
সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে, যেখানে দেখা যায় দুজন লোক একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে জোরপূর্বক চুল, দাঁড়ি কেটে দিচ্ছে। এক পর্যায়ে বৃদ্ধ লোকটি হাল ছেড়ে দিয়ে বলছেন ‘আল্লাহ তুই দেহিস’।
ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হলে সেখানে এই ঘটনায় লোকজনকে পক্ষে-বিপক্ষে মন্তব্য করতে দেখা যায়। যাতে অনেকে বলছেন, সাধু সন্ন্যাসীদের ওপর এমন হামলার বিচার হওয়া উচিত, আবার অনেকে বলছেন এটা মানবিক কাজের একটা অংশ।
ভিডিওতে যা দেখা গেছে : ভিডিওতে দেখা যায়, একটি গ্রামের বাজারে দুজন ব্যক্তি একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে এবং এক পর্যায়ে জোরপূর্বক তার চুল ও দাঁড়ি কেটে দিচ্ছে। যে দুই ব্যক্তি বৃদ্ধ লোকের চুল, দাঁড়ি কেটে দিচ্ছিলেন, তাদের পরনে পাঞ্জাবি এবং মাথায় পাগড়ি ছিল। এ ছাড়া একটি ভেস্ট পরা ছিল যাতে একটি প্রতিষ্ঠানের লোগোও দেখা যাচ্ছিল। তারা জোর করে ওই বৃদ্ধকে এক জায়গায় বসিয়ে ‘ট্রিমার’ বা চুল, দাড়ি কাটার মেশিন দিয়ে তার মাথায় চুল কাটতে থাকে।
কোথায়, কিভাবে ঘটেছে এই ঘটনা : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই ঘটনাটি ঘটেছে প্রায় চার মাস আগে ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কাশিগঞ্জ বাজারে। যে বৃদ্ধের চুল, দাঁড়ি কেটে দেওয়া হয়, তার নাম হালিম উদ্দিন আকন্দ এবং তিনি প্রায় ৩৪ বছর ধরে এমন লম্বা চুল, দাঁড়ি রাখেন। তিনি কাশিগঞ্জের কোদালিয়া এলাকার আপনপাড়ার বাসিন্দা।
হালিম উদ্দিন আকন্দ স্থানীয়ভাবে বেশ পরিচিত এবং সারাদিন সন্ন্যাসীর বেশে এলাকায় ঘুরে বেড়ান, নানানধরনের তাবিজ-কবজ, জরিবুটির ওষুধ দেওয়া ও ঝাড়ফুঁক করেন।
হালিম উদ্দিনের বড় ছেলে জানান, মাসচারেক আগে একদিন কয়েকজন লোক আসেন আলিম উদ্দিনকে খুঁজতে। জানান তারা হালিম উদ্দিনের কাছ থেকে ঝাড়ফুঁকের চিকিৎসা করাতে এসেছেন।
হালিম উদ্দিনের ছেলে বলেন, ‘মোটরসাইকেল দিয়ে আসছে বিকেল টাইমে, বলে চাচা তারা আফনারে খুঁজতাছে যে তারার রোগী আছে, আফনে গিয়ে তারার রোগীটি ঝাইড়া দেওন লাগব, বাপে কইছে বাবা আমি অহন বাড়ি আইয়া পড়ছি, আজ রোগী ঝাড়তাম যাইতাম না, কালকে দেমানে।’
হালিম উদ্দিনের এই কথা শুনে মোটরসাইকেলে করে আসা লোকজন বলে তাহলে কাল একটু সকাল সকাল ঘর থেকে বের হইয়েন।
ভুক্তভোগী হালিম উদ্দিন আকন্দ যা বলেছেন
সকালে রোগী ঝাড়ফুঁক করতে লালমা গ্রামে যাওয়ার উদ্দেশে বের হয়ে প্রথমেই স্থানীয় কাশিগঞ্জ বাজারে যান হালিম উদ্দিন আকন্দ। সেখানে একটি পরিচিত দোকানে বসে ধূমপান করেন। দোকান থেকে বের হওয়ার পর কোদালিয়া গ্রামের একজন লোক তাকে অনুসরণ করতে থাকে এবং মোবাইলে অন্য আরেকজনকে কল দেয়।
কিছু দূর আগানোর পর কয়েকজন হালিম উদ্দিন আকন্দের পথ রোধ করে এবং টানাহেঁচড়া করতে থাকে। পরে কয়েকজন লোক মিলে জোর করে চুল কেটে দেয় এবং দাড়ি কেটে ছোট করে দেয়।
হালিম উদ্দিন আকন্দ বলেন, ‘চৌত্রিশ বছর হইছে চুলটা, সিলেট শাহজালালে গেছিলাম, ওখান থেকে আইয়া চুলে অতোখানি জট হইছে। ঠ্যাঙের লামাত গেছিল-গা জট, জট ফালাইয়া দিয়া অহন আমার সমস্যা, আমি অখন ঘরত থেকা বাইর হইতে পারিনা।’
জটা চুল, দাড়ি কেটে ফেলার পর অস্বস্তিতে ভুগছেন বলে জানান হালিম উদ্দিন। তাই এখন আর ঘর থেকে খুব একটা বের হন না, বাজারেও যান না।
চুল, দাঁড়ি কাটার ঘটনা যখন ঘটছিল, তখন কাশিগঞ্জ বাজারে স্থানীয় লোকজনও ছিলেন। তাদের একজন হাসিব আহমেদ জুয়েল। তিনি বলেন, মোট তিন-চার জন লোক মিলে জোরপূর্বক হালিম উদ্দিনের চুল কাটেন। এর মধ্যে একজন ভিডিও করার দায়িত্বে ছিলেন। আর বাকিরা হালিম উদ্দিনকে সামাল দিচ্ছিলেন।
