
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকেই বিশ্বের মনোযোগ মূলত গাজার দিকে নিবদ্ধ। সেদিন দক্ষিণ ইসরাইলে হামাস-নেতৃত্বাধীন হামলায় প্রায় ১,২০০ জন নিহত হন, যাদের বেশিরভাগই ইসরাইলি। এর পরই গাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ইসরাইল। গত দুই বছরের ইসরাইলি হামলায় অবরুদ্ধ উপত্যকায় ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে।
কিন্তু একই সময়ে অনেক কমই আলোচিত হয়েছে ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি অধ্যুষিত পশ্চিম তীর—যে ভূখণ্ডটি ১৯৬৭ সাল থেকে ইসরাইল দখল করে রেখেছে। অথচ ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে এবং তারপরেও পশ্চিম তীরে গুরুত্বপূর্ণ অনেক ঘটনা ঘটে গেছে।
গত দুই বছরে পশ্চিম তীরে ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের হামলা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। জাতিসংঘের মানবিক সমন্বয় দপ্তর (ওসিএইচএ) জানাচ্ছে, শুধু চলতি বছরেই এখন পর্যন্ত ইসরাইলি সেনারা পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি শহর ও গ্রামে প্রায় ৭,৫০০ বার অভিযান চালিয়েছে।
পশ্চিম তীরে আসলে কী কী ঘটছে- মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে তার সারসংক্ষেপ তুলে ধরেছে লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট আই।
পশ্চিম তীর কোথায়?
পশ্চিম তীর হলো ৫,৬৬৫ বর্গকিলোমিটার আয়তনের একটি স্থলবেষ্টিত এলাকা, যা জর্ডান নদীর পশ্চিমে এবং ইসরাইলের পূর্ব পাশে অবস্থিত। এটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত গাজার আয়তনের চেয়ে প্রায় ১৫ গুণ বড়। প্রায় ৩০ লাখ ফিলিস্তিনি এখানে বসবাস করে, যাদের মধ্যে ৯ লাখেরও বেশি শরণার্থী। অন্যদিকে ফিলিস্তিনিদের জায়গা-জমি ও বাড়িঘর দখল করে বাস করছে প্রায় ৭ লাখ ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারী।
যে কারণে প্রায় ১০ লাখ ফিলিস্তিনিকে থাকতে হচ্ছে ১৯টি শরণার্থী শিবিরে, যাদের বেশিরভাগই ১৯৪৮ সালের নাকবা ও পরবর্তী যুদ্ধে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনিদের বংশধর।
৭ অক্টোবরের আগে কেমন ছিল পশ্চিম তীর?
১৯৬৭ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধের পর ইসরাইল ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডগুলোর দখল নেয়। যার মধ্যে ছিল- পশ্চিম তীর, গাজা উপত্যকা ও পূর্ব জেরুজালেম।
১৯৯৩ সালের অসলো চুক্তি অনুযায়ী পশ্চিম তীরকে তিনটি এলাকায় ভাগ করা হয়:
এরিয়া এ (২১%): ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) পূর্ণ প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ। যেমন- রামাল্লাহ, নাবলুস ও জেনিন।
এরিয়া বি (১৮%): ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের আংশিক প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ। তবে নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ ইসরাইলের।
এরিয়া সি (৬১%): ইসরাইলের পূর্ণ প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণ। এতে সীমান্ত, বাইরের নিরাপত্তা, জেরুজালেম ও বসতিগুলো অন্তর্ভুক্ত।
বাস্তবে, ইসরাইল পুরো পশ্চিম তীরই নিয়ন্ত্রণ করে, তাদের সেনারা প্রায় অনিয়ন্ত্রিতভাবেই সবত্র অভিযান চালায়।
এ এলাকায় ৭ লাখেরও বেশি ইসরাইলি ১৫০টি বসতিতে বসবাস করছে। আরও প্রায় ২০০টি অবৈধ আউটপোস্ট রয়েছে।
যদিও এসব বসতিকে আন্তর্জাতিক আইনের পরিপন্থি অর্থাৎ অবৈধ বলে ২০২৪ সালে দেওয়া এক রায় দিয়েছে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত (আইসিজে)।
এদিকে, ফিলিস্তিনি শরণার্থী শিবিরগুলোতে অবস্থা ভয়াবহ। একে তো সেখানে অতিরিক্ত ভিড়, তার ওপর ভূমি ও ত্রাণ সহায়তার ওপর ইসরাইলি বিধিনিষেধ। যেমন- বালাতা শিবিরে মাত্র ২৫০ বর্গমিটার বা প্রায় ২৭০০ বর্গফুট জায়গার মধ্যে বসবাস করতে হচ্ছে ৩৩,০০০ ফিলিস্তিনিকে—যা লন্ডনের তুলনায় ৫০ গুণ ঘনবসতিপূর্ণ।

ফাতাহ নেতা মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (পিএ) পশ্চিম তীর শাসন করছে। তবে তিনি দীর্ঘ ২০ বছর ধরে (২০০৫ থেকে) সেখানে কোনো নির্বাচন না দেওয়ায় জনমনে ক্ষোভ জমেছে।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের আগে সেখানেও উত্তেজনা ছিল চরমে। এক বছরে ইসরাইলি সেনা ও বসতি স্থাপনকারীদের হাতে সেখানে ২৫৯ ফিলিস্তিনি নিহত হন। যা একই সময়ে গাজায় নিহতদের তুলনায় পাঁচ গুণ বেশি।
গাজার যুদ্ধের প্রভাব
পরে গাজার যুদ্ধ পশ্চিম তীরে ব্যাপক ক্ষোভ ও বিক্ষোভ উসকে দেয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ (ফাতাহ) সেই বিক্ষোভ দমন করে এবং কাতার-সমর্থিত সম্প্রচার মাধ্যম আল জাজিরাকে সেখানে নিষিদ্ধ করে।
এর মাঝেও ২০২৪ সালের জানুয়ারি ও ২০২৫ সালের এপ্রিলে পশ্চিম তীরে সাধারণ ধর্মঘট সংঘটিত হয়।
ইসরাইল অধিকৃত এবং ফাতাহ বা পিএ শাসিত (নামকাওয়াস্তে) পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের প্রতি সমর্থন প্রায়শ ওঠানামা করেছে। যদিও এখনো সেখানে ফাতাহর চেয়ে বেশি জনপ্রিয় হামাস। পাশাপাশি জনগণের বড় একটা অংশই আব্বাসের পদত্যাগ চায়।
৭ অক্টোবরের পর ইসরাইলি পদক্ষেপ
দখলদার ইসরাইল ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর পশ্চিম তীরে সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়েছে।সেই সঙ্গে শরণার্থী শিবিরগুলোতেও সবচেয়ে বেশি অভিযান চালিয়ে আসছে। যার ফলে ২০২৩ সালে পশ্চিম তীরে নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা ২০০৫ সালের পর সর্বোচ্চ ছিল।
মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, পশ্চিম তীরে নির্বিচারে বেসামরিক হত্যা ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর নির্যাতন বেড়েছে।

২০২৫ সালের শুরুতে ‘অপারেশন আয়রন ওয়াল’-এর আওতায় ইসরাইল জেনিন, তুলকারেমসহ একাধিক শিবিরে ট্যাংক ও বিমান নিয়ে হামলা চালায়। এতে আরও ৪০,০০০ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৩২,০০০ মানুষ এখনো গৃহহীন।
বসতি স্থাপনকারীদের সহিংসতা
এদিকে, ২০২৪ সালে ওসিএইচএ ১,৪০০টি সহিংসতার ঘটনা রেকর্ড করেছে —যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।একই বছরে ৪,৭০০ বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনির মধ্যে ১২% বাস্তুচ্যুত হয় সরাসরি বসতি স্থাপনকারীদের কারণে।
২০২৫ সালেও সহিংসতা অব্যাহত। কেবল এ বছরেই ১,০০০টিরও বেশি হামলা ও ১,৩৯৫টি ফিলিস্তিনি বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে।
কিছু ঘটনায় ফিলিস্তিনিদের বাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া, পশু হত্যা বা চুরি, পরিবার উচ্ছেদ করা হয়েছে—কিন্তু ইসরাইলি কর্তৃপক্ষ কার্যত সহযোগিতা করেছে বসতি স্থাপনকারীদের।
নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে ২০২৫ সালের ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম তীরে ৯৯৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে শিশুর সংখ্যা ২১২।
শুধু ২০২৫ সালেই নিহত হয়েছে ৩৯ শিশুসহ ১৯০ জন।
ই-১ পরিকল্পনা ও পশ্চিম তীর

এদিকে ২০২৫ সালের আগস্টে ‘ই-১ সেটেলমেন্ট প্লান’ অনুমোদন দিয়েছে ইসরাইল। যে পরিকল্পনার আওতায় পূর্ব জেরুজালেমকে বসতি ম’আলে আদুমিমের সঙ্গে যুক্ত করে ৩,৪০০টির বেশি নতুন আবাসন নির্মাণ করা হবে।
জাতিসংঘ জানিয়েছে, এটি দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের জন্য মারাত্মক হুমকি।
ইসরাইলের কট্টরপন্থি মন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচ বলেছেন, ‘ই-১ পরিকল্পনা অনুমোদন মানে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র ধারণার সমাধি।’ তিনি প্রস্তাব করেছেন, পশ্চিম তীরের ৮২% ভূমি সরাসরি ইসরাইলের সঙ্গে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
আরব লীগ ও মুসলিম দেশগুলো অবশ্য এই প্রস্তাবের নিন্দা জানিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবও বলেছেন, ইসরাইলি বসতি স্থাপন আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘন।
মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল বলেছে, ‘ই-১ পরিকল্পনা হলো আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের প্রকাশ্য লঙ্ঘন।’
পাশাপাশি জাতিসংঘ মানবাধিকার দপ্তর ১১টি দেশের ১৫৮টি কোম্পানির নাম প্রকাশ করেছে, যারা এসব অবৈধ বসতি স্থাপনে সহযোগীতা করছে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান
এদিকে ট্রাম্প প্রশাসন ইসরাইলি বসতি স্থাপনকারীদের ওপর বাইডেন আমলের নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছে।
মার্কিন রাষ্ট্রদূত মাইক হাকাবি তো আগ বাড়িয়ে বলেছেন, ‘পশ্চিম তীর বলে কিছুই নেই, এটি মূলত জুডিয়া ও সামারিয়া’।
জুডিয়া ও সামেরিয়া হলো প্রাচীন নাম, যা আধুনিক পশ্চিম তীরকে নিয়ে গঠিত দুটি অঞ্চল ছিল।
প্রাচীনকালে, জুডিয়া ছিল যিহূদা রাজ্যের অংশ এবং সামেরিয়া ছিল ইসরাইল রাজ্যের অংশ। উভয় রাজ্যই আবার প্রায় ৩,০০০ বছর আগে একই সঙ্গে বিদ্যমান ছিল।
আর প্যালেস্টাইন হলো সেই নাম যা রোমানরা কেবল জুডিয়া এবং সামেরিয়া নয়, বরং আধুনিক কালের সমগ্র ইসরাইল এবং ফিলিস্তিনকে দিয়েছিল। এই নামটি ফিলিস্তিনিদের উপর ভিত্তি করে রাখা হয়েছিল, যারা ছিল প্রাথমিক গোষ্ঠী যাদের সঙ্গে ইসরাইল তার গঠনমূলক পর্যায়ে ওই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য লড়াই করে আসছিল।
যাইহোক, তবে ট্রাম্প সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘে বলেছেন, তিনি পশ্চিম তীরের (ইসরাইলে) সংযুক্তিকরণ অনুমোদন দেবেন না।
যদিও পশ্চিম তীরে গত দুই বছরে নজিরবিহীন সহিংসতা ও দখলদারিত্ব বেড়েছে। বসতি স্থাপনকারীদের হামলা, ইসরাইলি সামরিক অভিযান ও ই-১ পরিকল্পনা কার্যত একটি পূর্ণাঙ্গ সংযুক্তিকরণ (দখলিকরণ)–এর পথে এগোচ্ছে।
জাতিসংঘ, মানবাধিকার সংগঠন ও আরব রাষ্ট্রগুলো এর বিরোধিতা করলেও বাস্তবে ফিলিস্তিনি জনগণের জীবন প্রতিদিন আরও অনিরাপদ ও অসহনীয় হয়ে উঠছে।