
একটি জলপাই-সবুজ রঙের ট্রেন। গায়ে সোনালি দাগ। বুলেটপ্রুফ দেওয়াল, রুপালি আসবাবপত্রের আড়ম্বর এবং সর্বোচ্চ নিরাপত্তার সঙ্গে সাজানো অভ্যন্তরীণ কক্ষ- সব মিলিয়ে এটি এক ‘চলন্ত দুর্গ’। আর সেই দুর্গে করেই চীনে পৌঁছালেন উত্তর কোরিয়ার সিংহ কিম জং উন। দেশে-বিদেশে সব সফরেই ট্রেনকেই বেছে নেন উত্তরের এই নেতা। শুধু কিম নন, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে তার পরিবার এই ট্রেনে ভ্রমণ করেছেন দেশজুড়ে। এমনকি আন্তর্জাতিক সফরেও। পাড়ি দিয়েছেন হাজার হাজার মাইল। কিম জং উনের বাবা কিম জং-ইল বিমান ভ্রমণে ভয় পেতেন। এজন্য বিদেশ সফরের জন্য তিনি বরাবরই বেছে নিতেন রেলপথকেই। একইভাবে ভ্রমণে ট্রেনেই আস্থা রাখেন কিম জং উনও। তবে মাত্র দুবার বিমানেও ভ্রমণ করেছেন কিম। রয়টার্স।
মঙ্গলবার চিরচেনা সবুজ রঙের ব্যক্তিগত ট্রেনে করে চীনের রাজধানী বেইজিংয়ে পৌঁছান কিম। সোমবার পিয়ংইয়ং থেকে রওয়ানা দেন তিনি। ধীরগতির হলেও বিশেষভাবে নকশা করা সাঁজোয়া ট্রেনটি কয়েক দশক ধরেই ব্যবহার করছেন উত্তর কোরিয়ার এ শাসক পরিবার। পুরোনো যাত্রীবাহী বিমানের তুলনায় এই বুলেটপ্রুফ ট্রেনকেই বেশি নিরাপদ ও আরামদায়ক বলে মনে করেন কিম পরিবার। এতে কিমের বিশাল সফরসঙ্গী, নিরাপত্তাকর্মী, খাবার ও অন্যান্য সুবিধার বন্দোবস্ত রয়েছে। এছাড়া আছে কোনো বৈঠকের আগে আলোচ্য বিষয় বা এজেন্ডা নিয়ে আলোচনার জায়গাও।
ট্রেনের ভেতরে কি আছে
কয়েক বছর ধরে উত্তর কোরিয়ার নেতারা ঠিক কতগুলো ট্রেন ব্যবহার করছেন তা স্পষ্ট নয়। তবে ২০১১ সালের শেষ দিকে দেশটির নেতৃত্ব গ্রহণ করার পর কিম তার ব্যক্তিগত ট্রেন ‘তেয়াং-হো’ (সূর্য)-তে করে চীন, ভিয়েতনাম ও রাশিয়া সফর করেন। ট্রেনটিতে ১০ থেকে ১৫টি কামরা রয়েছে। এর মধ্যে কিছু কামরা শুধু নেতার জন্য। অন্য কামরাগুলোতে থাকেন নিরাপত্তাকর্মী ও চিকিৎসাকর্মীরা। এছাড়া ট্রেনে কিমের অফিস, যোগাযোগ সরঞ্জাম, রেস্টুরেন্ট এবং দুটি সাঁজোয়া মার্সিডিজ গাড়ি রাখার ব্যবস্থাও রয়েছে। মঙ্গলবার উত্তর কোরিয়ার রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, কিম জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি সবুজ কামরার পাশে সিগারেট খাচ্ছেন। কামরাটির গায়ে সোনালি নকশা ও প্রতীক আঁকা। অন্য ছবিতে দেখা গেছে, কাঠের প্যানেল করা অফিসকক্ষে বড় সোনালি প্রতীকের সামনে বসে আছেন তিনি, পাশে উত্তর কোরিয়ার পতাকা। কিমের টেবিলে রাখা ছিল সোনালি অক্ষরে খোদাই করা ল্যাপটপ, কয়েকটি টেলিফোন, সিগারেটের বাক্স এবং নীল ও স্বচ্ছ তরলভর্তি বোতল। জানালায় ছিল নীল-সোনালি রঙের পর্দা।
সীমান্ত অতিক্রম করে কীভাবে
দক্ষিণ কোরিয়ার বিশেষজ্ঞ আন জানিয়েছেন, ২০২৩ সালে প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে বৈঠকের জন্য রাশিয়া সফরের সময় কিমের ট্রেনকে সীমান্ত স্টেশনে চাকা বদলাতে হয়েছিল। কারণ, রাশিয়া ও উত্তর কোরিয়ার রেললাইনের মাপ ভিন্ন। যদিও চীনের ক্ষেত্রে এমন দরকার হয় না। তবে সীমান্ত পার হওয়ার পর স্থানীয় রেল ব্যবস্থার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে ও সংকেত বোঝার সুবিধার্থে চীনের লোকোমোটিভ (ট্রেনের ইঞ্জিন) দিয়ে ট্রেন টানা হয়। চীনের নেটওয়ার্কে এই ট্রেন ঘণ্টায় ৮০ কিমি. (৫০ মাইল) গতিতে চলতে পারে। তবে উত্তর কোরিয়ার রেলপথের সর্বোচ্চ গতি ঘণ্টায় প্রায় ৪৫ কিমি. (২৮ মাইল)।
কারা ব্যবহার করেছেন এই ট্রেন
উত্তর কোরিয়ার প্রতিষ্ঠাতা নেতা কিম ইল-সুং (কিম জং উনের দাদা) ১৯৯৪ সালে মৃত্যুর আগপর্যন্ত নিয়মিত ট্রেনে করে বিদেশ সফর করতেন। কথিত আছে, বিমানে উঠতে ভয় পেতেন বলেই ট্রেনে ভ্রমণ করতেন কিম জং উনের বাবা কিম জং ইলও। রাশিয়া সফরেও শুধু ট্রেনই ব্যবহার করেছেন তিনি। ২০০১ সালে ২০ হাজার কিলোমিটার ভ্রমণ করে মস্কো যান কিম জং ইল। ২০১১ সালের শেষদিকে এক ট্রেনযাত্রার সময় হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি। কিম জং ইলের ব্যবহৃত সেই কামরা এখনো তার সমাধিক্ষেত্র হিসাবে প্রদর্শিত হচ্ছে। কিম জং ইলের সময়ে ট্রেনের জন্য ২০টি আলাদা স্টেশন নির্মিত হয়েছিল।