
বদলি নীতিমালা নিয়ে বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় ১৯ হাজার সদস্যের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। আগে ঢাকার বাইরে প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে বদলি করতে পারত মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা (মাউশি) অধিদপ্তর। কিন্তু নতুন নীতিমালায় সে সুযোগ আর রাখা হয়নি। সব ক্ষমতা নিজেদের কবজায় নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
এখন ঢাকাসহ বড় সিটি করপোরেশন এলাকা বাদে অন্য জেলা ও উপজেলায় শুধু প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে বদলির ফাইল উপস্থাপন করতে পারবে মাউশি অধিদপ্তর। তবে সিদ্ধান্ত নেবে মন্ত্রণালয়। এতে মাউশি অনেকটা ‘ঠুঁটো জগন্নাথে’ পরিণত হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, সরকার যেখানে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ করছে, সেখানে উল্টো পথে চলছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
গত ৩০ জুন সরকারি কলেজের শিক্ষক বদলি ও পদায়ন নীতিমালা-২০২৫ জারি করা হয়। এতে স্বাক্ষর করেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব সিদ্দিক জোবায়ের। একই দিন উপসচিব মো. মাহবুব আলম স্বাক্ষরিত বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারের শিক্ষক-কর্মকর্তাদের বদলি ও পদায়নের অনলাইন আবেদনসংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। তবে নীতিমালা ও বিজ্ঞপ্তির মধ্যেও অসামঞ্জস্য দেখা গেছে।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) মো. মজিবর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘নীতিমালা ও বিজ্ঞপ্তির মধ্যে যে অসামঞ্জস্য রয়েছে, তা স্পষ্টীকরণ করা হবে। তবে নীতিমালায় কোনো পরিবর্তন বা সংশোধন আনা হবে কি না, সে ব্যাপারে উপদেষ্টা ও সচিব মহোদয় সিদ্ধান্ত নেবেন। সে ব্যাপারে এখনই কিছু বলতে পারছি না।’
শিক্ষা ক্যাডারের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, আগের সিনিয়র সচিব তাঁর দু-একজন কর্মকর্তাকে নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছিলেন। সেই সিন্ডিকেটে ধরা না দিলে বদলি বা ভালো পদায়ন পাওয়া যেত না। তাঁরাই মূলত সব ধরনের বদলি নিজেদের কবজায় নিতে এই ধরনের নীতিমালা করেছেন। কিন্তু এখন ওই সিন্ডিকেট না থাকলেও আমলারা নিজেদের হাতে সব ক্ষমতা রাখতে সেই নীতিমালায় পরিবর্তন আনছেন না।
নাম প্রকাশ না করে একাধিক শিক্ষক বলেন, আমাদের সুযোগ-সুবিধা বা সমস্যার কথা মন্ত্রণালয়ে গিয়ে বলা সম্ভব নয়। এমনকি একই গ্রেডে বেতন পেয়েও উপসচিবরা আমাদের পাত্তা দেন না। অনেক সময়ই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। আর সচিবালয়ে ঢোকাও তো সম্ভব না। কিন্তু মাউশি অধিদপ্তরে যেহেতু শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা রয়েছেন, তাঁদের সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে কথা বলা সম্ভব। সমস্যার কথা বোঝানো সম্ভব। আর মাউশি অধিদপ্তর যদি ঢাকার বাইরের প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক বদলি করতে না পারে, তাহলে এই অধিদপ্তরেরই কী দরকার? এত কর্মকর্তা বসে আছেন, তাঁদের তেমন কোনো কাজ নেই। যতটুকু ছিল, তাও কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। তাহলে মাউশি অধিদপ্তর বন্ধ করে দিয়ে মন্ত্রণালয় থেকেই সব কাজ করলেই হয়।
সরকারি কলেজের শিক্ষক বদলি ও পদায়ন নীতিমালায় দেখা যায়, দপ্তর ও সংস্থা প্রধান এবং কলেজের অধ্যক্ষ ও উপাধ্যক্ষ পদে বদলি-পদায়ন সংক্রান্ত কমিটির সভাপতি হবেন সিনিয়র সচিব বা সচিব। কমিটির সদস্য থাকবেন অতিরিক্ত সচিব (কলেজ) ও মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, যুগ্মসচিব (কলেজ-১ অধিশাখা)। কমিটির সদস্যসচিব হবেন উপসচিব (কলেজ-২)।
বিভিন্ন দপ্তর, অধিদপ্তর, সংস্থা, প্রকল্প (প্রধান ব্যতীত অন্যান্য পদে), ঢাকা মহানগরসহ সব বিভাগীয় শহর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকার প্রভাষক থেকে অধ্যাপক পর্যায়ের এবং জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পর্যায়ের শিক্ষক বদলি ও পদায়নসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি হবেন অতিরিক্ত সচিব (কলেজ)। সদস্য থাকবেন যুগ্ম সচিব (কলেজ-১ অধিশাখা), মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কর্তৃক মনোনীত একজন পরিচালক, উপসচিব (কলেজ-১ বা ২) ও সদস্যসচিব হবেন উপসচিব (কলেজ ১ বা ২)।
ঢাকা মহানগরী ব্যতীত জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক পদে কর্মরত শিক্ষকদের বদলি ও পদায়নসংক্রান্ত কমিটির সভাপতি হবেন মাউশি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। সদস্য হবেন উপসচিব (কলেজ-১ বা ২), মাউশি অধিদপ্তরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) ও সদস্যসচিব হবেন উপপরিচালক (কলেজ-১)।
ঢাকার বাইরের সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষক বদলি কমিটির কার্যপরিধিতে বলা হয়েছে, বদলি ও পদায়নের আবেদন যাচাই-বাছাই করে সুপারিশ প্রণয়নপূর্বক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে উপস্থাপন করবেন। অর্থাৎ মাউশির মহাপরিচালকের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলতে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব বা সচিবকে বোঝায়। তাহলে বদলির ক্ষমতা আর মাউশির হাতে থাকল না। অথচ আগের নীতিমালায় এই কমিটির সভাপতি থাকতেন মাউশির পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন)। তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ মহাপরিচালকের কাছে ফাইল পাঠাতেন। তিনি অনুমোদন শেষে মাউশি থেকেই আদেশ জারি করা হতো।
আবার নীতিমালা ও বিজ্ঞপ্তির মধ্যেও রয়েছে অসামঞ্জস্যতা। বদলির বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, বদলি-পদায়ন নীতিমালা অনুযায়ী সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক, উপাধ্যক্ষ, অধ্যক্ষ, ঢাকা মহানগরসহ সব বিভাগীয় শহর, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ, কুমিল্লা সিটি করপোরেশনভুক্ত সব পদ এবং প্রাতিষ্ঠানিক পদের নিয়োগ ক্ষমতা মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত থাকবে এবং সারা দেশের অবশিষ্ট পদের (প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক) বদলিভিত্তিক পদায়নের ক্ষমতা মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরে ন্যস্ত থাকবে। অথচ নীতিমালায় মাউশির শুধু ফাইল উপস্থাপনের ক্ষমতা রাখা হয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে।