Image description

কাতারে হামাস নেতাদের ওপর ইসরায়েলের হামলার পর সোমবার দেশটির রাজধানী দোহায় আরব ও মুসলিম দেশগুলোর শীর্ষ নেতারা এক জরুরি শীর্ষ সম্মেলনে বসেন। সম্মেলন শেষে তাঁরা ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানান।

আরব লীগ ও ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) এই যৌথ বৈঠকে প্রায় ৬০টি দেশ অংশ নেয়। গত মঙ্গলবার (৯ সেপ্টেম্বর) যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত নতুন যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব নিয়ে দোহায় হামাস নেতাদের বৈঠক চলাকালে বিমান ও ড্রোন হামলা চালায় ইসরায়েল।

হামাস জানিয়েছে, হামলায় তাদের পাঁচ সদস্য ও কাতারের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। কিন্তু ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সংগঠনটির শীর্ষ কোনো নেতা নিহত হননি। এই হামলার প্রতিক্রিয়ায় সোমবার জরুরি সম্মেলনটির আহ্বান করেছিল কাতার।

সম্মেলন শেষে এক যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের চলমান কার্যক্রম রোধে সব ধরনের আইনি ও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে (বৈঠকে অংশগ্রহণকারী) সব দেশের প্রতি আহ্বান জানানো হচ্ছে।’ এসব কার্যক্রম হতে পারে, ‘ইসরায়েলের সঙ্গে কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক পুনর্বিবেচনা করা এবং দেশটির বিরুদ্ধে আইনি প্রক্রিয়া শুরু করা।’

কাতারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ উপসাগরীয় দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) ও বাহরাইনসহ জর্ডান, মিসর এবং মরক্কো এরই মধ্যে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব দেশও গতকালের সম্মেলনে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এর মধ্যে ইউএই, বাহরাইন এবং মরক্কোর শীর্ষ নেতারা সম্মেলনে অংশ নেননি।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবি (বাঁয়ে) ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। জেরুজালেমে, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
যৌথ সংবাদ সম্মেলনে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবি (বাঁয়ে) ও ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। জেরুজালেমে, ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছবি: রয়টার্স

এই পাঁচটি দেশের মধ্যে মিসর ও জর্ডান আগেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। বাকি তিনটি দেশ পাঁচ বছর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় হওয়া ‘আব্রাহাম চুক্তি’র মাধ্যমে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়। গতকালের সম্মেলনে এসব দেশের নেতারা অংশ না নিয়ে ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি পাঠিয়েছে।

বিবৃতিতে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানানো হয়, তারা যেন সংস্থাটির সদস্যপদ স্থগিত করতে সমন্বিত পদক্ষেপ নেয়।

এদিকে ইসরায়েল সফরে থাকা মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও আজ মঙ্গলবার কাতার সফরে যাচ্ছেন। গতকাল জেরুজালেমে রুবিও বলেন, ইসরায়েলের ‘হামাস নির্মূলের লক্ষ্য’ পূরণে যুক্তরাষ্ট্রের ‘দৃঢ় সমর্থন’ অব্যাহত থাকবে।

দোহায় ইসরায়েলের হামলার পর উপসাগরীয় অঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ মিত্রদের সঙ্গে ওয়াশিংটনের টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে। এতে ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা নিশ্চয়তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। অঞ্চলটিতে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনা রয়েছে। অঞ্চলটির বৃহত্তম সামরিক ঘাঁটি অবস্থিত কাতারে।

মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের ভাষ্যমতে, গত সপ্তাহের হামলার পর রুবিও কাতারে গিয়ে দেশটির নিরাপত্তা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করবেন।

গাজা নিয়ে চাপ বাড়ছে

জ্বালানি তেল ও গ্যাসসমৃদ্ধ ধনী দেশ কাতার সাধারণত শান্তিপূর্ণ হিসেবে পরিচিত। ওয়াশিংটনের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কও বেশ ভালো। তা ছাড়া গাজা যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টায় মিসরের পাশাপাশি দেশটিও শুরু থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছিল। তাই দেশটিতে ইসরায়েলের হামলার সবাইকে অবাক করেছে। হামলার পর ‘সমন্বিত আঞ্চলিক প্রতিক্রিয়ার’ কথা জানিয়েছে কাতার।

