Image description

কুয়েন্সেলের নিবন্ধ

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির বিশাল মঞ্চে টেকটোনিক পরিবর্তন ঘটছে। ঢাকা শহরের বর্ষামাখা রাস্তাগুলো থেকে শুরু করে কাঠমান্ডুর উঁচু উপত্যকা পর্যন্ত এক প্রজন্ম-নির্ধারণ করে দেয়া কম্পন অনুভূত হচ্ছে। এটি এক ‘যুব-ভূমিকম্প’ (ইয়ুথ আর্থকোয়েক)। এটা যুব প্রজন্মের ডিজিটালপ্রজন্ম নাগরিকদের চালিত এক ভূমিকম্পের মতো ঢেউ। এই যুব সমাজ আর স্থিতাবস্থায় সন্তুষ্ট নয়। ২০২৪ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন নাটকীয় গণআন্দোলন দেশটির রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আমূল বদলে দেয়। নেপালে চলমান সংস্কার আন্দোলনও কোনো বিচ্ছিন্ন ঝড় নয়। বরং এগুলো গভীর আঞ্চলিক রূপান্তরের ইঙ্গিত, যা হিমালয়ের ওপার থেকে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে প্রতিটি দেশের জন্য শিক্ষার বার্তা নিয়ে, আমাদের স্নেহের ড্রাগন কিংডম ভুটানসহ।

 

ভুটানের জন্য, যা তার স্থিতিশীলতা ও অনন্য উন্নয়ন দর্শনের জন্য পরিচিত, এসব ঘটনা আতঙ্কের কারণ নয়। বরং এগুলো আমাদের নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে যে নীতিগুলো মেনে এসেছে- আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার গুরুত্ব, তার শক্তিশালী স্বীকৃতি। মূল প্রশ্ন হলো, আমরা এসব অস্থিরতা থেকে মুক্ত কিনা তা নয়; বরং আমরা কি আমাদের প্রতিবেশী রাজধানীগুলোর রাস্তায় লেখা শিক্ষাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছি?

ঢাকার প্লাবন: ভেঙে যাওয়া আস্থার কেস স্টাডি
আঞ্চলিক পরিবর্তনের ব্যাপ্তি বুঝতে হলে প্রথমে তাকাতে হবে বাংলাদেশের দিকে। ২০২৪ সালের জুলাইয়ের ঘটনাগুলো দশক ধরে অধ্যয়ন করা হবে। যা শুরু হয় সরকারি চাকরিতে কোটা প্রথার বিরুদ্ধে ছাত্র প্রতিবাদ দিয়ে, তা অবিশ্বাস্য গতিতে রূপ নেয় দেশব্যাপী আন্দোলনে এবং শেষ পর্যন্ত দীর্ঘস্থায়ী হয় সরকারের পতনের আন্দোলনে। কোটার ইস্যু ছিল কেবল স্ফুলিঙ্গ; মূলত এটি ছিল এক প্রজন্মের ক্ষোভের বিস্ফোরণ- একটি ব্যবস্থা, যা তাদের কাছে অস্বচ্ছ, জবাবদিহিতাহীন ও অন্যায্য মনে হয়েছিল।

বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি, রাজনৈতিক দায়মুক্তি এবং ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে তরুণদের আকাঙ্ক্ষার ক্রমবর্ধমান বিচ্ছিন্নতার অভিযোগ জমে উঠছিল। ছাত্ররা কেবল চাকরি চাইছিল না; তারা চাইছিল সমান সুযোগ, যেখানে আইনের শাসন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। আন্দোলনের দ্রুত বিস্তার সম্ভব হয়েছিল ডিজিটাল টুলসের কারণে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম হয়ে উঠেছিল প্রতিবাদের স্নায়ুতন্ত্র, যা বাস্তব সময়ে সংগঠন ও গতিশীলতা তৈরি করেছিল। এ ঘটনা নতুন বাস্তবতা তুলে ধরল: আজকের দিনে সরকারের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হলো- ডিজিটালি সংযুক্ত তরুণদের আস্থা হারিয়ে ফেলা। ঢাকার শিক্ষা স্পষ্ট: সুশাসনের ভিত্তি যখন ভেঙে পড়ার মতো মনে হয়, তখন রাজনৈতিক ভূমিকম্প দ্রুত ও ভয়াবহ হয়ে উঠতে পারে।

