
যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছে ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস ও ইসরাইল। মিশরের শারম আল শেখ সমুদ্র সৈকতের রিসোর্টে পরোক্ষ আলোচনার পর ‘প্রথম ধাপের’ চুক্তিতে রাজি হয়েছে এই দুই পক্ষ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প নিজেই এ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নিজের ট্রুথ সোশ্যালের এক পোস্টে এ কথা জানান প্রেসিডেন্ট। এ খবর পাওয়ার পর গাজার কোথাও কোথাও উল্লাস দেখা গেছে। এই আনন্দঘন খবরের মধ্যেও গাজাবাসীকে ঘিরে রেখেছে বেদনার গভীর এক সমুদ্র। দুই বছর ধরে চালানো ইসরাইলের নারকীয় তাণ্ডবে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে গোটা উপত্যকা। অন্যদিকে যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়েও শঙ্কা রয়ে গেছে। প্রস্তাবিত চুক্তিতে উল্লিখিত অস্ত্র সমর্পণের বিষয়ে না বলে দিয়েছে হামাস। অবিলম্বে উপত্যকা দখলমুক্ত করার দাবি জানিয়েছে তারা। যদিও ট্রাম্প জানিয়েছেন একটি নির্দিষ্ট সীমায় সৈন্যদের সরিয়ে নেবে ইসরাইল। এদিকে ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠকে যুদ্ধবিরতির অনুমতি পাওয়া গেলেই তারা তা কার্যকরে সই করবে। এমন পরিস্থিতিতে যুদ্ধবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে যে শঙ্কা তৈরি হয়েছে তা উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না।
আল জাজিরার এক খবরে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিরতির খবরে বিপুল উল্লাস প্রকাশ করেছে নারী-শিশুসহ গাজার সর্বস্তরের মানুষ। তবে তাদের মধ্যে বেদনাও দেখা গেছে। গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে বর্তমানে দেইর আল-বালায় বসবাসরত হানি আশকারি নিজের অনুভূতি প্রকাশ করে বলেন, এই অনুভূতির জন্য উপযুক্ত শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না। এর এক অংশ স্বস্তি, অন্য অংশ গভীর বেদনার। যেন কষ্টের সাগর। আশার একটি ঝলক দেখা দিয়েছে কিন্তু ক্লান্তি, ক্ষতি আর ভয় এখনো গভীরে গেঁথে আছে। ফিলিস্তিনি এই নারীর কণ্ঠে উঠে এসেছে ফিলিস্তিনিদের মিশ্র প্রতিক্রিয়া। যেখানে মানসিক যন্ত্রণা ও আনন্দ স্পষ্ট।
এদিকে বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক খবরে বলছে, চুক্তি সই হলেও তা বাস্তবায়নে বেশ কিছু জটিলতা রয়েছে। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানিয়েছে, নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভার বৈঠকে চুক্তিটি অনুমোদন পেলেই যুদ্ধবিরতি কার্যকর করবে তারা। সেই অনুমোদনের বিষয়টিও অনিশ্চিত (গতরাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত জানা যায়নি)। অন্যদিকে কার্যকরের সময়সীমা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে। যদিও বা মন্ত্রিসভায় অনুমতি পাওয়া যায়, কিন্তু এর কার্যকারিতা কতোক্ষণ স্থায়ী হবে তা নিয়ে শঙ্কা এড়ানো যায় না। এর আগে একাধিকবার চুক্তি লঙ্ঘন করে ফের গাজায় হামলা চালিয়েছে ইসরাইল। সাম্প্রতিক ইস্যুতে দেশটির এক সরকারি মুখপাত্র জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভার বৈঠকের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। এরপর ৭২ ঘণ্টার মধ্যে জিম্মিদের মুক্তি দেয়া হবে। যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে গাজা থেকে সৈন্য আংশিকভাবে প্রত্যাহার করা শুরু হবে। তবে এই প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ এবং যেকোনো মুহূর্তে তা ভেঙে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে হামাস জানিয়েছে, তারা অস্ত্র সমর্পণ করবে