কর্মসূচি পালন করে জামায়াত।

জামায়াতের ন্যায় ইসলামী আন্দোলন, এনসিপি, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, গণঅধিকার পরিষদ ও বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি মিলে সেই যুগপৎ কর্মসূচিতে যুক্ত হবার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সরে যায় এনসিপি ও গণঅধিকার পরিষদ। তবে, বাকি দলগুলো যুগপৎ কর্মসূচি পালন করেছে।

সংস্কার আলোচনা, জোটের আলাপ আর যুগপৎ আন্দোলনের মধ্যেও জোরেশোরে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতিতে নির্বাচনের দাবিতে ছয়টি দলকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনও যেমন করছে জামায়াত, তেমনি পিআর দাবি আদায় না হলে নির্বাচনে অংশ নেবে কি না– ভেবে দেখার হুঁশিয়ারি দিয়ে বিএনপিকে চাপে রাখার কৌশল নিয়েছে দলটি। পাশাপাশি বসেও নেই তারা। সব আসনে প্রাথমিক প্রার্থী বাছাই করে গত জানুয়ারি থেকে ভোটের প্রচারণা শুরু করেছে। সারাদেশে তাদের নেতাকর্মীরা মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছেন। ইতোমধ্যে গত আগস্ট থেকে সুষ্ঠুভাবে ভোটকেন্দ্র পরিচালনায় বাছাই করা এজেন্ট ও পোলিং এজেন্টদের নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেছে দলটি।

dhakapost
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা-১৫ আসন থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন / ছবি- সংগৃহীত

জামায়াতের এক জ্যেষ্ঠ নেতা নাম প্রকাশ না করে জানান, পিআর পদ্ধতির দাবিতে শেষ পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। দাবি আদায় করা না গেলে বিদ্যমান পদ্ধতিতে নির্বাচনে কীভাবে ভালো ফল করা যাবে, সেই প্রস্তুতিও নিচ্ছে তারা। জোট আলোচনা ও ‍পাঁচ দফার যুগপৎ আন্দোলন চলছে, চলবে। জোট হলে খুবই ভালো। কিন্তু জোটের আশায় প্রস্তুতি কিংবা প্রার্থী বাছাই আটকে রাখেনি দলটি। বাছাই করা প্রার্থীরা প্রচারণা চালাচ্ছেন। সিদ্ধান্ত পরিবর্তন হলে প্রার্থী বদলানোও জামায়াতের জন্য সহজ হবে।

‘নির্বাচনী সমঝোতায়’ আসন ছাড় দেবে জামায়াত

১৯৯৬ সালের পর এককভাবে নির্বাচন করেনি জামায়াতে ইসলামী। ২০০১ সালে ৩১, ২০০৮ সালে ৩৮ এবং ২০১৮ সালে ২২টি আসনে বিএনপির সঙ্গে জোট করে ভোট করা জামায়াত বিএনপি ছাড়ে ২০২০ সালে। এরপর থেকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া হয় দলটির।

১৯৯৬ সালের পর এককভাবে নির্বাচন করেনি জামায়াতে ইসলামী। ২০০১ সালে ৩১, ২০০৮ সালে ৩৮ এবং ২০১৮ সালে ২২টি আসনে বিএনপির সঙ্গে জোট করে ভোট করা জামায়াত বিএনপি ছাড়ে ২০২০ সালে। এরপর থেকে যুগপৎ আন্দোলনে থাকলেও গত বছরের ৫ আগস্টের পর বিএনপির সঙ্গে গাঁটছড়া হয় দলটির

দলের নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরে পাওয়া জামায়াতে ইসলামী এবার চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টায় রয়েছে। দলগুলোর সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আবদুল্লাহ তাহের বলেন, ‘এখনও অনেক সময় আছে। নানা সমীকরণ তো বিবেচনায় থাকে। সমঝোতা হলে জামায়াতের প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে সরে যাবেন।’

 

এ বিষয়ে দলটির নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘জামায়াতের নেতৃত্ব কাঠামো অন্য দলের মতো নয়। জামায়াত দেশ ও দলীয় স্বার্থে যাকে প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন চূড়ান্ত করবে, তিনিই নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন। শেষ মুহূর্তেও বদলাতে পারে আমাদের প্রার্থী তালিকা।’

dhakapost
এবার চরমোনাই পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দলের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার চেষ্টায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী / ছবি- সংগৃহীত

‘প্রার্থী মনোনয়নে অন্তর্ভুক্তিমূলক (ইনক্লুসিভ) ও জোটের চিন্তা আছে। এসব নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা ও বিভিন্ন সমমনা দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চলছে।’

যুগপৎ আন্দোলনে শরিক দল ছাড়াও আরও কিছু ছোট দলসহ বড় জোট গড়ার চেষ্টায় রয়েছে জামায়াতে ইসলামী— এমনও ইঙ্গিত দেন তিনি। তবে, কোন কোন দলের সঙ্গে জোটের পরিকল্পনা চলছে, সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানাননি।

শীর্ষ জামায়াত নেতারা যেখানে প্রার্থী হচ্ছেন

দলের আমির ডা. শফিকুর রহমান ঢাকা-১৫ আসন থেকে, নায়েবে আমির মুজিবুর রহমান রাজশাহী-১, ডা. তাহের কুমিল্লা-১১, এটিএম আজহারুল ইসলাম রংপুর-২, দলের সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনা-৫, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান সিরাজগঞ্জ-৪, হামিদুর রহমান আযাদ কক্সবাজার-২ আসন থেকে প্রার্থী হবেন।

 

সাবেক কেন্দ্রীয় নেতার পরিবারও আছে নির্বাচনী প্রচারণায়

অন্যদিকে, দলটির সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামীর ছেলে ব্যারিস্টার নাজিবুর রহমান মোমিন পাবনা-১, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ছোট ছেলে মাসুদ সাঈদী পিরোজপুর-১, আরেক ছেলে শামীম সাঈদী পিরোজপুর-২, মীর কাসেম আলীর ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন আরমান ঢাকা-১৪ আসন থেকে নির্বাচন করবেন বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।