কাঠমান্ডুর ঐকমত্য: স্থায়ী সংস্কারের আহ্বান
বাংলাদেশের ঘটনাগুলো ছিল আকস্মিক প্লাবন; আর কাঠমান্ডুর ফিসফিসানি হলো পরিবর্তনের দীর্ঘস্থায়ী স্রোত। ‘জেনারেশন জেড আন্দোলন’ কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধকরণের বিরুদ্ধে নয়; বরং এটি হলো এক বিপ্লবী আহ্বান। দশকের পর দশক ধরে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও দুর্নীতিতে অতিষ্ঠ তরুণ নেপালিরা এবার রাস্তায় নেমেছে স্পষ্ট বার্তা নিয়ে: তারা দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক চুক্তির মৌলিক পুনর্গঠন চায়।
তাদের ক্ষোভ কোনো একক নেতার বিরুদ্ধে নয়, বরং গোটা রাজনৈতিক সংস্কৃতির বিরুদ্ধে। তারা দায়মুক্তির অবসান, স্বজনপ্রীতির বদলে মেধাভিত্তিক ব্যবস্থা, স্বচ্ছ ও জবাবদিহিতাপূর্ণ সরকার দাবি করছে। এই আন্দোলন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়- গণতন্ত্র কেবল ভোট দেয়া নয়; বরং এটি প্রতিদিনের সুশাসনের চর্চা। তরুণরা গণতন্ত্র প্রত্যাখ্যান করছে না; তারা চাইছে এর একটি উন্নত সংস্করণ- যেখানে জনসেবা দায়িত্ব, ব্যক্তিগত স্বার্থলাভের সুযোগ নয়।

ভুটানের আয়না: আতঙ্ক নয়, আত্মপ্রত্যয়
ভুটানের জন্য সবচেয়ে সহজ, কিন্তু মারাত্মক ভ্রান্তি হবে আঞ্চলিক ঘটনাগুলোকে দূর থেকে উদাসীনভাবে দেখা। আমাদের রাজতন্ত্রের প্রজ্ঞায় পরিচালিত স্থিতিশীলতা পুরো অঞ্চলের ঈর্ষার বিষয়। আমাদের মোট জাতীয় সুখ দর্শন আমাদের জাতীয় সত্তায় সুশাসন, ন্যায় ও সাম্যের নীতিকে প্রোথিত করেছে।
তাই ঢাকার প্রতিধ্বনি ও কাঠমান্ডুর ফিসফিসানি আমাদের কাছে ধ্বংসের সতর্কবার্তা নয়; বরং এগুলো আমাদের বেছে নেওয়া পথের বহিঃস্বীকৃতি। এগুলো আয়নার মতো আমাদের অর্জনের মূল্য এবং এগুলো রক্ষা করার অপরিসীম গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে। প্রতিবেশী দেশগুলোর অস্থিরতা বাস্তব উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে- যখন ভুটানের লালিত নীতিগুলো ক্ষয়ে যায়, তখন কী ঘটে।