সোমবারের জরুরি সম্মেলনের লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের ওপর চাপ বাড়ানো। তবে গাজায় হত্যাকাণ্ড ও মানবিক সংকট সৃষ্টির দায়ে দেশটির ওপর এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে।

কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির অভিযোগ, দোহায় (৯ সেপ্টেম্বর) আলোচনায় বসা হামাস নেতাদের লক্ষ্য করে হামলা চালিয়ে ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির প্রচেষ্টা নস্যাৎ করতে চাইছে। যুদ্ধবিরতি প্রচেষ্টায় তাঁর দেশ অন্যতম প্রধান মধ্যস্থতাকারী বলেও উল্লেখ করেন তিনি।

সম্মেলনে কাতারের আমির বলেন, ‘যাঁর সঙ্গে আলোচনা চলছে, তাঁকেই যদি পদ্ধতিগতভাবে হত্যার চেষ্টা করা হয়, তাহলে এর মানে স্পষ্ট। ধরে নিতে হবে, আলোচনা ভেস্তে দেওয়ারই চেষ্টা চলছে।’

ইসরায়েলের বিমান হামলায় ধসে পড়া গাজা নগরীর আল-গেফারি টাওয়ার থেকে ধোয়া উঠতে দেখা যাচ্ছে। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫
ইসরায়েলের বিমান হামলায় ধসে পড়া গাজা নগরীর আল-গেফারি টাওয়ার থেকে ধোয়া উঠতে দেখা যাচ্ছে। ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৫ছবি: রয়টার্স

সোমবারের সম্মেলনে সৌদি আরবের ডি-ফ্যাক্টো (কার্যত) শাসক যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান, ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ শিয়া আল-সুদানি, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান এবং ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস প্রমুখ অংশ নেন।

ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান বলেন, ‘আগামীকাল যেকোনো আরব বা ইসলামি রাজধানী শহরকেও একইভাবে নিশানা করা হতে পারে।’ গত জুন মাসে ইসরায়েলের সঙ্গে ১২ দিনের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল ইরান। একটা পর্যায়ে ইসরায়েলের হয়ে যুক্তরাষ্ট্রও যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। হামলা চালিয়েছিল ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায়। এর জবাবে কাতারে অবস্থিত মার্কিন ঘাঁটিতে হামলা চালিয়েছিল ইরান।

পেজেশকিয়ান আরও বলেন, ‘পথ একটাই-আমাদের এক হতে হবে।’

ইসরায়েলকে আরব দেশগুলোর মধ্যে সবার আগে স্বীকৃতি দিয়েছিল মিসর। সোমবারের সম্মেলনে দেশটির প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি সতর্ক করে বলেন, কাতারে এই হামলা ‘যেকোনো নতুন শান্তিচুক্তির সুযোগকে বাধাগ্রস্ত করছে। এমনকি এরই মধ্যে হওয়া শান্তিচুক্তিগুলোও ভেস্তে দিতে পারে।’

২০২০ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রশাসন আরব দেশগুলোর সঙ্গে ইসরায়েলের সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য আব্রাহাম চুক্তি শুরু করেছিল। উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে ইউএই ও বাহরাইনের পর এখন পর্যন্ত আর কোনো দেশ এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেনি। তবে সৌদি আরবসহ আরও কিছু দেশের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রয়েছে। ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র চুক্তির সদস্য দেশের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে জোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

সম্মেলনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের অভিযোগ, ইসরায়েল ‘সন্ত্রাসী মানসিকতা’ নিয়ে এগোচ্ছে। অন্যদিকে সম্মেলনে অংশ গ্রহণকারী দেশগুলো গাজা প্রসঙ্গে ইসরায়েলের তীব্র সমালোচনা করেছে।

সম্মেলনের ফাঁকে উপসাগরীয় ধনী দেশগুলো বৈঠক করে। বৈঠক শেষে উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) মহাসচিব জাসেম মোহাম্মদ আল-বুদাইউই সাংবাদিকদের বলেন, ইসরায়েলের লাগাম টেনে ধরতে যুক্তরাষ্ট্রকে নিজের ‘প্রভাব ও ক্ষমতা’ কাজে লাগাতে আহ্বান জানিয়েছে দেশগুলো।