হাসিব আহমেদ জুয়েল বলেন, ‘আমরা ইউটিউব, ফেসবুকে দেখেছি, এই রকম পাগল, অসুস্থ লোকজনকে মানবিক লোকজন চুল, দাড়ি কেটে দেয়, গোসল করিয়ে দেয়। কিন্তু উনি তো ওই রকম কেউ না।’
ভিডিওর বিভিন্ন খুঁটিনাটি দেখে অনুসন্ধানে কারা হালিম উদ্দিন আকন্দের চুল কাটার ঘটনার সাথে জড়িত এবং কেন তারা এই কাজ করল তা জানা যায়।
পরে দেখা যায় ফেসবুক ভিত্তিক হিউম্যান সার্ভিস বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠনের লোকজন হালিম উদ্দিন আকন্দের চুল, দাড়ি কেটে দেয়। হিউম্যানিটি ফার্স্ট বিডি নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলও আছে তাদের।
যেখানে বিভিন্ন সময় জোর করে রাস্তাঘাটে অসুস্থ ও অপ্রকৃতিস্থ লোকজনের চুল দাঁড়ি কেটে, তাদের গোসল করিয়ে পরিষ্কার জামা কাপড় পরানো হচ্ছে এমন ভিডিও আছে।
সংগঠনটি ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে পরিচালিত হয় এবং ২০২৪ সালের শেষের দিকে তারা কার্যক্রম শুরু করে। সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতাদের একজন মুফতি সোহরাব হোসেন আশরাফি।
তিনি জানান, মূলত মানবিক কার্যক্রমের অংশ হিসেবে বিভিন্ন জেলায় গিয়ে অসুস্থ ও অপ্রকৃতিস্থ লোকজনকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করেন। এটাকে তারা সেবা হিসেবেই দেখেন। কিন্তু জোর করে এই কাজ করার উচিত কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘তারা জোরপূর্বক কারো চুল, দাড়ি কাটেন না।’
তবে তাদের অনেক ভিডিওতে জোর জবরদস্তি করে লোকজনের চুল, দাড়ি কাটা ও গোসল করাতে দেখা গেছে। হালিম উদ্দিন আকন্দের ক্ষেত্রেও দেখা গেছে, সোহরাব হোসেন আশরাফি ও তার সঙ্গী জোর করে চুল, দাড়ি কাটছেন, এক পর্যায়ে তাদের থামাতে না পেরে হালিম উদ্দিন আকন্দকে বলতে শোনা যায়- ‘আল্লাহ তুই দেহিস’।
সোহরাব বলেন, ঢাকার মোহাম্মদপুর থেকে কাশিগঞ্জ গিয়ে তারা হালিম উদ্দিনের চুল, দাঁড়ি কেটে দিয়ে আসেন। স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী তাদের এই কাজ করতে যেতে বলেছেন বলে জানান তিনি। ‘আমাদেরকে ফোন দিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে এবং যারা ফোন দিয়েছেন তারা উনার (হালিম উদ্দিন আকন্দ)-এর আত্মীয়-স্বজন। একজন ব্যবসায়ী বলেছেন, উনি আমার চাচা হন, উনি সামনে দিয়ে গেলে আমাদের খারাপ লাগে। অনেকদিন ধরে উনাকে পরিষ্কার করার চেষ্টা করছি, পারিনি। পরে আমরা তাদের একটা সময় দিই।’
মূলত স্থানীয়দের ডাকে সাড়া দিতে মানবিক কাজের অংশ হিসেবে তারা কাশিগঞ্জ গিয়েছেন বলে দাবি করেন মুফতি সোহরাব হোসেন আশরাফি। হালিম উদ্দিনের ছেলের দাবি, তারা কাউকে তার বাবার চুল, দাড়ি কাটতে আসতে বলেননি। তবে স্থানীয় কেউ এতে জড়িত থাকতে পারে।
এদিকে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া আরো ভিডিওতে দেখা যায়, লম্বা ও জটা চুল, দাড়িওয়ালা লোকদের চুল, দাড়ি কেটে দেওয়া হচ্ছে। যাদের অনেকে অপ্রকৃতিস্থ বা অসুস্থ আবার অনেকে বিভিন্ন ত্বরিকা ও মতবাদের বিশ্বাসী। তাই কারো ইচ্ছার বিরুদ্ধে চুল, দাঁড়ি কেটে দেওয়া এবং তা সামাজিক মাধ্যমে প্রচার কতটুকু আইনসিদ্ধ, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
এদিকে, এক বিবৃতিতে আইন ও সালিশ কেন্দ্র বলেছে, বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩১ প্রতিটি নাগরিককে আইনের আশ্রয়ে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের অধিকার দিয়েছে। অনুচ্ছেদ-৩১ জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতার নিশ্চয়তা প্রদান করেছে এবং অনুচ্ছেদ ৩৫ কারো প্রতি নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ নিষিদ্ধ করেছে। প্রকাশ্যে জোর করে চুল কেটে দেওয়া কেবল ভুক্তভোগীর মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তিস্বাধীনতার লঙ্ঘন নয়, বরং তার মর্যাদার ওপর সরাসরি আঘাত।