Image description

রাজনৈতিক দল ও বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দফায় দফায় বৈঠক আর আলোচনার পরও জুলাই জাতীয় সনদের কোনো সুরাহা হচ্ছে না। মূলত প্রণয়নের চেয়ে সনদ কার্যকরের পদ্ধতি নিয়েই জটিলতা বেশি। সেইসঙ্গে আইনগত ভিত্তি দিয়ে জুলাই সনদের আলোকে আগামী সংসদ নির্বাচন এবং অতি জরুরি সংস্কারগুলো নির্বাচনের আগে বাস্তবায়ন ইস্যুতে দলগুলোর পরস্পরবিরোধী কঠোর অবস্থানের কারণে বহুল আলোচিত এই সনদ বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তা কাটছেই না। সংবিধান সম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে দলগুলোর তীব্র মতবিরোধ রয়েছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নানামুখী দ্বন্দ্বে আটকে আছে জুলাই সনদ। ঐকমত্য কমিশন বলছে, বল এখন রাজনৈতিক দলগুলোর কোর্টে। আবার রাজনীতিবিদরা বলছেন, সনদ ঘোষণা ও কার্যকরের দায়িত্ব ঐকমত্য কমিশন এবং সরকারের। গত রোববারও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠকে বসে ঐকমত্য কমিশন। সেদিন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস উপস্থিত থেকে বক্তব্য দেন। তবে ওই বৈঠক থেকেও চূড়ান্ত কোনো সমাধান আসেনি। তা ছাড়া আইনি ভিত্তি দিয়ে জুলাই সনদের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনসহ পিআর (আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব) পদ্ধতি বাস্তবায়নের দাবিতে ৩ দিনের অভিন্ন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে চারটি রাজনৈতিক দল। এ অবস্থায় অনেকের মনে প্রশ্ন উঠেছে যে, তাহলে কি জুলাই সনদ ঝুলে যাচ্ছে? তারা বলছেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশন অনেকগুলো সভা করলেও চূড়ান্ত ফল দিতে পারেনি। আগামীকাল বুধবার দলগুলোর সঙ্গে আবারও ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হওয়ার কথা রয়েছে।

ঐকমত্য কমিশনের এর আগের বৈঠকগুলোতে অংশ নেওয়া কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা হতাশা ব্যক্ত করে বলেন, কমিশন চেষ্টা করে যাচ্ছে। গত রোববারও দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক হয়েছে। সেখানে জাতির অভিভাবক হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা কোনো দিকনির্দেশনা দেবেন এবং সনদ সংক্রান্ত সংকটের শেষ হবে বলে প্রত্যাশা ছিল। কিন্তু তার বক্তব্যে তেমনটি প্রতিফলিত হয়নি বরং দলগুলোর ওপরই তিনি দায় চাপিয়েছেন, যা আশাহত করেছে। তবে তারা বিশ্বাস করেন, শেষমুহূর্তে হলেও বৃহত্তর স্বার্থে একটি সুষ্ঠু সমাধান আসবে। না হলে আগামী নির্বাচন নিয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে। অবশ্য আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে রোববারের বৈঠকে দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

 

জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে এমন অনিশ্চিত প্রেক্ষাপটের মধ্যে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ আবার বাড়ানো হয়েছে। গতকাল সোমবার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করে। যাতে কমিশনের মেয়াদ এক মাস বাড়িয়ে আগামী ১৫ অক্টোবর পর্যন্ত করা হয়েছে।

এর আগে গত ১২ আগস্ট জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মেয়াদ গতকাল (১৫ সেপ্টেম্বর) পর্যন্ত বাড়িয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছিল। সে অনুয়ায়ী গতকালই ছিল কমিশনের শেষ দিন। তারও আগে গত ১২ ফেব্রুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে সভাপতি করে সাত সদস্যের জাতীয় ঐকমত্য কমিশন গঠন করা হয়। অধ্যাপক আলী রীয়াজ এই কমিশনের সহসভাপতি ও সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রধান।

প্রস্তাবগুলো (ভিন্নমতসহ) চারভাবে বাস্তবায়নের পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এগুলো হচ্ছে অধ্যাদেশ, নির্বাহী আদেশ, গণভোট ও বিশেষ সাংবিধানিক আদেশ।

 

 

দলগুলোর অভিমত : বিএনপিসহ কিছু দলের অভিমত হলো- সংবিধান-সম্পর্কিত সংস্কার আগামী সংসদ ছাড়া বাস্তবায়নের কোনো আইনি পথ নেই। বরং দলটির মতে, সাংবিধানিক আদেশ জারি বা গণভোটের মতো প্রস্তাবগুলো অগ্রহণযোগ্য। এখনই এই সনদ কার্যকর হলে দেশে দুটি সংবিধান চলমান থাকবে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী, এনসিপিসহ বেশ কিছু দল চায় জুলাই সনদের একটি আইনি ভিত্তি এবং জাতীয় নির্বাচনের আগে এর বাস্তবায়ন।

 

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে জটিলতার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। দুদিন পরে টিকবে না, চ্যালেঞ্জ হয়ে যেতে পারে- এমন কোনো বিষয় আমরা রেখে যেতে চাই না।’

 

 

দুই-তিনটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছাড়া বাকিগুলো খুবই সাধারণ বিষয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এগুলো বাস্তবায়ন খুব সহজ; কিন্তু ফোরাম কোনটা? সাংবিধানিক বিষয়গুলো পরবর্তী সংসদ ছাড়া অন্য কোনো ফোরাম করতে পারে কি না? এ ব্যাপারে আইনি পরামর্শ দিতে পারে সুপ্রিম কোর্ট। আমরা সেখানে যেতে পারি এবং সহায়তা নিতে পারি। আমরা সনদে স্বাক্ষর করতে প্রস্তুত আছি, তা আগেও বলেছি। তবে কোনো আদালতে প্রশ্ন তোলা যাবে না, তেমন কোনো দলিল হতে পারে না, সংবিধানের ওপর সনদকে স্থান দেওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এর বাইরেও অনেক পন্থা থাকতে পারে যাতে আমরা এটার বৈধতা দিতে, আইনি ভিত্তি দিতে পারি। আপিল বিভাগের পরামর্শ নিতে পারি আমরা।’

 

 

সালাহউদ্দিন আহমদ আরও বলেন, ‘স্পেশাল কনস্টিটিউশনাল অর্ডারে আপনি করলেন। আমরা কেউ কিছু বললাম না। ঐকমত্য কমিশন থেকে আমরা আপনাকে দায়িত্ব দিলাম, সনদ বাস্তবায়নের ব্যাপারে আপনি সিদ্ধান্ত দেন। তারপর আপনি করলেন; কিন্তু যে কোনো একজন নাগরিক যদি এটা নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে কোথাও যায়, সেটা আপনার গ্লোবাল রিপোটেশন নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। আমরা অনেক আলোচনা করেছি, সেখান থেকে আপনি কোনো মতামত নিতে পারে। সেই স্বাধীনতা আপনার আছে।’

 

 

এ প্রসঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের কালবেলাকে বলেন, ‘এই কমিশন এতটাই শক্তিশালী যে, শেষ করতে গিয়েই করতে পারেনি। তাদের মেয়াদ ইতিমধ্যে একাধিকবার এক্সটেনশন হয়েছে, আবারও হবে। জুলাই সনদের বিরোধিতা হলো দুটি। একটি রাজনৈতিক আরেকটি আইনগত। এখন আইনগত বিষয়গুলো নিয়ে আর আলোচনা হচ্ছে না। বরং রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণেই আইনগত বিষয়টিতেও কিছুটা জটিলতা তৈরি করছে। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো একমত হলে অনেক কিছুই করতে পারে, এ ধরণের বাস্তবায়ন ও অনুমোদনের নজির আমাদের আছে। যেমন ৯১ সালে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন কেয়ারটেকার সরকারের প্রধান নির্বাচিত হয়েছিলেন, সেটাতো সংবিধানে ছিল না। যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো একমত ছিল সেজন্য এটা স্বাভাবিকভাবেই সবাই গ্রহণ করেছিল। তিনি তো ভালো নির্বাচন করেছিলেন। পরে তিনি আবার তার পেশায় ফিরে যান। এগুলো তো কোনোটাই সংবিধান এবং আইনের কোনো ধারায় ছিল না। অর্থাৎ সবকিছুই সম্ভব হয়েছে সব রাজনৈতিক দলগুলোর একমত হওয়ার মধ্যদিয়ে। দলগুলো একমত মানে জনগণ একমত; কিন্তু দুঃখজনভাবে আমরা সব দল এখন একমত হতে পারিনি। এ জন্যই কিছুটা জটিলতা তৈরি হয়েছে।’

 

 

এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন বলেন, ‘যেগুলো সংবিধানের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, সেগুলো এ সরকারের সময় থেকেই অর্ডিন্যান্স বা নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে; কিন্তু রাষ্ট্র কাঠামোর অনেক বিষয় নিয়ে আমরা কথা বলেছি যাতে সংবিধানের অনেক মৌলিক জায়গাতে পরিবর্তন আসবে। তবে আশঙ্কাও আছে। এনসিপি মনে করে গণপরিষদ নির্বাচনের মধ্য দিয়েই নতুন সংবিধানে নতুনভাবে লিখিত ধারা, উপধারা এবং অনুচ্ছেদের মধ্য দিয়ে আমরা যে সংশোধনী ও সংস্কারের বিষয়ে একমত হয়েছি সেগুলোকে টেকসই করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলোকে অবশ্যই ঐকমত্যের জায়গায় পৌঁছাতে হবে। এখনো সবকিছু শেষ হয়নি, দেখা যাক।’

বিশ্লেষকের পরামর্শ : শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পলিটিক্যাল স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. সাহাবুল হক কালবেলাকে বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে বাংলাদেশের জন্য একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক মাইলফলক, যদি এটিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সমঝোতার বাইরে নিয়ে গিয়ে আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে আবদ্ধ করা যায়। অন্যথায় এটি কেবল ইতিহাসের আরেকটি ব্যর্থ দলিলে পরিণত হবে। তাই এ মুহূর্তে দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ওপর দায়িত্ব পড়েছে কথায় নয়, কাজে দেখানোর, যাতে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রা আরেক ধাপ এগিয়ে যেতে পারে। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকেই কার্যকরের উপায় বের করতে হবে।’