
দ্বিতীয় মেয়াদে যখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন, ভারতের শাসকগোষ্ঠী তখন খুশিই হয়েছিল। ট্রাম্পের দরবারে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হাজিরা এবং দুই জনের ঘনিষ্ঠ ছবি ইঙ্গিত দিচ্ছিল বিশ্বের রক্ষণশীল দুই গোষ্ঠীর নেতার মধ্যে উষ্ণ সম্পর্কের।
ক্ষমতায় আসার পর শুল্ককে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে ট্রাম্প যখন বৈশ্বিক বাণিজ্য ও ভূরাজনীতিকে নতুন করে তৈরির চেষ্টা শুরু করেন, তখনই ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য আলোচনায় যুক্ত হয়েছিল। নয়াদিল্লি সে সময় আলোচনায় বিরোধ স্বীকার করে নিয়েছিল, তারা নিজেদের কৃষি ও দুগ্ধ পণ্য রক্ষার বিষয়ে আপসহীনতার কথা জানিয়েছিল। তবে ভারত নিজের অর্থনৈতিক ভার এবং চীনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কৌশলগত সক্ষমতার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সহজ চুক্তিতে আসার প্রত্যাশা করেছিল।
কিন্তু ট্রাম্প প্রথমেই ভারতকে চপেটাঘাত করলেন। চলতি বছরের এপ্রিলে যখন সব দেশের বিরুদ্ধে শুল্কের ঘোষণা দেন তিনি, ভারতের ওপর তখন ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপিয়ে দেন। এটি ছিল যুক্তরাষ্ট্রের বেশিরভাগ মিত্রদের ওপর আরোপিত শুল্কের চেয়ে বেশি। বর্তমানে এ শুল্ক বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশ। ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসনের মধ্যে মস্ক থেকে জ্বালানি তেল কেনার শাস্তি হিসেবে এ অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।
ট্রাম্পের সঙ্গে মোদির বিশেষ সম্পর্কের দাবিকে এখন মশকরা করা হচ্ছে। শুধু শুল্কই নয়, চলতি বছর কাশ্মীরের পেহেলগামে হামলার ঘটনায় পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের চারদিনের যুদ্ধের জেরে ট্রাম্প প্রশাসন মনে করছে, দেশ দুটি দক্ষিণ এশিয়ার ঝগড়াটে প্রতিবেশী যাদেরকে জোর করে সুশৃঙ্খল রাখতে হবে। ট্রাম্প দাবি করে আসছেন, ভারত ও পাকিস্তানকে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য তিনি ফোন করে হুমকি দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারত এ দাবি অস্বীকার করায় শান্তিতে নোবেল পাওয়ার আকাঙ্ক্ষী ট্রাম্প এতে অপমানিত বোধ করেছেন।
ভারতের বিরুদ্ধে শুল্ককে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বলছেন ট্রাম্প। ভারতের অর্থনীতিকে ‘মৃত’ হিসেবে প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি। অপরদিকে তার প্রধান বাণিজ্য উপদেষ্টা পিটার নাভারু অভিযোগ করেন, ভারত রাশিয়ার তেল কেনার মাধ্যমে ইউক্রেনের যুদ্ধ থেকে ফায়দা লুটছে। ইউক্রেনের যুদ্ধকে তিনি ‘মোদির যুদ্ধ’ হিসেবেও উল্লেখ করেন।
এ পরিস্থিতি এক দশকের বেশি সময় ধরে মোদি নিজেকে বৈশ্বিক রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে গড়ার চেষ্টায় পানি ঢেলে দিয়েছে। মোদির বিশ্বের নেতাদের সঙ্গে গাঢ় আলিঙ্গন ও মাত্রাতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতার ছবি দেখেই সম্পর্ক নির্ণয় করা আনাড়ি কাজ হবে। একই সঙ্গে এ ধরনের ছবি ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে পরিবর্তন আনবে, এ ভাবনাও ভুল হবে।
তবে ভারতের মধ্যে বড় দেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব সহজেই কমে আসবে না। স্নায়ুযুদ্ধ সমকালীন ভারতের জোট নিরপেক্ষ নীতি মোদির ভারতে কোনো বিলাসী পরিভাষা নয়। মোদির পররাষ্ট্রনীতি বহু মেরুর বিশ্বে ভারতের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা রক্ষার চেষ্টা করছে। জোট নিরপেক্ষতা বর্তমানে হয়তো ‘কৌশলগত স্বশাসন’ নামে চলে আসছে, কিন্তু এর লক্ষ্য একই। রাশিয়ার তেল কিনে পরিশোধন করে তা আবার ইউরোপের কাছে বিক্রি বাইডেন প্রশাসনের সময় ভারতের জন্য এক নীরব আশীর্বাদ ছিল। সাম্প্রতিক সময় পর্যন্ত একে লড়াইরত দুই প্রতিপক্ষের সঙ্গে ভারতের কৌশলগত সম্পর্ক রাখতে পারার উদাহরণ হিসেবে বিবেচনা করা হতো।
চলতি শতকের প্রথম অংশে ভারতের রাজনৈতিক গোষ্ঠী যুক্তরাষ্ট্রকে দেশটির স্বাভাবিক মিত্র হিসেবে ভাবতে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছিল। ভারতের রপ্তানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য ছিল যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া শাসক গোষ্ঠীর সন্তানদের উচ্চাকাঙ্ক্ষী জীবনের গন্তব্যও ছিল এটি। মোদির পূর্বসূরি মনমোহন সিংয়ের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে ভারত। ওই সময় থেকেই চীনকে ঠেকানোর জন্য জাপান ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত কোয়াড গঠন করে।
যুক্তরাষ্ট্রের দিকে এ ঝুঁকে পড়া ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে বিস্ময়কর ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। যদিও তখন কৌশলগত স্বশাসনের ভিত্তিতে পররাষ্ট্রনীতি চলছিল, কিন্তু নয়াদিল্লি অনেকখানি ওয়াশিংটনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। মোদির অধীন ভারতের নীতিনির্ধারকরা মনে করেছিলেন, ভারতের সমষ্টিগত অর্থনৈতিক উন্নতি ও এর প্রবৃদ্ধি তাকে বিশ্বের আলোচনার টেবিলে নিয়ে এসেছে। কিন্তু আসল বিষয় হলো, ভারত এমন কোনো ধনী বা শ্বেতাঙ্গ বা ইংরেজিভাষী দেশ নয় যা তাকে পশ্চিমা বা ইংরেজিভাষী দেশের সমমানের মিত্রে পরিণত করবে।
মোদির কর্মকর্তারা হয়তো ভুলে গেছেন, পশ্চিমাদের মুগ্ধতার জগতের বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো মিত্র নেই। যারা রয়েছে, সবাই প্রকৃতপক্ষে তার মক্কেল। ভারতের ওপর ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের মাধ্যমে তিনি বার্তা দিয়েছেন যে, দেশটিকে তিনি হয় আবেদনকারী বা উপদ্রব অথবা উভয়ই মনে করছেন।