না। যুদ্ধবিরতি সংক্রান্ত ট্রাম্পের বৃহত্তর পরিকল্পনার অন্য ধাপগুলোতে হামাসের নিরস্ত্রীকরণ এবং গাজার শাসন ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার মতো শর্ত রয়েছে, যা নিয়ে উত্তেজনা বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে। যদিও ইসরাইল নিশ্চিত করেছে যে, হামাসের হাতে থাকা ২০ জন জীবিত জিম্মিকে মুক্তি দেয়া হবে। তবে ফিলিস্তিনি বন্দিদের মধ্যে অন্যতম পরিচিত মুখ মারওয়ান বারঘুতিকে মুক্তি দেয়া হবে না বলে জানিয়েছে ইসরাইল। এই বিষয়টি ফিলিস্তিনিদের মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করতে পারে।
গাজা থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার আহ্বান বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর: হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তির খবরকে গভীর স্বস্তির এক মুহূর্ত বলে অভিহিত করেছেন বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ের স্টারমার। পাশাপাশি তিনি অবিলম্বে গাজা থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন। প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেছেন, গাজা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। এই খবরকে স্বাগত জানাই। তিনি আরও বলেন, এটি গভীর স্বস্তির এক মুহূর্ত, যা সারা বিশ্বেই অনুভূত হবে। বিশেষ করে জিম্মিদের জন্য, তাদের পরিবারের জন্য এবং গাজার বেসামরিক জনগণের জন্য, যারা গত দুই বছর ধরে অকল্পনীয় কষ্ট সহ্য করেছে। কিয়ের স্টারমার বিবৃতিতে আরও বলেন- মিশর, কাতার, তুরস্ক এবং যুক্তরাষ্ট্রের অক্লান্ত কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমাদের আঞ্চলিক অংশীদারদের সহায়তায় এই গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ধাপটি নিশ্চিত করেছে। এখন এই চুক্তিটি সম্পূর্ণভাবে, বিলম্ব ছাড়াই বাস্তবায়ন করতে হবে। এর সঙ্গে গাজায় জীবনরক্ষাকারী মানবিক সহায়তার ওপর সব ধরনের নিষেধাজ্ঞা অবিলম্বে তুলে নিতে হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা সব পক্ষকে আহ্বান জানাচ্ছি তারা যেন তাদের করা প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করে। যুদ্ধের অবসান ঘটায়। একটি ন্যায়সঙ্গত ও স্থায়ী শান্তির ভিত্তি গড়ে তোলে, যা দীর্ঘমেয়াদে টেকসই হবে। বৃটেন এই গুরুত্বপূর্ণ তাৎক্ষণিক পদক্ষেপগুলো এবং শান্তি পরিকল্পনার পূর্ণ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে পরবর্তী পর্যায়ের আলোচনাকে সমর্থন করবে।
যেমন করে হলো গাজা শান্তিচুক্তি: হোয়াইট হাউসে মিটিং চলছিল। সেই মিটিং টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হচ্ছে। এর মাঝে বিঘ্ন ঘটালেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও। তিনি উঠে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের হাতে একটি ‘নোট’ দিলেন। কানের কাছে ফিসফিস করে বললেন, গাজা চুক্তি অত্যাসন্ন। এর কিছুক্ষণ পরেই নিজের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা দিলেন- ‘ব্লেসড আর দ্য পিসমেকারস!’ অর্থাৎ শান্তির প্রতিষ্ঠাকারীদের ওপর আশীর্বাদ বর্ষিত হোক। এই নাটকীয়তা যখন সাংবাদিকদের সামনে ঘটে তখন ওই কক্ষে বার্তা সংস্থা এএফপি’র সাংবাদিকসহ অন্য সাংবাদিকরা ছিলেন। সেখানে ট্রাম্পের প্রচেষ্টা তাদের চোখের আড়ালেই ঘটে যায়। এসময়েই শান্তিচুক্তি করতে অনীহা জানানো বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ওপর তিনি চাপ বাড়ান। তার সঙ্গে আরবদের সমর্থন পেয়ে যান। এমনি করেই হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে শান্তিচুক্তি করতে ভূমিকা রাখেন ট্রাম্প।