আত্মতুষ্টি কোনো বিকল্প নয়
আমাদের প্রজ্ঞা স্বীকার করা কেবল প্রথম ধাপ। আঞ্চলিক যুব-ভূমিকম্প থেকে প্রকৃত শিক্ষা হলো- সুশাসন কোনো চূড়ান্ত গন্তব্য নয়, বরং এক ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তাই বর্তমান সরকারসহ ভবিষ্যতের প্রতিটি সরকারকে সক্রিয়ভাবে শুনতে হবে।
প্রথমত, আমাদের নিজেদের তরুণদের কথা শুনতে হবে। চতুর্থ রাজা জিগমে সিংয়ে ওয়াংচুক একসময় বলেছিলেন: ‘দেশের ভবিষ্যৎ তরুণ প্রজন্মের হাতে।’ এই কথাটি আজও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দিশারী। ভুটানের তরুণরা আগের যেকোনো প্রজন্মের চেয়ে বেশি শিক্ষিত, বৈশ্বিকভাবে সচেতন এবং ডিজিটালি সংযুক্ত। আমাদের প্রতিষ্ঠানের প্রতি তাদের আস্থা-বিচার বিভাগ, সিভিল সার্ভিস, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া- ভুটানের দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের আকাক্সক্ষার সঙ্গে সক্রিয়ভাবে সংলাপ হচ্ছে।

আমাদের প্রশ্ন করতে হবে: সংলাপের চ্যানেলগুলো কি খোলা ও কার্যকর? তরুণরা কি মনে করে তাদের কণ্ঠস্বর শোনা হচ্ছে?
দ্বিতীয়ত, আমাদের মূল নীতিগুলো রক্ষা করা প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো সংস্থার প্রতি অক্লান্ত সমর্থন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও কার্যকারিতা নিশ্চিত করা অপরিহার্য। জবাবদিহিতা কোনো বিমূর্ত ধারণা নয়; এটি দৃশ্যমান হতে হবে। যখন আইন সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য হয়, তখন এটি স্পষ্ট বার্তা দেয় যে আইনের শাসন পরম। যখন সরকারের সিদ্ধান্ত স্বচ্ছ হয়, তখন এটি হতাশার বিরুদ্ধে এক শক্তিশালী প্রতিরক্ষা তৈরি করে।

তৃতীয়ত, ডিজিটাল যুগে স্বচ্ছতা আর ঐচ্ছিক নয়। তথ্য অবাধে প্রবাহিত হয়, নাগরিকদের কাছে নেতাদের খতিয়ে দেখার আরও বেশি উপায় আছে। অস্বচ্ছভাবে কাজ করার যে কোনো প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে। সরকারকে অবশ্যই নতুন বাস্তবতাকে আলিঙ্গন করতে হবে- নীতিমালা ব্যাখ্যা করে জানানো, সিদ্ধান্তের বিষয়ে খোলামেলা থাকা, চ্যালেঞ্জ স্বীকার করা। যে সরকার তার জনগণের সঙ্গে তথ্য ভাগ করে নেয়, সেই সরকারই আস্থা অর্জন করে।

উপসংহার
ঢাকা থেকে প্রতিধ্বনি ও কাঠমান্ডুর ফিসফিসানি হুমকি নয়, বরং এক গর্জন তোলা শিক্ষা। এগুলো স্মরণ করিয়ে দেয়- আইনের শাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা হলো দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বে জাতীয় স্থিতিশীলতার অপরিহার্য উপাদান। মনোযোগ দিয়ে শুনে, এই মূল্যবোধগুলোতে আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্নিশ্চিত করে এবং জনগণের- বিশেষ করে তরুণদের- আস্থা ক্রমাগত অর্জন করে ভুটান নিশ্চিত করতে পারে যে ‘যুব-ভূমিকম্প’ আমাদের কাছে গবেষণার বিষয় থাকবে, অভিজ্ঞতার নয়। আমাদের স্থায়ী শান্তি এর ওপরই নির্ভর করছে।

(লেখক: নামগে জাম (এলএলএম), ইউনেস্কো মাদঞ্জীত সিং সাউথ এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড লিগ্যাল অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস স্টাডিজ (ইউএমএসএআইএলএস), এশিয়া প্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা, বাংলাদেশ)